বিশ্বজুড়ে চলা খাদ্যসংকটে যোগ হয়েছে পেঁয়াজও
ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় স্প্রিং রোলের ব্যবসা করা লালাইন বাসা সাধারণত তার রোল বানানোর জন্য এক কেজি পেঁয়াজ কিনতেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পেয়াজের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে পড়ায় তাকে এখন আধা কেজি পেঁয়াজ দিয়েই কাজ সারতে হচ্ছে।
এদিকে মরক্কোর রাজধানী রাবাতের বাসিন্দা ফাতিমা পেঁয়াজ আর টমেটোর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সেগুলো খাওয়াই বাদ দিয়েছেন। তিনি এখন রান্নার জন্য আর্টিকোক (এক ধরনের সবজি) ব্যবহার করেন। তিন সন্তানের মা ফাতিমার ভাষ্যে, "বাজারে আগুন লেগেছে।"
১২ হাজার কিলোমিটার ব্যবধানে থাকা এই দুই নারীর অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে পৃথিবীজুড়ে খাদ্যসংকট কোনদিকে মোড় নিয়েছে। পৃথিবীব্যাপী খাবারের অপুষ্টি বাড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে এর ফলে।
গম আর শস্যের দাম গত কয়েক মাসে কমেছে, এতে প্রধান খাদ্য নিয়ে চিন্তা কিছুটা কমেছে। তবে সবজির বাজারে ধাক্কা লেগেছে ভিন্নভাবে। স্বাস্থ্যকর খাবারের অন্যতম মূল খাবার পেঁয়াজের সংকট চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে বিশ্ব নাগরিকদের কপালে।
সবকিছুর দাম বেড়ে চলেছে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে ক্রমাগত, যার ফলে বিভিন্ন দেশ বাধ্য হচ্ছে তাদের পণ্য নিজেদের কাছেই রাখতে। মরক্কো, কাজাখস্তান এবং তুরস্ক বেশ কিছু পণ্যের রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফিলিপাইনও মজুদকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তদন্ত শুরু করেছে।
কেবল পেঁয়াজই নয়, গাজর থেকে শুরু করে টমেটো, আলু আর আপেলের ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংক এই মাসের শুরতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের সুপারমার্কেটের খালি পড়ে থাকা সবজির শেলভগুলো পুনরায় ভরে উঠলেও সেগুলো রেশন করে বিক্রি করা শুরু হয়েছে।
রোমে অবস্থিত জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার সিনিয়র অর্থনীতিবিদ সিন্ডি হলেম্যান জানান, "কেবল প্রয়োজনমাফিক ক্যালরি খাওয়া যথেষ্ট নয়। খাবারের গুণমানও পুষ্টি এবং খাদ্য নিরাপত্তার যোগসূত্র। খাবারের মান ভালো না হলে তা বিভিন্ন ধরনের অপুষ্টির দিকে মোড় নিতে পারে।"
পেঁয়াজ সারাবিশ্বের একটি মূল খাবার হিসেবে বিবেচিত। টমেটোর (যদিও এটি একটি ফল) পর এটিই সবচেয়ে বেশি খাওয়া সবজি। প্রতি বছর প্রায় ১০৬ মিলিয়ন টন পেঁয়াজ উৎপাদন করা হয়, যা গাজর, মরিচ আর রসুনকে একত্র করা পরিমাণের সমান। তরকারি থেকে শুরু করে স্যুপ কিংবা হটডগের ওপর টপিং হিসেবে ব্যবহার করা হয় এই অতিপ্রয়োজনীয় সবজিকে।
পেঁয়াজের এই দাম বেড়ে যাওয়ার সূত্রপাত হয়েছে অনেকগুলো কারণে- পাকিস্তানের বন্যা, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা পড়ায় মধ্য এশিয়ায় স্টোর করে রাখা পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এদিকে উত্তর আফ্রিকার কৃষকরা খরার পাশাপাশি বীজ আর সারের দাম বেড়ে যাওয়ার সাথেও যুদ্ধ করে পেঁয়াজ উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে।
বাজে আবহাওয়াও মরক্কোর কৃষকদেরকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মরক্কোর সরকার পশ্চিম আফ্রিকায় টমেটো আর পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেও দেশটির রাজধানীর বাজারে আগে থেকেই পেঁয়াজের দাম প্রচণ্ড বেশি। ৫১ বছর বয়সী অবসর নেওয়া সরকারি কর্মকর্তা ফাতিমা জানান, তার আয়ে মাসের শেষ পর্যন্ত খাবার কেনা যাচ্ছে না। রমজান মাসে এর প্রভাব আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
"আমরা এখন আরও বেশি ডাল, হোয়াইট বিন আর ফাভা বিন খাচ্ছি। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমাদেরকে খুব দ্রুতই ভাত খাওয়া শুরু করতে হবে," বলে জানান ফাতিমা। খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ইস্যুতে মরক্কোর সরকারের রাজনৈতিক চাপের কারণে নিজের পুরো নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করেন তিনি।
রাবাতের ওশান মার্কেটে ৩০ বছর ধরে সবজি বিক্রি করা ব্রাহিম জানান, ব্যবসা খুবই ধীরগতিতে চলছে। "আমি এতদিন দেখতাম কেবল একা থাকা ব্যক্তিরা এক পিস হিসেবে সবজি কেনেন। এখন আমি অবাক হয়ে যাই, যখন দেখি আমার দোকান থেকে ১০ থেকে ২০ বছর ধরে সবজি কেনা ব্যক্তিরা এক পিস টমেটো, একটা পেঁয়াজ কিংবা একটা আলু কিনছেন। লোকজনের হাতের পয়সা ফুরিয়ে আসছে।"
ফিলিপাইনের অবস্থাও যে ভিন্ন তা নয়। গত কয়েক মাসে পেঁয়াজের সাথে সাথে চিনি থেকে লবণ, সবকিছুর দামই বেড়ে গিয়েছে। পেঁয়াজের দাম এতটাই বেশি যে সেগুলো এখন মাংসের চেয়েও বেশি দামি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে লুকিয়ে পেঁয়াজ আনতে গিয়ে ধরাও পড়েছেন বেশ কয়েকজন বিমানকর্মী। ১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতির পর প্রেসিডেন্ট ফার্দিন্যান্ড মার্কোস জুনিয়রের সরকার পেঁয়াজ আমদানির দিকে জোর দিয়েছেন।
তিন দশক ধরে জন্মদিন আর বিয়ের অনুষ্ঠানে ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা করা বাসা জানান, "আমাকে এখন পেঁয়াজের সামান্য অংশ ব্যবহার করতে হচ্ছে। এভাবেই চালাতে হচ্ছে কারণ আমি আমার পণ্যের দাম বাড়িয়ে নিয়মিত ভোক্তাদেরকে হারাতে চাই না।"
কাজাখস্তানে পেঁয়াজ মজুদকারীদের ওপর ব্যবস্থা নিচ্ছে সেখানকার সরকার। এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী বস্তা ধরে পেঁয়াজ না কেনার অনুরোধ করেছেন জনসাধারণকে, যারা পেঁয়াজের দাম বাড়ার আশঙ্কায় একবারে প্রচুর পরিমাণে কেনার চেষ্টা করছে। পেঁয়াজ রপ্তানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তারা। সে তালিকায় যুক্ত হয়েছে কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তানের নামও। আজারবাইজানও 'নির্দিষ্ট পরিমাণ'-এর বেশি পেঁয়াজ একজনের কাছে বিক্রি করছে না।
পুষ্টিকর সবজি ও ফলের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে ৩ বিলিয়নেরও বেশি মানুষের স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার সক্ষমতা নেই।
লন্ডনের চ্যাথাম হাউজের রিসার্চ ডিরেক্টর টিম বেনটন জানান, "সারাবিশ্বের সরকারগুলোর অন্যতম অগ্রাধিকার এখন তাদের জনগণের কাছে পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা।" তিনি একে 'নিউট্রিশন টাইম বম্ব' হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, "আমাদের চিন্তা এখন কেবল হর্ন অব আফ্রিকাতে হওয়া বছরের পর বছর ধরে চলা দুর্ভিক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিৎ নয়। সারাবিশ্বে এখন অপুষ্টিতে ভোগা ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। এটা এখন এক বৈশ্বিক সমস্যা।"
বেন্টন জানান, "বর্তমানে গম বা ময়দার ওপর সরকারগুলো ব্যাপক পরিমাণ ভর্তুকি দিলেও সবজির ওপর তেমন সাহায্য নেই। এর পরিণতি হচ্ছে সারা বিশ্বে এখন প্রচুর পরিমাণে স্টার্চ থাকা শস্য, চিনি আর তেল উৎপাদন হচ্ছে, যা স্বাভাবিক পুষ্টির প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য যে পরিমাণ সবজি এবং ফল উৎপাদন করা প্রয়োজন, তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদিত হচ্ছে।"
দেশে দেশে সাধারণ জনগণকে রাস্তায় টেনে আনার জন্য রুটির মতো পেঁয়াজেরও সক্ষমতা রয়েছে। ভারতে এ কারণে রপ্তানি বন্ধও রাখতে হয়েছে। ১৯৯৮ সালে দিল্লীর নির্বাচনে বিজেপি হেরে যাওয়ার কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় পণ্যের অতিরিক্ত দামকে। দুই দশক পর আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপি নেতা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কৃষককে তার 'টপ প্রায়োরিটি' হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
বেন্টনের মতে, "বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা এবং দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য গম, ধান এবং অন্যান্য শস্য খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু আদতে অনেক দেশে পার্শ্ব খাদ্যপণ্যগুলোই সাধারণ মানুষকে খুশি রাখে।"
সূত্র: ব্লুমবার্গ