ভারতের কোচিং রাজধানী কোটা: ‘দেশটির সবচেয়ে চাপে থাকা শহর’
ভারতের রাজস্থানের কোটা শহরে প্রতিবছর তিন লাখের মতো শিক্ষার্থী জড়ো হন। এখানে এসে তাদেরকে দিনে ১৮ ঘণ্টা পড়ালেখা করতে হয়, পরীক্ষায় পাওয়া নাম্বার তাদের হাসি-বিষাদের কারণ হয়। এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ ভারতের পরবর্তী প্রজন্মের চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হন। আর বাকিদের জন্য কোটা হয়ে ওঠে বিধ্বস্ত জীবনের অপর নাম।
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে কোটা ভারতের 'কোচিং রাজধানী' হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এখানে গড়ে উঠেছে প্রায় ডজনখানেক বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। দেশটির সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতামূলক মেডিকেল ও প্রকৌশল কলেজগুলোর ভর্তিপরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর শহরটিতে প্রস্তুতি নিতে আসেন।
এ বছর ২০ লাখের বেশি ভারতীয় শিক্ষার্থী মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় (নিট) অংশ নিয়েছেন। তারা মাত্র এক লাখ ৪০ হাজার আসনের জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছেন। অন্যদিকে আইআইটি নামক প্রযুক্তি কলেজগুলোর ১০ হাজার মহার্ঘ আসনের বিপরীতে পরীক্ষা দিয়েছেন ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী।
কোটায় পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের বয়স ১৭ থেকে ২০-এর কোঠায়। পাঠ্যক্রমের সঙ্গে তাল মেলাতে তাদেরকে বেশিরভাগ সময়ই পড়ালেখার পেছনে ব্যয় করতে হয়। তারা সপ্তাহের সাতদিনই পড়ার মধ্যে থাকেন। কেউ কেউ ভোর চারটাতে উঠেই পড়া শুরু করেন, তারপর সারাদিনে আরও ছয় ঘণ্টার ক্লাস। প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর একটি করে পরীক্ষা থাকে তাদের। সেগুলোর নম্বর আবার উন্মুক্ত করে প্রকাশ করা হয়।
মেডিকেলের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ২২ বছর বয়সি রানি কুমারী বলেন, 'আমার বন্ধু বা সামাজিকীকরণের সময় নেই। আমার বই-ই আমার বন্ধু।'
'এটা সারা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপে থাকা শহর,' মন্তব্য শ্রী কুমার বর্মা'র। ১৯ বছর বয়সী এ তরুণ শহরটির অন্যতম বড় কোচিং অ্যালেন ক্যারিয়ার ইনস্টিটিউট-এ নিট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 'যেখানেই তাকাবেন, দেখবেন সব মরিয়া তরুণ-তরুণী। কোটায় আসা মানে হয় আপনার সাফল্য মিলবে অথবা একেবারে ভেঙে পড়বেন।'
কোটার 'মহিমা' ভারতের সর্বত্র। খোদ দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শহরটিকে ভারতের 'শিক্ষার কাশীধাম' বলে অভিহিত করেছেন। এ শহরটির কোচিং বাণিজ্য বর্তমানে ১২০ বিলিয়ন রুপিতে দাঁড়িয়েছে। পরীক্ষাগুলোতে সবচেয়ে বেশি নাম্বার পাওয়া 'টপার'দের সারাদেশে তারকাদের মতো উদযাপন করা হয়, বিলবোর্ডে তাদের ছবি সাঁটানো হয়, তাদের কলেজ থেকে লাখ রুপি পুরস্কার দেওয়া হয়। এ কলেজগুলোও আবার একে অপরের সঙ্গে শীর্ষস্থান দখলের প্রতিযোগিতায় নামে।
এসবের বাইরে একটি কালো অধ্যায়ও রয়েছে। কোটার অতিরিক্ত চাপের পরীক্ষাগুলো, শিক্ষার্থীদের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক, পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা — এ নিষ্ঠুর সংস্কৃতির ওপর সম্প্রতি আলোকপাত করা হচ্ছে।
এ বছর এ শহরে কোচিং করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৭ জন নিজেদের জীবন ত্যাগ করেছেন। এ সংখ্যা রেকর্ড। ভারতের অনেক মন্ত্রী কোচিংকেন্দ্রগুলো নিষিদ্ধ করারও দাবি তুলেছেন। দেশটির পার্লামেন্টে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং এ মাসে রাজস্থানের রাজ্য সরকার উচ্চ আত্মহননের হার কমাতে নতুন কিছু নীতিমালা তৈরি করেছে। কক্ষগুলো থেকে সিলিং ফ্যান সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে এসব বিষয় নিয়ে কোটা'র কোনো প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক দ্য গার্ডিয়ান-এর সঙ্গে কথা বলেনি।
তবে কোচিং সেন্টারগুলোর সমালোচনা হলেও শিক্ষার্থীরা এবং মনস্তাত্ত্বিকেরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি চাপ তৈরি হয় বাড়ি থেকে। পরিবারে একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার থাকা ভারতে দীর্ঘকাল ধরেই উচ্চমর্যাদার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর অনেক মা-বাবার কাছে এ মর্যাদা অর্জনের রাস্তা হচ্ছে কোটা।
গত সেপ্টেম্বরে ঝাড়খণ্ডের এক ১৭ বছর বয়সি মেয়ে তার কক্ষে গলায় দড়ি দেয়। পুলিশ জানায়, মেয়েটি তার ডায়েরিতে লিখেছিল: 'কোটা ছেড়ে বাড়ি গেলে আমার সব কষ্ট শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি জানি, আমার মা দুঃখ পাবে, হতাশ হবে যদি আমি চলে যাই।'
অ্যালেনের মতো বড় কোচিং সেন্টারগুলোর দাবি, শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের ৫০ জনের বেশি মনোবিদ ও কাউন্সেলর আছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্ণতার লক্ষণ দেখা দিলেও মা-বাবা সেগুলোকে উড়িয়ে দেন।
কোটার কোচিং স্কুলগুলোতে পড়ার খরচও অনেক। এখানে পড়তে একজন শিক্ষার্থীকে বছরে দেড় লাখ রুপি ফি দিতে হয়। এছাড়া প্রতি মাসে বাড়তি আরও ৩০ হাজার রুপি লাগে থাকা-খাওয়াসহ অন্যান্য খরচে। তাই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেই তাদের সন্তানদের এসব কোচিংয়ে পাঠাতে হয়।
বড় কোচিং সেন্টারগুলো সারা ভারতের বিভিন্ন শহরে তাদের কার্যক্রম চালু করেছে। কোটা থেকে প্রতিনিধি বা শিক্ষকেরা এসব শাখায় গিয়ে পড়ান, মা-বাবাদের তাদের সন্তানদের কোচিংয়ে পাঠাতে উৎসাহ দেন। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ১১ বছর বয়স থেকেই এসব কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় ভবিষ্যতের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে।
মানসিক সহায়তা দিতে দেশে প্রথমবারের মতো হেল্পলাইন সেবা শুরু করেছে 'কান পেতে রই'। কেউ চাইলে নিজেদের নাম-পরিচয় গোপন রেখে বিনামূল্যে 'কান পেতে রই'-এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। এছাড়া অনলাইন ও সরাসরি দুইভাবেই মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় বিশেষজ্ঞ কাউন্সেলিং সেবা ও পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে 'মনের বন্ধু'।