হাটে নয়, গরু কিনুন নেটে!
ঢাকা-পাবনা মহাসড়কে অসংখ্য যানবহন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীবাহী বাস, মাইক্রোবাস, ট্রাক, পিক আপ ভ্যান, মোটরসাইকেল, কি নেই!
কিছু কিছু ট্রাক গরুতে বোঝাই। ঢাকায় যাচ্ছে। কুরবানির হাটে। গবাদি প্রাণিগুলোর দুর্দশার অন্ত নেই। পানি, খাবার বা বিশ্রাম কিছুই জুটছে না এদের কপালে।
এদের মধ্যেই একটা ট্রাকের চালচিত্র কিছুটা ভিন্ন। নিয়ম করে থেমে গরুগুলোকে পানি, খাবার ও বিশ্রামের সুযোগ করে দিচ্ছে কর্তব্যরতরা। এ গরুগুলোও কুরবানির উদ্দেশ্যেই যাচ্ছে। গন্তব্য- প্রাণিসেবা গবেষণা খামার, আশুলিয়া; কোনো গরুর হাটে নয়।
খামারে গরুগুলোর জন্য পর্যাপ্ত যত্ন-আত্মির ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। সেখানে পৌঁছে গরুগুলো খাবে, বিশ্রাম নেবে ও ঘাসের জমিতে চড়ে বেড়াবে। এই গরুগুলো বিক্রি হবে অনলাইন গরুর হাট- প্রাণিসেবা শপে। পাবনার ক্ষুদ্র খামারি শাহিনেরও ছয়টি গরু আছে এই ট্রাকে।
কৃষি কাজ করে এবং খামার গড়ে উন্নতি করেছে এমন গল্প সবাই শুনেছেন। মোহাম্মদ শাহিন এদেরই একজন। তিনিও আশা করেন নিজের ক্ষেতে কাজ করে এবং খামার গড়ে একদিন ভাগ্যের চাকা ঠিকই ঘুরিয়ে ফেলবেন। স্বপ্ন দেখতে জানলে আর স্বপ্ন পূরণের ক্ষুধাটা তীব্র হলে তা একদিন বাস্তবে ধরা দেয়।
শাহিনের বাড়ি মেন্দা গ্রামে। মেন্দা পাবনার ভাঙ্গুরা উপজেলার একটি গ্রাম। পাবনা-সিরাজগঞ্জ যে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য বিখ্যাত, এ কথা সবাই জানে। স্বভাবতই গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মত শাহিন তার ভাগ্যোন্নয়নের জন্য গরুর খামার করাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। শাহিন গরুর জন্য গোয়াল ঘর এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। এরপর দু'টি গরু কিনে তার স্বপ্নের খামারের কাজ শুরু করেন। তার খামারে আরো ৭/৮ টি গরু লালন-পালনের ব্যবস্থা থাকলেও অর্থ সঙ্কটের কারণে খামার বড় করা আর হয়ে ওঠে না। এভাবেই স্বপ্ন পূরণের পথে খানিকটা মন্থর গতিতে এগুচ্ছিলেন শাহিন।
হঠাৎ পাশের গ্রামের জব্বার প্রামানিকের কাছে প্রাণিসেবা যৌথ খামার প্রকল্পের কথা জানতে পারেন শাহিন। গরু না কিনে, শুধু লালন-পালন করেই নাকি গরু বিক্রির পর লাভের ৬০ শতাংশ টাকা পাওয়া যায়। প্রথমে তো তিনি হেসেই উড়িয়ে দেন পুরো বিষয়টা, বলেন, 'আরে ওই জব্বার তুই চাপা মারার জন্যি আর কুনু মানুষ পালি নে, কনে পাইস এবা কতা? মোর এহন মেলা কাম রয়েছে, বুচ্চিস। মজা নেওয়া বাদ দে তো বাপ।' অগ্যতা হাল ছেড়ে দেয় জব্বার প্রামানিক।
পরে অবশ্য শাহিনকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে একদিন প্রাণিসেবার উঠান বৈঠকে নিয়ে আসেন জব্বার। উঠান বৈঠকে শাহিন জানতে পারেন যে প্রথমত, বিনিয়োগকারীর টাকায় প্রাণিসেবার কর্মকর্তারা বিভিন্ন হাট যাচাই-বাছাই করে গরু কিনে। বিনিয়োগকারি এবং খামারি উভয়কেই আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করতে প্রাণিসেবা প্রথমেই গবাদিপ্রাণিগুলোকে বীমা সেবার আওতায় নিয়ে আসে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রোগ বালাই এড়াতে গরু কেনার পরে প্রাণিসেবা গরুটিকে কৃমিনাশক খাওয়ায় এবং টিকা দেয়। এরপর গরুটি নির্বাচিত খামারিকে দেওয়া হয়। খামারি গরুটিকে খাওয়ায় এবং পরিচর্যা করে। প্রতিপালনের পুরো সময়টিতেই গরুটির দেখভাল প্রাণিসেবা অ্যাপের মাধ্যমে করা হয়। এছাড়াও যৌথ খামার এলাকায় প্রাণিসেবার এজেন্টরাও প্রকল্পের সুষ্ঠ বাস্তবায়নের সুবিধার্থে কাজ করেন। লালন-পালনের এই সময়ে গরুটির চিকিৎসার খরচ প্রাণিসেবা এবং ওষুধের খরচ বহন করে খামারি। পরবর্তী ৪-৬ মাস খামারি এই গরুটিকে লালন-পালন করে। এরপর প্রাণিসেবা শপের মাধ্যমে লাভজনক দামে গরুটি বিক্রি করা হয়।
জানুয়ারি ২০২১ থেকে তিনি প্রাণিসেবা যৌথ খামার প্রকল্পের একজন সদস্য। তার খামারে গরুর বেড়ে ওঠার পর্যাপ্ত সুবিধা থাকায় প্রাণিসেবা শাহিনকে চারটি গরু দেয়। এই চারটি গরুসহ নিজের গরুগুলোকে তিনি একসাথে লালন-পালন করেন। প্রাণিসেবা ভেটের দেওয়া খামার পরিকল্পনা ও দানাদার খাবারের পরামর্শমত তিনি তার গরুগুলোকে খাওয়ান এবং দেখাশোনা করেন। এতে করে গরুগুলো অল্প সময়েই বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠে।
এই প্রসঙ্গে আদর্শ প্রাণিসেবার ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফিদা হক বলেন "আদর্শ প্রাণিসেবার যৌথ খামার উদ্যোগের মাধ্যমে শুধুমাত্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাই লাভবান হচ্ছেন তা নয়, এতে প্রান্তিক খামারীদের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হচ্ছে এবং শহুরে গ্রাহকরাও ভাল মানের গরুর মাংস ও কোরবানির গরু পাচ্ছেন।"
আসন্ন কোরবানি ঈদে শাহিনের গরুগুলো বিক্রি হবে প্রাণিসেবা শপের (https://pranishebashop.com.bd/) মাধ্যমে। এতে করে তিনি গরুগুলো সর্বোচ্চ লাভজনক মূল্যে বিক্রি করতে পারবেন। এই টাকা তিনি তার অন্যান্য কৃষিকাজে বিনিয়োগ করতে পারবেন। প্রাণিসেবা শপে ঈদে গরু বিক্রির মাধ্যমে তিনি গ্রামের বাকি স্বচ্ছল খামারিদের মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠবেন। এখন শাহিন নিজের পরিবারের সকল চাহিদা মিটিয়ে আরো বড় পরিসরে খামার করার স্বপ্ন দেখছেন।