গাজার ফিলিস্তিনিদের জন্য ইসরায়েলের ডেডলাইন ব্যর্থ হয়েছে
গাজা উপত্যকার উত্তর অর্ধাংশের বেসামরিক নাগরিকদের এলাকা ছাড়তে ইসরায়েল যে নির্দেশ দিয়েছে, তাতে এখনও পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এসেছে বলে মনে হয় না।
শুক্রবার ইসরায়েলের দেওয়া এ নির্দেশের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল, তা কেউ জানে না। তবে উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, ইসরায়েলের এ নির্দেশ পুরোপুরি সফল হয়েছে, তা বলা যাবে না।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণার পর থেকেই দেশটি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে প্রায়-নিরন্তর সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। পৌনে এক শতাব্দী ধরে দুই পক্ষ একে অপরকে পরাস্ত করার চেষ্টা করছে। সেই প্রচেষ্টার প্রথম ধাপ হলো শত্রুর অন্দর-বাহির সব সম্পর্কে জানা।
প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে ইসরায়েল এত সফলভাবে আরব রাজনৈতিক ও সামরিক কাঠামোতে অনুপ্রবেশ করেছে যে ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের যুদ্ধে মিসর ও সিরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বিত আকস্মিক আক্রমণের মতো দেশটিতে আরেকটি আকস্মিক হামলার সম্ভাবনা সবাই-ই উড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু গত ৭ অক্টোবর ঠিক তা-ই হলো। হতচকিত ইসরায়েল পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল এদিন, যদিও খানিক বাদেই যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সহায়তায় ঘুরে দাঁড়ায়। এখনও অব্যাহত আছে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা। এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে আকাশপথে ৮ হাজার টনের বেশি সামরিক রসদ ইসরায়েলে পাঠিয়েছে ওয়াশিংটন।
আর কখনও শত্রুর হামলার মুখে এরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় না পড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইসরায়েল। সেজন্য এজেন্ট, তথ্যদাতা, গোয়েন্দা, বিশ্লেষক এবং অত্যাধুনিক নজরদারি ও গুপ্তচরবৃত্তির প্রযুক্তিতে মোটা বিনিয়োগও করেছিল।
কিন্তু তারপরই এল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, শনিবার। এদিন মহাশক্তিধর, অজেয় ইসরায়েলকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত করে ফেলল হামাস। অথচ ইসরায়েলিদের বিশ্বাস ছিল, ফিলিস্তিনিদের প্রতিটি পদক্ষেপ আগেভাগে তাদের নখদর্পণে চলে আসবে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বছরের পর বছর এই ব্যর্থতা নিয়ে গবেষণা করবে। সব ইসরায়েলিই এখন জানে, কোথাও একটা বিশাল ভুল হয়েছিল তাদের। তাদের আশা, এমন ভুল এ-ই শেষ।
কিন্তু তাদের ধারণা আবারও ভুল প্রমাণ হতে পারে। ইসরায়েল যে পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারেনি এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাই না করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার ইঙ্গিত হতে পারে উত্তর গাজা খালি করার এ আদেশ।
বেশিরভাগ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বেসামরিক জনগণের মধ্যে আতঙ্কের বীজ বপন করা গেলে অবশ্যম্ভাবীভাবে তার প্রতিফলন পড়ে সামরিক বাহিনীতে। নিজেদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের আতঙ্কে পালিয়ে যেতে দেখে সৈন্যরা অবধারিতভাবে নিজেদের প্রশ্ন করেন: 'আমি তাহলে কার জন্য যুদ্ধ করব?'
বেসামরিক নাগরিকরা চলে যাওয়ার পর সামরিক বাহিনী ভাবে, শূন্য ভূমির জন্য প্রাণ দেওয়ার কোনো অর্থ কি আদৌ আছে? কাজেই গাজাবাসীদের এলাকা খালি করার আদেশ দেওয়ার একটি উদ্দেশ্য হতে পারে হামাস যোদ্ধাদের মনে এই অনুভূতির সঞ্চার করা করা।
আতঙ্কে পালানোর সময় বেসামরিক লোকেরা যোগাযোগের লাইনগুলো বন্ধ করে দেয়। এর ফলে যুদ্ধরত ইউনিটগুলোর জন্য রণকৌশল ঠিক করা, পিছন থেকে রিইনফোর্সমেন্ট আনা এবং ফ্রন্টলাইনে গোলাবারুদ সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
গাজা উপত্যকা আক্ষরিক অর্থেই সরু ফিতের মতো—মাত্র ১০ কিলোমিটার চওড়া এবং ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ। এইটুকুন ভূখণ্ডে ২২ লাখ মানুষের বসবাস। এখানকার আবাসন অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত। আর যুদ্ধ ছাড়াই যানজটের দশা যুদ্ধাবস্থার মতো বিশৃঙ্খল। তার সঙ্গে গাজা থেকে বের হওয়া ও প্রবেশ প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল। তাই গাজাকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় 'উন্মুক্ত কারাগার'।
ইসরায়েল বিমান থেকে লিফলেট ফেলে বেসামরিক নাগরিকদের বলেছে, তারা যেন উত্তর-দক্ষিণের প্রধান দুটি সড়ক—উপকূলীয় সড়ক এবং সালাহ আল-দীন রোড—ব্যবহার করে। এই সড়কগুলোতে মানুষের এত ভিড় হবে যে সেই মানবস্রোত ঠেলে উত্তর দিকে এগোতে পারবেন না ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা।
ইসরায়েল এখানে ক্লাসিক সামরিক কৌশল খাটিয়েছে—প্রতিপক্ষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করা, অথবা প্রতিপক্ষের সামরিক নড়াচড়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া। যেকোনো প্রথাগত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে—যারা শতভাগ প্রথাগত সামরিক কায়দায় কাজ করে—ইসরায়েলের এই কৌশল নিশ্চিতভাবেই দারুণ পদক্ষেপ হতো। কিন্তু প্রতিপক্ষ যখন হামাস, তখন একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে—তারা প্রথাগত সামরিক কায়দায় কাজ করে না বললেই চলে। কাজেই ইসরায়েলের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশ জোরালো।
হামাসের সশস্ত্র শাখা কাজ করে গেরিলা ইউনিটের মতো, নিয়মিত সেনাবাহিনীর মতো নয়। এ উইংয়ের সৈন্যরা প্রথাগত ব্যারাকে থাকেন না, যেখান থেকে তারা সরকারি অবকাঠামোর মাধ্যমে প্রয়োজন অনুসারে সেনা মোতায়েন করতে পারবে। সামরিক অর্থে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে নিরাপদে আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো অবকাঠামো—যেখানে সামরিক সরঞ্জামাদি মজুত রাখবে—হামাসের নেই। মোদ্দা কথা হচ্ছে, নিয়মিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে হামাসের বলতে গেলে কোনো মিলই নেই—এই ব্যাপারটা ইসরায়েলের মাথায় রাখা উচিত।
ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা সাধারণ জনগণের সঙ্গে মিশে থাকেন। যখন কোনো প্রচারবার্তা পাঠাতে চান—ইসরায়েলে আক্রমণ করার সময় যেমনটা হয়েছে—কেবল তখনই তারা ইউনিফর্ম পরেন। গাজায় একেবারেই সাধারণ বেশভূষায়, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে, কারও নজর না কেড়ে ঘুরে বেড়ান তারা। অবশ্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে থাকার দরকার কমই পড়ে হামাস যোদ্ধাদের—কারণ তাদের আছে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের এক বিশাল নেটওয়ার্ক। ওই সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক তাদের দৃঢ় সুরক্ষা দেয়। বিমান ও ড্রোনের নজরদারির আওতার বাইরে তাদের এই সুড়ঙ্গগুলো।
এমনকি ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর নির্বিচার বোমা হামলার মুখে হামাস যোদ্ধারা যখন পালান, তখনও গাজার বেসামরিক নাগরিকরা চূড়ান্ত পর্যায়ের ভয় পায় বলে মনে হয় না।
ইসরায়েল যদি পরাজয় এবং আত্মসমর্পণের অস্ত্র হিসেবে সেই অনিয়ন্ত্রিত ভীতি তৈরি করতে চেয়ে থাকে, তাহলে তাদের সেই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। উত্তর গাজা খালি করার আদেশ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য যদি হামাসকে বাধা দেওয়া এবং সামরিকভাবে অকার্যকর করে তোলা হয়, তাহলে ইসরায়েলের সেই উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হয়েছে।