ভবিষ্যতের ব্যাটারি? যেভাবে তুলা ও সমুদ্রের পানি যন্ত্রপাতিতে যোগাবে শক্তি
ধরুন, একটি এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। কিন্তু তবুও রাস্তার পাশের থাকা ক্যাশ মেশিন থেকে তোলা যাচ্ছে টাকা। অনেকের কাছে এই কাণ্ড অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলেও, এর প্রকৃত কারণ খুঁজতে গেলে স্বাভাবিকই মনে হবে। কেননা ঐ মেশিনের ভেতরে স্থাপন করা আছে একটি ব্যাকআপ ব্যাটারি। যেটি আবার তুলা পুড়িয়ে সেখান থেকে ধারণ করা কার্বন দিয়ে তৈরি। খবর বিবিসির।
ভিন্নধর্মী ব্যাটারিটির প্রস্তুতকারক জাপানি প্রতিষ্ঠান পিজেপি আই। কোম্পানির চিফ ইন্টেলিজেন্স অফিসার ইনকেতসু ওকিনা বলেন, "সত্যি বলতে, ব্যাটারিটি তৈরির পদ্ধতি বেশ গোপনীয়। কত তাপমাত্রায়, কোন পরিবেশে এটি তৈরি করা হয় সেটি আমরা খোলাসা করি না।"
ওকিনা জানান, ৩ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় এক কেজি তুলাকে পুড়িয়ে প্রায় ২০০ গ্রাম পর্যন্ত কার্বন পাওয়া যায়। আর এগুলো থেকে প্রতিটি ব্যাটারি তৈরি করতে মাত্র ২ গ্রাম কার্বন প্রয়োজন হয়। ফলে ফার্মটি ২০১৭ সালে শিপমেন্টে যে তুলা এনেছিল, সেটির চালান এখনো শেষ হয়নি।
ভিন্নধর্মী ব্যাটারিটি তৈরিতে অ্যানোড হিসেবে তুলা থেকে পাওয়া কার্বন ব্যবহার করা হয়। অথচ সাধারণ ব্যাটারিগুলোতে বেশিরভাগ সময়ই অ্যানোড হিসেবে গ্রাফাইট ব্যবহার করা হয়। পিজেপি আইয়ের মতে, গ্রাফাইটের পরিবর্তে কার্বন ব্যবহার বেশ সুবিধাজনক।
বিশ্বব্যাপী সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা। তাই গবেষক ও ব্যবসায়ীরাও লিথিয়াম আয়ন ও গ্রাফাইট ব্যাটারির বিকল্প খুঁজছেন। সেক্ষেত্রে তুলা থেকে শোষিত কার্বন দিয়ে তৈরি এই ব্যাটারিটি বেশ সম্ভবনাময় বলে মনে করছে প্রস্তুতকারক কোম্পানি।
খনি থেকে লিথিয়াম উত্তোলনের পরিবেশগত ঝুঁকি অনেক। এতে প্রচুর পানি ও জ্বালানিরও প্রয়োজন হয়। একইভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তৈরি গ্রাফাইটেরও পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
যেমন, লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে ব্যবহৃত কোবাল্টের বেশিরভাগই কঙ্গোর খনি থেকে উত্তোলন করা হয়। কিন্তু সেখানে কাজের সার্বিক পরিবেশ বেশ বিপজ্জনক।
এক্ষেত্রে সমুদ্রের পানি, জৈববর্জ্য, ন্যাচারাল পিগমেন্ট- প্রকৃতিতে বিদ্যমান এ ধরনের নানা বিকল্প ব্যবহার করা যেতে পারে। একইসাথে বাস্তবসম্মতভাবে চিন্তা করলে বাজারে থাকা ব্যাটারির সাথে ভিন্নধর্মী উপাদান দিয়ে তৈরি ব্যাটারি অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা করতে পারছে।
ক্যাশ মেশিন যন্ত্রে যদিও ব্যাটারি দ্রুত চার্জ হওয়ার বিষয়টা তেমন একটা প্রয়োজন হয়না, কিন্তু বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে ব্যাটারি দ্রুত চার্জ হওয়া জরুরি। চীনা ফার্ম গোছিয়া মূলত হিটাচির সাথে মিলে একটি ই-বাইক তৈরি করেছে যাতে পিজেপি আই ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে। এটি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে এবং এক চার্জে ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে।
অন্যদিকে জার্মানির হেলমহোল্টজ ইনস্টিটিউট উলমের ডেপুটি ডিরেক্টর স্টেফানো পাসেরিনি বলেন, "বিশাল মহাসাগরেই রয়েছে ব্যাটারি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের সীমাহীন ভাণ্ডার।"
স্টেফানো ও তার সহকর্মীরা ২০২২ সালে প্রকাশিত এমন একটি ব্যাটারি ডিজাইনের কথা বলেছেন যেটি সমুদ্রের পানি থেকে সোডিয়াম আয়ন স্থানান্তর করে এবং এটি থেকে পরবর্তীতে ধাতব সোডিয়ামের একটি ভাণ্ডার তৈরি করা যায়। এক্ষেত্রে তারা একটি ভিন্নধর্মী স্পেশাল পলিমার ইলেক্ট্রোলাইট তৈরি করেছে যেটি দিয়ে সোডিয়াম আয়ন পরিবাহিত হতে পারে।
অন্যদিকে কিছু গবেষক আবার মানুষের হাত ও দাঁতে থাকা পদার্থগুলোকে ক্যাথোডের ক্যালসিয়ামের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, এটি সিলিকনের সাথে মেলানো যেতে পারে, যা আগামীতে ব্যাটারিতে ক্যালসিয়াম আয়ন পরিবহনে সহায়তা করবে।
অন্য গবেষকেরা আবার ব্যাটারিতে ব্যবহারের জন্য নতুন ধরনের ইলেক্ট্রোড তৈরি করতে ভুট্টার এবং তরমুজের বীজের খোসার মতো বৈচিত্র্যময় উপকরণ ব্যবহার করার দিকে নজর দিচ্ছে। এগুলো ব্যাটারি শিল্পের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পারে- এমন স্কেলে উৎপাদন করাই এখন গবেষকদের লক্ষ্য।
বিকল্প ব্যাটারি সামগ্রী তৈরির জন্য সবসময়ই একটা চাপ থাকে। যেমন, লিথিয়াম এবং গ্রাফাইট ব্যাটারি প্রযুক্তির কথাই ধরা যাক। বর্তমানের মতো এটি ব্যবহার হতে থাকলে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে প্রায় দুই মেগাটন গ্রাফাইটের প্রয়োজন হবে। বর্তমানে যার পরিমাণ মাত্র ৭০০ কিলো টন। তাই অনেকেই এর বিকল্প ব্যবহারের কথা ভাবছেন।
এ সম্পর্কে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক ব্যাটারি সায়েন্টিস্ট ও ইঞ্জিনিয়ার জিল পেস্তানা বলেন, "ম্যানুফ্যাকচারিং প্রক্রিয়ার গ্রাফাইটের পরিবর্তে অন্যকিছু ব্যবহার করতে গেলে যে পরিবর্তন আসবে সেটা খুব ব্যয়বহুল। বাণিজ্যিক দিক থেকেও এটি একটি বেশ বড় ঝুঁকি।"
এছাড়াও কার্বন অ্যানোডের জন্য জৈব বর্জ্য ব্যবহার করার বিষয়েও পেস্তানা সন্দিহান। কেননা এই ধরনের বর্জ্যের উৎস সবসময় পরিবেশগতভাবে ইতিবাচক নাও হতে পারে।
অন্যদিকে, ক্রেতারা পণ্য কেনার সময় স্থায়িত্বের বিষয়টিকে বেশ যত্নসহকারে বিবেচনা করে থাকে। এক্ষেত্রে যথাযথভাবে তৈরি করা বিকল্প ব্যাটারির উপকরণগুলির বাজার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়াও ভবিষ্যতের ব্যাটারিগুলি জৈববর্জ্য থেকে প্রাপ্ত কার্বন বা অন্য কোনও সম্ভাব্য আরও টেকসই পদার্থ দিয়ে তৈরি হতে পারে।