কিম জন উন ও তার বাহারি পরিবহন

উত্তর কোরিয়া আর ও তার রহস্যময় শাসক কিম জং উন'কে নিয়ে যেন জল্পনা কল্পনা আর কৌতূহলের শেষ নেই বিশ্ববাসীর।
রহস্যময় জীবনযাপনের কারণে নানান সময়ে নন্দিত এবং নিন্দিত হয়ে আলোচনায় আসা উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ শাসক বরাবরই থাকেন মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্র বিন্দুতে।
যেমন ২০১৮ সালের মে মাসের কথাই ধরা যাক!
ওই বছরের ৭ ও ৮ মে চীনের দালিয়ান বিমানবন্দরে ভেড়ানো ছিল উত্তর কোরিয়ার রহস্যময় এক বিমান, আর তা নিয়েই নানা গুঞ্জনের চাঞ্চল্য শুরু হয়েছিল জনমনে।
অবশেষে জানা যায় বিমানটি কিম জং-উনের, তখন উপকূলীয় শহরটিতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন তিনি।
উত্তর কোরিয়ার রহস্যময় এ নেতার ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা বিশ্বকে বিস্তর এক ধারণা দিয়েছে তার ভ্রমণের পদ্ধতি সম্পর্কে। প্রতিটি সফরেই কিমের সাথে দেখা মেলে ভিন্ন ধরনের কোনো পরিবহনের।

বিমান- বিরল এক দৃশ্য:
কিম জং-উনের সেই চীন সফর ক্ষমতায় আসার পর তার প্রথম নিশ্চিত আন্তর্জাতিক ফ্লাইট হিসেবে চিহ্নিত। মিডিয়া রিপোর্ট বলছে, তিনি এর আগে উত্তর কোরিয়ায় ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করেছেন তার প্রাইভেট জেট।
যে বিমানে কিম চীনে গিয়েছিলেন, তা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি দূরপাল্লার বিমান, ইলিউশিন-৬২ (ইল-৬২)। উত্তর কোরিয়ায় বিমানটির নাম "চাম্মাই-১", স্থানীয় এক প্রজাতির বাজপাখির নামে নামকরণ করা হয়েছে বিমানটির।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চাম্মাই-১ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল; যখন এটি কিমের বোন কিম ইয়ো-জং-সহ পিয়ংইয়ং-এর উচ্চ পর্যায়ের অলিম্পিক প্রতিনিধি দলকে দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়ে যায়।
২০১৪ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোরিয়ান সেন্ট্রাল টেলিভিশন (কেসিটিভি) সম্প্রচারিত একটি তথ্যচিত্রে কিমকে দেখা গেছে একটি সোভিয়েত আমলে তৈরি ইউক্রেনীয় এন্টোনোভ-১৪৮ (এএন-১৪৮) ব্যবহার করতে ।

কিম জং-উনের বাবা কিম জং-ইল এবং দাদা কিম ইল-সাং উড্ডয়ন ভীতির কারণে বিমান ভ্রমণ এড়িয়ে চলতেন। তবে তরুণ কিমের এমন কোন সমস্যা নেই বলে ধারণা করা যায়। ২০১৫ সালে "উত্তর কোরিয়ার তৈরি" একটি হালকা ধরনের উড়োজাহাজ কিম'কে চালাতে দেখা যায় রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমের ফুটেজে এবং একটি এ-২ সামরিক বিমানের কনট্রোলে বসে থাকার ফুটেজেও তাকে দেখা যায়।

কিম পরিবারের উড্ডয়ন ভীতি সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবগত ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি জানতেন বিমানের বদলে উত্তর কোরিয়া থেকে চীন হয়ে কয়েকদিনের সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে বিশেষ ট্রেনে করেই ভিয়েতনামে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এসেছেন কিম জং উন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন ট্রাম্প বুঝলেন তাদের আলোচনা আর অগ্রসর হচ্ছে না, তখন কিম পরিবারের উড্ডয়ন ভীতি নিয়ে খোঁচা দিতেও ছাড়েননি তিনি।

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের শীর্ষ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ম্যাথিউ পটিঙ্গার এবিষয়ে বলেছেন: "প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিমকে এয়ারফোর্স ওয়ানে করে বাড়ি ফেরার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ট্রাম্প জানতেন যে, কিমের চীন হয়ে ভিয়েতনামের হ্যানয় থেকে রেলপথের যাত্রা কয়েকদিনের, তাই ট্রাম্প তাকে প্রস্তাব করেছিলেন: 'আপনি চাইলে দুই ঘন্টার মধ্যে আপনাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারব।' যদিও কিম সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
বিশাল ট্রেন:
২০১৮ সালের মার্চে যখন কিম জং-উন বেইজিং সফর করেন, তখন তিনি একটি 'বিশেষ ট্রেন' ব্যবহার করেছিলেন। যা ২০১১ সালের ডিসেম্বরে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সফরের জন্য ব্যবহার করতেন তার বাবা ।
চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে সময় ছড়িয়ে পড়ে কিম জং-উনের চীন সফরের জন্য হলুদ ডোরা সজ্জিত 'গাঢ় সবুজ ট্রেন' এর ভিডিও, যে ট্রেনকে তুলনা করা চলে কিম জং-ইলের ট্রেনের সাথে।

২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণশীল দৈনিক চোসুন ইলবো জানায় যে, কিম জং-ইলের সশস্ত্র ট্রেনে প্রায় ৯০টি বগি রয়েছে। কনফারেন্স রুম, গণমাধ্যম কর্মী ও গুরুত্বপূর্ণ দর্শনার্থীদের সঙ্গে দেখা করার কক্ষ, বেডরুম, ব্রিফিং ও যোগাযোগের এর জন্য স্যাটেলাইট ফোন এবং টেলিভিশনের ব্যবস্থাও ছিল সেই ট্রেনে।

উত্তর কোরিয়ার সংবাদ অনুসারে, কিম জং-ইল রাজধানী পিয়ংইয়ং-এর বাইরে একটি পরিদর্শন সফরে যাওয়ার সময় তার অফিসিয়াল ট্রেনেই মৃত্যুবরণ করেন।
দেশটির রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, বাবা এবং ছেলে উভয়েই তাদের আন্তর্জাতিক সফরের সময় ট্রেন ব্যবহার করেন।

মার্সিডিজ ম্যান?
বেইজিং সফরের সময় কিম প্রায়ই তার ব্যক্তিগত মার্সিডিজ বেঞ্জ এস-ক্লাসে করে শহরের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার দৈনিক জোয়াং আং ইলবোর মতে, গাড়িটিকে বিশেষভাবে পরিবহন করা হয় উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতার ট্রেনে।
পত্রিকাটি রিপোর্ট করেছে যে, ২০১০ সালে নির্মিত কিমের গাড়িটির দাম প্রায় ২ বিলিয়ন দ. কোরিয় ওন (১.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
প্রাকৃতিক প্রয়োজনে সাড়া দিতে কিমের গাড়িতে একটি প্রাইভেট টয়লেট'ও আছে বলে জানা গেছে।

সিউল ভিত্তিক ওয়েবসাইট ডেইলিএনকে-এর ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে জানানো হয়, কিমের সশস্ত্র গাড়িগুলোর একটিতে কাস্টমাইজড বাথরুম নির্মাণ করা হয়েছে।
রহস্যময় প্রমোদতরী
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে কিমকে নৌকা, সাবমেরিন, বাস এবং এমনকি স্কি লিফটের মতো বিভিন্ন নৌযানে চড়তে দেখা গেছে।

এছাড়াও, শোনা যাচ্ছে যে তিনি অন্যান্য ধরনের পরিবহন ব্যবহার করবেন, কিন্তু সেগুলো এখনো তার বিদেশ ভ্রমণে দেখা যায়নি।
২০১৩ সালের মে মাসে যখন রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম, সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি মাছ ধরার স্টেশনে কিমের ভ্রমণের ছবি প্রকাশ করে, তখন এনকে নিউজের সেই ফুটেজের দৃশ্যপটে একটি ইয়ট (প্রমোদতরী) লক্ষ্য করা যায়।

কোনভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ডলারের ইয়টটি কিমের কিনা! অথবা এমন বিলাসবহুল পণ্যের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, কিভাবে এটি উত্তর কোরিয়ায় আমদানি করা হলো।
তবে এই ইয়টটির মূল্যের কথা বিবেচনায় অনেক আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম; উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ শাসককেই ইয়টটির সবচেয়ে সম্ভাব্য মালিক হিসেবে অভিহিত করেছে।
২০১৫ সালের জুন মাসে ওয়াশিংটন ভিত্তিক রেডিও ফ্রি এশিয়া সংবাদ করে যে, একজন গবেষক দক্ষিণ পিয়ংগান প্রদেশে কিমের হ্রদ তীরবর্তী ভিলায় একটি নতুন হেলিপ্যাড দেখতে পেয়েছেন।
জনস হপকিন্স স্কুল অফ অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইউএস-কোরিয়া ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এ কর্মরত এই গবেষক ধারণা দিয়েছেন যে, এই হেলিপ্যাড কিমের পরিবার বা তাদের কাছে আসা অতিথিরা ব্যবহার করে থাকতে পারেন।
- সূত্র: বিবিসি