প্রাচীন বরফের হিমায়িত গ্রন্থাগারে জলবায়ুর অতীতের গল্প
জুলিয়াস সিজার বা ক্রিস্টোফার কলম্বাস যে বাতাসে শ্বাস নিয়েছিলেন সেটি কেমন ছিল তা কি বোঝা সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর মিলেছে ডেনমার্কের একটি বরফ সংরক্ষণাগারে, যেখানে কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন বরফ সংরক্ষিত রয়েছে। বিষয়টি আশ্চর্যের মনে হলেও এমনটাই জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
সংরক্ষণাগারটির নাম দি আইস কোর আর্কাইভ। এটি ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অবস্থিত। প্রাচীনকালের বরফ সংরক্ষিত রয়েছে এই বিশাল এই ফ্রিজারে। আর এসব বরফে জড়িয়ে আছে কয়েক হাজার বছর আগের বায়ুমণ্ডলের চিত্র।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর জলবায়ুর যে পরিবর্তন তা সংরক্ষিত এই বরফ থেকে বোঝা সম্ভব। অর্থাৎ সিজার বা ক্রিস্টোফার কলম্বাসরা যে বাতাসে শ্বাস নিয়েছিলেন এসব বরফ থেকে সেই বাতাস সম্পর্কে জানা যাবে।
ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেনের তুষার ও বরফবিদ্যা বিষয়ের অধ্যাপক জর্গেন পিডার স্টিফেনসেন বলেন, এই আর্কাইভে প্রাগৈতিহাসিক জলবায়ুর পরিবর্তনের তথ্য রয়েছে, যা গত ১০ হাজার বছরে মানুষের কার্যকলাপের একটি সংরক্ষণাগার। ৪৩ বছর ধরে স্টিফেনসেনের নেশা বড় বড় এসব বরফের টুকরা। ১৯৯১ সাল থেকে তিনি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এই সংরক্ষণাগারটি পরিচালনা করে আসছেন। এখানে বড় বড় বাক্সে লম্বা সারির তাকগুলোতে বরফের ৪০ হাজার বড় বড় টুকরা সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
স্টিফেনসেন ব্যাখ্যা করেন, তুষারকণার মধ্যে বুদবুদ আটকে রয়েছে এবং এসব বুদবুদের মধ্যে যে বাতাস আটকে রয়েছে, তার বয়স এসব বরফের বয়সের সমান।
সংরক্ষণাগারের উপকক্ষ (মূল কক্ষের পাশের ছোট আরেকটি কক্ষ) একটি গ্রন্থাগারের পাঠকক্ষের মতো। এখানে বিজ্ঞানীরা মূল 'গ্রন্থাগার' বা সংরক্ষণাগারের বরফ নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। তাদের এ গবেষণাটি খুব দ্রুত সম্পন্ন করতে হয়। কারণ উপকক্ষটির তাপমাত্রা মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেখানে মূল সংরক্ষণাগারের তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
স্টিফেনসেন সংরক্ষণাগারের একটি বাক্স থেকে বরফের একটি বড় টুকরা সরিয়ে ফেলেন। খালি চোখেই এর ভেতরে বাতাসের বুদবুদ দেখা যাচ্ছিল। এই বরফের তুষারগুলো বহু বছরের প্রাচীন।
গবেষকদের একটি দল ১৯৬০-এর দশকে গ্রীনল্যান্ডের একটি গোপন মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ক্যাম্প সেঞ্চুরি থেকে ডেনমার্কে প্রথম বরফের বড় একটি টুকরা এনেছিলেন।
এরপর সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা গ্রিনল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলে ভূ-পৃষ্ঠের ২.৬ কিলোমিটার গভীর থেকে সম্ভাব্য সবচেয়ে পুরনো বরফের টুকরা সংগ্রহ করেন। এই নমুনাগুলোতে এক লাখ ২০ হাজার বছরের পুরনো নির্যাস রয়েছে। এটি সাম্প্রতিক আন্তঃহিমবাহ সময়কালের যখন গ্রীনল্যান্ডের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা এখনকার চেয়ে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।
স্টিফেনসেন বলেন, পৃথিবী এখনকার চেয়ে আগেই বেশি উষ্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা ছিল মানুষ আসার আগে।
সম্প্রতি সংগৃহীত এই বরফ বিজ্ঞানীদের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি সম্পর্কে বুঝতে সহায়তা করতে পারে। কারণ ছোট এই বরফের টুকরা থেকে আংশিকভাবে এটি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
ব্যাখ্যার আরেকটি অংশ হতে পারে বরফের প্রবাহ। বর্তমানে বরফ উদ্বেগজনক মাত্রায় গলে যাচ্ছে এবং তা অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে।
স্টিফেনসেন বলেন, 'আমরা যদি বরফের প্রবাহকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকা থেকে (সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে) এর অবদান কতটা হবে সে সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পেতে পারি।'
তিনি আশা করেন, এ থেকে তারা ১০০ বছরের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হবেন।
মানবসৃষ্ট দূষণের আগে বায়ুমণ্ডলের অবস্থা বোঝার একমাত্র উপায় বরফের এসব টুকরা। স্টিফেনসেন বলেন, 'সময়ের সাথে সাথে গ্রিনহাউস গ্যাস, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং মিথেনের পরিবর্তন কীভাবে হয় তা আমরা বরফের টুকরার সাহায্যে বিস্তারিত তুলে ধরেছি। আধুনিক যুগে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর প্রভাবও আমরা দেখতে পাচ্ছি।'
আইস মেমোরি ফাউন্ডেশনের প্রধান জেরোম চ্যাপেলাজ বলেন, 'গ্রিনল্যান্ডের বরফের স্মৃতি সংরক্ষণ করা খুব ভালো। তবে একটি ফ্রিজে নমুনা সংরক্ষণ প্রযুক্তিগত ত্রুটি, অর্থের সমস্যা, আক্রমণ এমনকি যুদ্ধের জন্য সংবেদনশীল।