ইউক্রেনে যুদ্ধের মোড় রাশিয়ার দিকে ঘুরে গেছে

ইউক্রেনে হামলা করার কিছুদিন না যেতেই বিপাকে পড়ে রুশ বাহিনী। এ সময় চেষ্টা করলেও দখল করতে পারেনি কিয়েভ। সেই দুর্দশা কাটছে তাদের। বরং বলা যায়, পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে আসছে, যা যুদ্ধের সম্পূর্ণ দিক পরিবর্তন।
এখন এক এক করে আঞ্চলিক লক্ষ্যবস্তু দখল করছে রাশিয়া। এই হামলা প্রতিরোধের দরকারি অস্ত্র নেই ইউক্রেনের। দেশটির প্রতি পশ্চিমা দুনিয়ার সমর্থনে- জ্বালানি মূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং নজিরবিহীন ভোক্তা মূল্যস্ফীতির আঘাত পড়েছে। ফলে কিয়েভকে সমর্থনের জোয়ারে ভাটা পড়তে দেখা যাচ্ছে।
এরমধ্যেই ১০৮ তম দিনে পা রেখেছে ভ্লাদিমির পুতিনের এই বিনা-উস্কানির যুদ্ধ। তিনি দাবি করেছেন, ইউক্রেন ঐতিহাসিকভাবে রুশ সাম্রাজ্যের অংশ এবং আলাদাভাবে এই রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল কমিউনিস্টরা। তাই কিয়েভে পশ্চিমাদের হাতের পুতুল সরকার মানবেন না পুতিন। এবং রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই ইউক্রেনের নব্য-নাৎসীদের বিনাশ দরকার।
মস্কো এ যুদ্ধে নিরঙ্কুশ বিজয়ের কাছাকাছি না থাকলেও- এখন পুতিন বাহিনী নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে, ধীরে এবং রক্তাক্ত লড়াইয়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পূর্ব ইউক্রেন নিয়ন্ত্রণের দিকে এগিয়ে চলেছে।
এ বাস্তবতায় গত শনিবার দেশবাসীর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদমির জেলেনস্কি আরও একবার বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, "রাশিয়া যে যুদ্ধ শুরু করেছে, তাতে আমরাই জিতব। ইউক্রেনের রণাঙ্গনে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থা নির্ধারিত হবে।"
ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি এখন কেবল আশাই করতে পারেন। কারণ যুদ্ধ-পরিস্থিতি আমূল বদলেছে। যুদ্ধের শুরুতে পশ্চিমা দেশগুলোর বিপুল আর্থিক ও অস্ত্র সহায়তা আসছিল ইউক্রেনে। দেশটির প্রতিরোধ যোদ্ধারা তা দিয়ে রাশিয়ার আগ্রাসনকে ঠেকিয়েও দিচ্ছিল সবখানে। এসময় পুতিনকে পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতি তর্জন-গর্জনই করেই ক্রোধ প্রকাশ করতে হয়। মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে কিয়েভের সে সুদিনের আলো।
বিশ্ব পরিস্থিতি পশ্চিমাদের নতুন করেও ভাবতে শেখাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘতর ও রক্ত বন্যার হবে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। এরমধ্যেই দীর্ঘায়িত যুদ্ধ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের সরকার ও অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বৈদেশিক মুদ্রা সংকট, জ্বালানির উচ্চমূল্য, প্রায় সকল কাঁচামাল, খাদ্য আর নিত্যপণ্যের অস্থিতিশীল দামে মারাত্মক চাপের মধ্যে রয়েছে পৃথিবীর বাকি দেশগুলো।
দুই পক্ষের রক্তাক্ত এই দীর্ঘ লড়াই সবচেয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে। কিয়েভ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি জরুরি ভিত্তিতে আরও ভারী যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের অনুরোধ করলেও—ডনবাসে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে রাশিয়াকে ঠেকাতে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সামর্থ্য। রুশ বাহিনী সেখানে ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিতে নিয়েছে পোড়ামাটি নীতি। রকেট আর গোলা ছুঁড়ে ধবংসস্তূপে পরিণত করছে একের পর এক গ্রাম ও শহর।
ডনবাসের প্রধান একটি শহর সেভেরদনেৎস্ক- এ রুশ বাহিনীকে এখনও ঠেকিয়ে রেখেছে ইউক্রেনীয়রা। তবে তাদের হতাহতের সংখ্যাই তাতে বেড়েছে। সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও- ধারণা করা হচ্ছে দৈনিক অন্তত ১০০ ইউক্রেনীয় যোদ্ধা নিহত হচ্ছে। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে এই মুহূর্তেই তাদের আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদ দরকার।

দখল করা এলাকায় নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার দিকেও অগ্রগতি করছে রাশিয়া। ইতোমধ্যেই তার নমুনা দেখা যাচ্ছে কৃষ্ণসাগরের বন্দর নগরী মারিউপোলে, যা দীর্ঘ যুদ্ধের পর রাশিয়ার আয়ত্তে আসে। সেখানে রুশ বাহিনী স্থানীয় মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, শুধুমাত্র রুশ সাম্রাজ্যের অংশ হলেই তাদের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে। খেরসন ও মেলিটোপোলের মতো শহরেও প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে রাশিয়া। স্থানীয়রাও নিরুপায়, কাজ করতে হলে তাদের অবশ্যই রাশিয়ান পাসপোর্ট নিতে হবে। পাসপোর্ট নিয়েই তাদের মস্কোর আনুগত্য মেনে নেওয়ার প্রমাণ দিতে হবে।
তবে যুদ্ধে রাশিয়ার প্রতিকূলতা পুরোপুরি দূর হয়নি। বিশেষত দক্ষিণ ইউক্রেনে। এখানে প্রাদেশিক রাজধানী খেরসনের নিয়ন্ত্রণের লড়াই এখনও চলছে। ইউক্রেনীয় নাগরিক ও সাবেক সেনারা মিলিতভাবে সেখানে রুশ অবস্থানে হামলা করছে। গত কয়েক সপ্তাহে যার সংখ্যা বেড়েছে। যুদ্ধে রাশিয়ার প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রেমলিন নিশ্চিত করেনি। তবে তা ১০-২০ হাজারের কম হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় প্রচণ্ড প্রভাবিত হলেও বিস্ময়কর অদম্যতা দেখিয়েছে রাশিয়ার অর্থনীতি। এছাড়া, এশিয়া ও আফ্রিকায় পশ্চিমা দুনিয়া ও ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন কমছে।

উন্নয়নশীল দেশে আমেরিকান আধিপত্যবাদ নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। একারণেই তারা রাশিয়া ও চীনের মিত্রতাকে পশ্চিমা দুনিয়ার মতো বৈরী দৃষ্টিতে না দেখে বরং পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখে।
এদিকে চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির শিকার যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। আর্থিক বাজারে দৌদুল্যমান দশা, বাড়ছে সুদহার। সামনে ঘনিয়ে আসছে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের হুমকি। দীর্ঘ যুদ্ধে রাশিয়াকে মোকাবিলার চেয়ে নিজের ঘরের এসব দুর্যোগ সামাল দেওয়াই পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারের কাছে প্রাধান্যের হয়ে উঠছে।
যুদ্ধ এসব পরিণতির জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী না হলেও, সমস্যাগুলিকে তীব্র করেছে বহুগুণে। আর কবে এর অন্ত ঘটবে তাও কারো জানা নেই।

১৯৭০ এর দশকের মতো উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং একইসাথে অর্থনৈতিক মন্দার সম্ভাব্যতা রয়েছে বলেই মনে করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। সে সময়েও জ্বালানির উচ্চমূল্য বিশ্ব অর্থনীতির ভিত্তি ধরে নাড়া দেয়। এদিকে আগামী নভেম্বরেই অনুষ্ঠিত হবে আমেরিকার মধ্য-মেয়াদী নির্বাচন। তার আগে ভোটাররা প্রতি লিটার ৫ ডলার মূল্যের গ্যাসোলিন আর দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকুক তা কোনোমতেই চান না প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
অর্থাৎ, এই নির্বাচনের আগেই সমস্যাগুলির উল্লেখযোগ্য সমাধানই খুঁজছে ডেমোক্রেট প্রশাসন।
কিন্তু, সমাধান হবে কীভাবে? রাশিয়া দখলকৃত এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছাড়বে না। ইউক্রেনও আপোষের কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না। দেশটির প্রতিরোধ যোদ্ধারা এখনও লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম। ফলে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের দুয়ার আপাতত রুদ্ধ। সেকারণেই অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠা ঘিরে।
কিয়েভ ২৭ দেশের জোট ইউরোপিয় ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ হতে থাকলে তা রাশিয়াকে ক্ষুদ্ধ করে। যুদ্ধের মূল কারণও তাতে নিহিত। পুতিন এই পরিবর্তন মানতে চাননি এবং ইউক্রেনকে শায়েস্তা করতে সামরিক শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন।
গত শনিবার ইউক্রেনে যান ইউরোপিয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিন। তিনি জেলেনস্কির সাথে সাক্ষাৎ করে কিয়েভের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আগামী ২৩ ও ২৪ জুনের এক সম্মেলনে ইউক্রেনকে ইইউ সদস্যপদের আনুষ্ঠানিক প্রার্থী হওয়ার স্বীকৃতি দেবে ইউরোপিয় ইউনিয়ন। এরপর দেশটি সফরে যেতে পারেন ফরাসী রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল মাঁখো।
গত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পুতিনের সাথে নিয়মিত বিরতিতে সংলাপ অব্যাহত রেখেছেন মাঁখো। এর আগে তিনি পশ্চিমা মিত্রদের রাশিয়ার সাথে আপোষের পরামর্শ দেওয়ায় সমালোচনার তোড়ে পড়েন। তার পরামর্শ ছিল- কূটনৈতিক চ্যানেলে সমাধানের পথ খোলা রাখতে, রাশিয়াকে আর অপদস্থ না করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
তবে ইউক্রেনের বেশকিছু স্থানে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর যে অভিযোগ উঠেছে- তাতে করে সফল কূটনৈতিক সমাধানের দ্বার যে রুদ্ধ হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। দিনশেষে, জয় বলতে উভয় শিবির জয় কীসের ভিত্তিতে নির্ণয় করবে—তাও অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস