যুক্তরাষ্ট্র বলছে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিজয় অসম্ভব, মস্কোর সামনে দীর্ঘ যুদ্ধ
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা- জয়েন্ট চিফ অব স্টাফসের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি বলেছেন, ইউক্রেনে সামরিক জয় অর্জন করতে পারবে না রাশিয়া। অন্যদিকে, ইউক্রেন তাদের ভূখণ্ড থেকে অচিরেই রুশ সেনাদের হঠাতে পারবে এমন সম্ভাবনাও নেই।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা সহায়তার লক্ষ্যে গঠিত ইউক্রেন ডিফেন্স কনটাক্ট গ্রুপের এক ভার্চুয়াল বৈঠক হয়। সভাশেষে প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে জেনারেল মিলি সাংবাদিকদের বলেন, "সামরিকভাবে এই যুদ্ধ রাশিয়া জিততে পারবে না।" কিয়েভের সরকার পতন ঘটানোর যে মূল লক্ষ্য রাশিয়ার "সেটাও সামরিকভাবে অর্জন করা সম্ভব নয়।"
রাশিয়ার লাখ লাখ সেনা ইউক্রেনে অবস্থান করছে। ফলে দখলীকৃত সব এলাকা উদ্ধারের যে লক্ষ্য কিয়েভের রয়েছে তাও 'স্বল্পমেয়াদে' বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
"অর্থাৎ, যুদ্ধ চলতেই থাকবে। আরো রক্তপাত ঘটবে। এ লড়াই হবে খুবই কঠিন। এক পর্যায়ে, উভয় পক্ষকে হয় সংঘাত অবসানের জন্য আলোচনায় বসতে হবে, নাহলে সামরিক সমাধানই অর্জন করতে হবে"- যোগ করেন তিনি।
এই যুদ্ধে কোনো পক্ষেরই সুস্পষ্ট বিজয় লাভের লক্ষণ নেই, আলোচনার কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। এ বাস্তবতায়, ইউক্রেন যুদ্ধ আরো দীর্ঘ সময় ধরে চলমান থাকবে, সমর বিশ্লেষকদের থেকে এমন পূর্বাভাসই মিলছে। জেনারেল মার্ক মিলি-র পর্যালোচনাও যার সাথে যুক্ত হলো।
এই যুদ্ধ কয়েক দশকব্যাপী চলতে পারে এমন কথা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ-ও বলেছেন।
রুশ বার্তা সংস্থা- রিয়া নিউজ এজেন্সি বৃহস্পতিবার মেদভেদভের মন্তব্য প্রকাশ করে।
তিনি মনে করছেন, আগামীতে দীর্ঘদিন ধরে চলবে এই সংঘাত। মাঝেমধ্যে স্বল্পমেয়াদি (কয়েক বছর স্থায়ী) যুদ্ধ-বিরতি দেখা যাবে, তারপর আবারো লড়াই শুরু হবে।
দিমিত্রি মেদভেদেভ বর্তমানে রাশিয়ান ফেডারেশনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। গত ২৩ মে শেষ হয় ভিয়েতনামে তার তিনদিনের আনুষ্ঠানিক সফর। এসময় করা তার মন্তব্যকে উদ্ধৃত করে বার্তাসংস্থাটি জানায়, "এই সংঘাত দীর্ঘকাল স্থায়ী হবে, খুব সম্ভবত কয়েক দশক। কিয়েভে যতদিন এ ধরনের সরকার ক্ষমতায় থাকবে, ধরে নিন সেক্ষেত্রে দুই বছর যুদ্ধের পর তিন বছরের যুদ্ধ-বিরতি হলো। তারপর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।"
ইউক্রেন প্রসঙ্গে নানান মন্তব্য করে আগেও আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তোলার জন্য পরিচিত মেদভেদেভ। তার মন্তব্যগুলো বিভিন্ন সময় হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদের শিরোনাম। যেমন চলতি বছরের শুরুর দিকে তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় পারমাণবিক যুদ্ধের সূচনা করবে।
হয়তো নেহাত ভুলও বলেননি। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইউক্রেনের পক্ষে কূটনৈতিক সমর্থন ও সামরিক সহায়তা জোরদারের তৎপরতা চালাচ্ছে। এক ডজনের বেশি দেশ থেকে অস্ত্র সরবরাহের সমন্বয় করছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে দিন দিন উত্তেজনার পারদ বেড়েই চলেছে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে। ইতঃপূর্বে যুদ্ধবিমান না দেওয়ার নীতিতে অবিচল থাকলেও, গত সপ্তাহে আকস্মিকভাবে ইউক্রেনকে এফ-১৬ জঙ্গিবিমান দিতে রাজি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সব মিলিয়ে এপর্যন্ত ইউক্রেনের সমর্থক দেশগুলো ৬৫ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে বলে গতকাল বৃহস্পতিবারের (২৫ মে) সংবাদ সম্মেলনে জানান মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন।
'জাদুকরি অস্ত্র নয়'
বৃহস্পতিবার কিয়েভের সমর্থক দেশগুলো, ইউক্রেনীয় পাইলটদের এফ-১৬ সহ চতুর্থ প্রজন্মের পশ্চিমা যুদ্ধবিমানে প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে। তিনি উল্লেখ করেন, 'এ ধরনের প্রশিক্ষণ উদ্যোগের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করাটা যথেষ্ট কঠিন হবে'।
অস্টিন জানান, ইউক্রেনকে জেট ফাইটার ট্রেইনিং দেওয়ার বিষয়ে ডাচ ও ডেনিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করছেন। এই উদ্যোগে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে নরওয়ে, বেলজিয়াম, পর্তুগাল ও পোল্যান্ড। এছাড়া, সার্বিক যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় যেন অন্যান্য দেশ অবদান রাখতে পারে –সেজন্য একটি তহবিল গঠন করা হবে বলেও জানান তিনি।
অবশ্য এফ-১৬ যুদ্ধবিমান কোনো 'জাদুকরি অস্ত্র' নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এফ-১৬ হোক বা অন্য অস্ত্র 'এখানে কোনো জাদুকরি অস্ত্রের কথা বলা হচ্ছে না'। তিনি উল্লেখ করেন, ১০টি এফ-১৬ বিমানের রক্ষণাবেক্ষণসহ খরচ পড়বে ২ বিলিয়ন ডলার। একথার মাধ্যমে যুদ্ধবিমানটি বড় সংখ্যায় সরবরাহ করা কতোটা ব্যয়বহুল এমন ইঙ্গিতই দেন।
অস্টিন বলেন, "রাশিয়ার কাছে হাজারের মতো চতুর্থ ও (কমসংখ্যক) পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার জেট আছে। তাই রাশিয়াকে আকাশযুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে হলে- একই ধরনের বিমান পর্যাপ্ত সংখ্যায় থাকতে হবে।"
আর ঠিক একারণেই এফ-১৬ কোনো জাদুকরি সমাধান হবে না কিয়েভের জন্য। তবে এতে ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনীর সামর্থ্য কিছুটা হলেও বাড়বে। কিন্তু তাতেও লাগবে দীর্ঘসময়।
অস্টিন ব্যাখ্যা করেন, "ইউক্রেনের বিমান বাহিনীর ভবিষ্যৎ সক্ষমতা বাড়াতে এফ-১৬ হয়তো ভূমিকা রাখবে, কিন্তু সে ধরনের বড় বিমান বাহিনী গড়ে তুলতে দীর্ঘ সময় লাগবে"। সে তুলনায়, ইউক্রেনের এখন সবচেয়ে বেশি দরকার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মতো অস্ত্র।
এরমধ্যেই বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দুজন মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র খুব শিগগিরই ইউক্রেনকে আরো ৩০ কোটি ডলারের একটি সামরিক সহায়তা দেবে। প্রধানত বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদই থাকবে এই প্যাকেজে। এরমধ্যে থাকতে পারে হিমার্স লঞ্চারের জন্য গাইডেড রকেটসহ অন্যান্য গোলা।
এদিকে ওয়াশিংটিন-ডিসি ভিত্তিক চিন্তক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) জানিয়েছে, দীর্ঘ যুদ্ধ রাশিয়ার লক্ষ্য নয়। কিন্তু, ইউক্রেনে দ্রুত বিজয় লাভের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার পর এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়েছে মস্কোকে। আর সে অনুযায়ী, মানিয়ে নিতে হচ্ছে। দীর্ঘ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া কতখানি সক্ষম তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে সেক্ষেত্রে দেশটি নিজ সামরিক বাহিনী পুনর্গঠনের সুযোগও পাবে।
অবশ্য "ইউক্রেনের পাল্টা-আক্রমণ রাশিয়াকে তার সামরিক সম্পদের ঘাটতি পূরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে। এতে রাশিয়ার আক্রমণ চালানোর সামর্থ্য হ্রাস পাবে এবং অবশেষে ইউক্রেনের সেনারা রুশ বাহিনীকে তাদের ভূখণ্ড থেকে তাড়িয়ে দিতেও পারবে" - আইএসডব্লিউ আরো জানায়।
তাদের বিশ্লেষণ মতে, ক্রেমলিনের দীর্ঘযুদ্ধের ধারাভাষ্য ইঙ্গিত দেয়, পুতিন রাশিয়ার বৃহৎ পরিসরের যুদ্ধ পরিচালনার সক্ষমতা বাড়াতে চাইছেন। একইসঙ্গে, পশ্চিমাদের ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দেওয়া থেকে বিরত রাখতেও এ ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ইতঃপূর্বে রাশিয়া যেমন পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি, যুদ্ধ-বিরতির প্রচেষ্টাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলেছে – এটাও তেমনি এক ধরনের প্রচারযুদ্ধ।"