ফাহিম, আদুরে ভাইটি আমার (দ্বিতীয় কিস্তি)

অন্যান্য

রুবি অ্যাঞ্জেলা সালেহ
16 August, 2020, 11:00 am
Last modified: 17 August, 2020, 03:06 pm
(২য় কিস্তি) ছোট-বড় আইডিয়া সবসময় কিলবিল করত ফাহিমের মাথায়। একটা জাদুর টুপি ছিল যেন ওর মাথাটা। সেই টুপির ভেতর থেকে কখন কী বের হবে, কেউ জানে না। মাথায় যখন যে আইডিয়া আসত, তখনই সেটা নিয়ে কাজ করতে বসে যেত ও। একদণ্ড অবসর দিত না কোন আইডিয়াকে। মাথায় আসা আইডিয়াটাকে বাকিদের সবার উপভোগের জন্য কার্যে পরিণত করতে সারাক্ষণ উদগ্রীব থাকত।

দশ বছর বয়সে ফাহিম স্থানীয় ডলার স্টোর থেকে ক্যান্ডি কিনে স্কুলের বন্ধুদের কাছে বিক্রি করতে শুরু করে। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে স্কুলের প্রিন্সিপাল ওর ব্যবসা বন্ধ করে দেন। এর কয়েকদিন পর জন্মদিনের আগাম উপহার হিসেবে বাবার কাছে গয়না তৈরির কিট চাইল ও। তারপর সেটা দিয়ে পুঁতির ব্রেসলেট আর নেকলেস বানিয়ে বাড়ির পাশের খেলার মাঠে বিক্রি করতে লাগল। সেটা ছিল ওর দ্বিতীয় ব্যবসা।

প্রযুক্তি ছিল ফাহিমের নেশা। ও ছিল অসম্ভব সৃজনশীল আর কৌতূহলী ছেলে। ইন্টারনেটের খোঁজ পাওয়ার পর সৃষ্টিকর্তা-প্রদত্ত আশীর্বাদগুলো কাজে লাগানোর একটা উপায় পেয়ে গেল ও। ফাহিম যখন ওর প্রথম ওয়েবসাইট 'দ্য সালেহ ফ্যামিলি' বানায়, তখন ওর বয়স বারো। আমার ছবির পাশে ও ঠিক কী লিখেছিল মনে নেই। লেখাটা অনেকটা এরকম ছিল—'এটা আমার বড় বোন। ও খুব চমৎকার মানুষ, কিন্তু আমার কাছ থেকে যখন-তখন রিমোট কেড়ে নেয়। ব্যাপারটা আমার একদমই পছন্দ না।'

ফাহিম শিগগিরই জেনে গেল, ওয়েবসাইট তৈরি করে ইন্টারনেটে টাকা কামানো যায়। ১৯৯৯ সালে প্রথম ওয়েবসাইট তৈরি করে টাকা পায় ও। ওর বয়স তখন তেরো। বাবা-মা ততদিনে লুইজিয়ানা থেকে নিউ ইয়র্কের রচেস্টারে চলে এসেছেন। আমি তখন কলেজে পড়ি। বাড়ি থেকে আমার কলেজ দুই ঘণ্টার পথ। আমার ভাইয়ের সাইটটির নাম ছিল Monkeydoo: jokes, pranks, fake poop, fart spray and more for teenagers. ফাহিম সালেহর ঠিকানায় প্রথম যখন গুগল থেকে ৫০০ ডলারের চেক আসে, বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। পরে উনি আমাকে বলেছিলেন, 'এতটুকু ছেলে কীভাবে ৫০০ ডলার কামিয়ে ফেলল? এ তো বিশাল টাকা!'

আমার ভাইয়ের সাথে বাবার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একেবারেই আলাদা স্বভাবের মানুষ ছিল দুজনে—বাবা খুব বেশি চিন্তা করতেন, অন্যদিকে ফাহিম কখনও কোনকিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করত না। একমাত্র ও-ই বাবার রাগ কমাতে পারত। বাবাকে ওয়েবসাইটটা দেখিয়ে যে প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে ওটা তৈরি করেছে তা বুঝিয়ে দিল ও। বাবা নিজেও প্রোগ্রামার ছিলেন, কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের নানা বইয়ে বোঝাই ছিল তাই বাড়ির শেল্ফগুলো। সেসব বই পড়ে প্রোগ্রামিং শিখেছিল ফাহিম। ও বলে, 'টিনেজাররা সাইটে ঘুরতে আসছে, বাবা। ওদের ভিজিটের ওপর গুগলের বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকা কামাচ্ছি আমি।'

প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝলেও, ইন্টারনেট সম্পর্কে কিছুই জানতেন না বাবা। তবে ফাহিম তাকে বোঝায় যে চিন্তার কিছু নেই। তারপর ও নিজের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি চায়। কারণ ও জানত এরকম চেক এখন থেকে নিয়মিত আসবে। তেরো বছর বয়সি একটা ছেলেকে নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দেবেন কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন বাবা। তবে বরাবরের মতোই ফাহিম তাঁকে বোঝায় যে কোন সমস্যা হবে না।

সেদিন থেকে শেষ দেখার আগ পর্যন্ত নিজের কাজ নিয়েই বুঁদ হয়ে ছিল আমার ভাই। কাজের মাঝে ও এমনভাবে ডুবে যেতে পারত যে নাওয়া-খাওয়ার কথাও ভুলে যেত। ওর এই অভ্যাসের জন্য অনেক যন্ত্রণা সয়েছেন বাবা। ছোটবেলায় ও যখন বাড়িতে থাকত, তারপর বড় হওয়ার পরও যতদিন আমাদের বাবা-মার সঙ্গে থাকত, তখন বাবাই খেয়াল রাখতেন কাজ করার সময় কোন বেলায় যেন ওর খাওয়া-দাওয়া বাদ না যায়। খেতে খেতে নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলত ও। বলতে বলতে ওর চোখগুলো বড় বড় হয়ে যেত। ওর লম্বা লম্বা চোখের পাতা আর প্রাণচঞ্চল ওই চোখ দুটো দেখলেই আমার হিংসা হতো। ফাহিম বাড়ির বাইরে গেলেই বাবা চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়তেন, ও বোধহয় ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে না।

ওকে দাফনের পরদিন তিনি আমার কাছে এসে বললেন, 'আমার ফামি কী খেল না-খেল এসব নিয়ে চিন্তা না করে আমি কীভাবে বাঁচব?'

কয়েক বছর আগে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় বাবাকে। তারপর থেকে ফাহিম প্রতি মাসে বাবা-মাকে চেক পাঠাত, যাতে তাঁদের কোন অসুবিধা না হয়। এর আগেও ও মাকে নিয়মিত টাকা পাঠাত তাঁর পছন্দের জিনিসপত্র কেনার জন্য। পারিবারিক ডিনারে গেলে আমরা কখনও বাবাকে খাবারের দাম দিতে দিতাম না। ফাহিম যখন কলেজে, আর আমি চাকরি করি, তখন খাবারের বিল আমিই দিতাম। কিন্তু ২০০৯ সালে, কলেজ থেকে বের হওয়ার পর, প্রথম ব্যবসায়িক উদ্যোগটি হাতে নিয়েই আমাদেরকে খাওয়ায় ও। বাবা প্রায়ই ওসব ডিনার আর লুইজিয়ানায় আমাদের কষ্টের স্মৃতি রোমন্থন করতেন। সে সময় শনিবারে ডোমিনো'স-এ গেলে আমরা কখনও ৩.৯৯ ডলারের বেশি বিল করতে পারতাম না। প্রতি শনিবারে বাবার সেকেন্ড-হ্যান্ড নীল ফক্সওয়াগনে বসে বড় একটা পিৎজা আর এক বোতল সোডা ভাগাভাগি করে খেতাম আমরা।

বাবার সঙ্গে ফাহিম

২০০৩ সালে, সতেরো বছর বয়সে ইন্টারনেটে কে-এর সাথে পরিচয় হয় ফাহিমের। ওয়াহাইয়োর ছেলে কে পরবর্তীতে ওর ব্যবসার পার্টনার ও সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠে। ওরা দুজনে মিলে উইজটিন (Wizteen) নামে এক উদ্যোগ নেয়। এওএল, এআইএম ও অন্যান্য মেসেঞ্জার সার্ভিসের জন্য অবতার (Avatar ) বা ডলজ (Dollz) ডিজাইন করত ওরা। এখান থেকে যে আয় হতো, তা দিয়ে হাই স্কুলে উঠতে উঠতে আর্থিকভাবে স্বাধীন হয়ে ওঠে ফাহিম, বেন্টলে ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হওয়ার মতো টাকাও জমিয়ে ফেলে। বাবার ভার লাঘব করার যে লক্ষ্য ছিল, তা অর্জন করে ফেলে ও।

ফাহিম গ্র্যাজুয়েট করে ২০০৯ সালে। চাকরির বাজারের অবস্থা তখন ভয়াবহ, উইজটিন থেকেও আর তেমন আয় হচ্ছিল না। বাবা-মার বাড়ির বেজমেন্টে বসে কয়েক মাস নিজের পরবর্তী প্রজেক্টের কাজ করবে বলে বাৎসরিক ৫০,০০০ ডলার বেতনের আইটি চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় ও। আমার ভাইয়ের সবচেয়ে প্রিয় অভ্যাসগুলোর একটা থেকে প্র্যাঙ্কডায়ালের (Prankdial) জন্ম। দুষ্টুমি, হইচই আর সারপ্রাইজ ছিল ফাহিমের ব্যক্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা সবসময়ই জানতাম, ও বাড়িতে থাকুক বা না থাকুক, আমাদের জন্য এসবের যেকোন একটা অপেক্ষা করছে।

২০১৮ সালে, নাইজেরিয়ায় কাজ করার সময়, মাকে চমকে দেওয়ার জন্য, মা দিবসে ৫,০০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ফুল নিয়ে নিউ ইয়র্কে চলে আসে ও। আরেকবার রূপচর্চার সময় মায়ের হলুদমাখা মুখের ছবির ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে দেয়। কাজটা করেই খিলখিল করে হাসতে হাসতে দৌড়ে পালায়। ফাহিমকে আমি শেষ দেখেছি এক বছর আগে। আমাকে আর ওর নতুন ভাগ্নিকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আরেক মহাদেশে উড়ে এসেছিল ও।

ছোট-বড় আইডিয়া সবসময় কিলবিল করত ফাহিমের মাথায়। একটা জাদুর টুপি ছিল যেন ওর মাথাটা। সেই টুপির ভেতর থেকে কখন কী বের হবে, কেউ জানে না। মাথায় যখন যে আইডিয়া আসত, তখনই সেটা নিয়ে কাজ করতে বসে যেত ও। একদণ্ড অবসর দিত না কোন আইডিয়াকে। মাথায় আসা আইডিয়াটাকে বাকিদের সবার উপভোগের জন্য কার্যে পরিণত করতে সারাক্ষণ উদগ্রীব থাকত।

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.