চীন-পাকিস্তানের তৈরি এ যুদ্ধবিমানটি শীঘ্রই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দেশে ব্যবহৃত জেট হতে পারে
চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমানটি দামে সস্তা হলেও রয়েছে বিধ্বংসী ক্ষমতা। শীঘ্রই এটি বিশ্বে সবচেয়ে বিস্তৃত পরিসরে ব্যবহৃত যুদ্ধবিমানে পরিণত হতে পারে। খবর জানিয়েছে বিজনেস ইনসাইডার।
এ বছরের নভেম্বরের গোড়ার দিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান বাহরাইন ইন্টারন্যাশনাল এয়ার শোয়ে আকাশযুদ্ধের নৈপুণ্য প্রদর্শন করে।
একই সময়ে চীন তাদের বার্ষিক চায়না ইন্টারন্যাশনাল এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস এক্সিবিশন-এ জেএফ-১৭ ওড়ায়।
চীন ও পাকিস্তান যৌথভাবে চতুর্থ প্রজন্মের এ যুদ্ধবিমানটি তৈরি করেছে। এ দুই অনুষ্ঠানে তাদের উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে জেএফ-১৭-কে তুলে ধরা।
বর্তমানে কেবল পাকিস্তান, মিয়ানমার, ও নাইজেরিয়া জেএফ-১৭ ব্যবহার করে। এভিয়েশন উইক-এর উপাত্ত অনুযায়ী, ২০২১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ তিন দেশ সর্বমোট ১৪৫টি জেএফ-১৭ পরিচালনা করেছে।
এভিয়েশন উইক তখন আরও জানিয়েছিল, এ দশকের মাঝামাঝিতে এ সংখ্যা ১৮৫তে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। এবং এ হার বজায় থাকলে ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বিদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত চীনা যুদ্ধবিমান হতে পারে জেএফ-১৭।
জেএফ-১৭ থান্ডার
চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রি ও পাকিস্তান অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্সের যৌথ নির্মাণ জেএফ-১৭ ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো আকাশে ওড়ে। একক আসনের এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট এ যুদ্ধবিমানটি পাকিস্তানে জেএফ-১৭ থান্ডার ও চীনে এফসি-১ শিয়লং নামে পরিচিত।
৫০,০০০ ফুট উঁচু উড্ডয়ন ক্ষমতা ও ঘণ্টায় ১,২০০ মাইল পর্যন্ত গতি তুলতে পারা জেএফ-১৭ এরিয়াল ইন্টারসেপ্ট ও আকাশ থেকে ভূমিতে আক্রমণের মতো একাধিক ধরনের মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম। সাতটি হার্ডপয়েন্টে এটি প্রায় ৩,১৭৫ কেজি (৭,০০০ পাউন্ড) পর্যন্ত গোলাবারুদ বহন করতে পারে। এর পাশাপাশি জেএফ-১৭'র রয়েছে একটি ২৩ মিমি সিঙ্গেল টুইন-ব্যারেল অটোক্যানন।
প্রথম কয়েকটি জেএফ-১৭ পুরোপুরিভাবে চীনে তৈরি করা হয়। কিন্তু এখন পাকিস্তানেই এটির বেশিরভাগ উৎপাদন হচ্ছে। শতকরা হিসেবে বর্তমানে জেএফ-১৭'র ৫৮ শতাংশ পাকিস্তান ও ৪২ শতাংশ চীন উৎপাদন করছে।
যৌথভাবে নির্মাণ করলেও কেবল পাকিস্তান এটি সার্ভিসে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির বিমানবাহিনী জেএফ-১৭ ব্যবহার করতে শুরু করে। জেএফ-১৭-এর মাধ্যমে পাকিস্তান বিমানবাহিনী তাদের বহরে থাকা পুরোনো নানচ্যাং এ-৫, চেংদু এফ-৭, এবং মিরেজ ৩ ও ৫ অ্যাটাক ও ফাইটার যুদ্ধবিমানগুলো প্রতিস্থাপন করার পরিকল্পনা করেছে।
প্রায় ১২৫টি জেএফ-১৭ এখন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর মেরুদণ্ড। কথিত আছে, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে ও ২০১৭ সালে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ইরানের তৈরি একটি ড্রোন ভূপাতিত করতে জেএফ-১৭ ব্যবহার করেছিল দেশটি।
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আরও বলেছেন, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডগফাইটের মাধ্যমে ভারতের একটি মিগ-২১ ভূপাতিত করেছিল জেএফ-১৭। (ভারত দাবি করেছিল, পাকিস্তানের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান তাদের মিগকে ভূপাতিত করেছিল।)
শুরুর পর থেকে বেশ কয়েকবার আপগ্রেডেশন হয়েছে জেএফ-১৭'র। এটির সাম্প্রতিকতম সংস্করণ ব্লক থ্রি ২০১৯ সালের শেষ দিকে প্রথম আকাশে ওড়ে। এ সংস্করণে একটি বাড়তি হার্ডপয়েন্ট, একটি কোয়াড-রেডানডেন্ট ডিজিটাল ফ্লাই-বাই-ওয়্যার ব্যবস্থা, ও একটি অ্যাক্টিভ ইলেকট্রনিক্যালি স্ক্যানড অ্যারে রাডারের মতো উল্লেখযোগ্য কিছু উন্নয়ন দেখা গেছে।
পাকিস্তান ব্লক থ্রি জেএফ-১৭-কে ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হিসেবে বিবেচনা করে। দেশটির বিমানবাহিনী কমপক্ষে ৫০টি ব্লক থ্রি জেএফ-১৭ কেনার পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে কিছু বিমান গত জানুয়ারিতে পাক বিমানবাহিনীর হাতেও এসেছে। বিমানটিতে ইতোমধ্যে চীনের অন্যতম অগ্রসর আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য একটি মিসাইলও সংযুক্ত করতে দেখা গেছে।
সাশ্রয়ী ও চটকদার
পাকিস্তান বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জেএফ-১৭ ব্যবহার করে। আর এটির প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রেতা মিয়ানমার ছয়টি, এবং নাইজেরিয়া তিনটি জেএফ-১৭ পরিচালনা করে।
বর্তমানে বাজারে যেসব চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান রয়েছে, সেগুলোর চেয়ে অনেক সস্তা জেএফ-১৭। এটির দাম ১৫ থেকে ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কম প্রতিরক্ষা বাজেটের যেসব দেশ মাল্টিরোল কমব্যাট যুদ্ধবিমান কিনতে চায়, তাদের জন্য জেএফ-১৭ একটি আকর্ষণীয় বিমান।
মার্কিন থিংক ট্যাংক র্যান্ড কর্পোরেশন-এর একজন জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক ও প্রতিরক্ষা গবেষক টিমোথি হিত বলেন, 'এটি হয়ত সেরা প্রযুক্তি নয়, কিন্তু এটির পারফরম্যান্সের ওপর দিব্যি নির্ভর করা যায়। এ যুদ্ধবিমানটি এফ-২২-এর মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করার জন্য তৈরি করা হয়নি, তাই এর মারাত্মক কার্যক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশের প্রয়োজন নেই। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এ বিমানটি বেশ উপযোগী।'
বিশ্বের অনেক দেশ জেএফ-১৭-এ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। শোনা গেছে, ইরাক কমপক্ষে ১২টি জেএফ-১৭ কিনতে রাজি হয়েছে। মিশরও এ বিমান সংগ্রহে আগ্রহ দেখিয়েছে। বেশ কয়েকবছর ধরেই আজারবাইজান জানিয়েছে দেশটি জেএফ-১৭ চায়। বলিভিয়া ও আর্জেন্টিনাও এটি সংগ্রহের কথা বিবেচনা করছে।
মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার যুদ্ধবিমান, সাঁজোয়া যান, ও ভারী আর্টিলারির ওপর নির্ভরশীল। চীন যদি জেএফ-১৭-এর বিক্রি বাড়াতে পারে, তাহলে 'ভ্যালু আর্মস'-এর বাজারে এর অংশীদারি বেড়ে যাবে। যেসব অস্ত্র কম খরচে বানানো হয়, অথচ যুদ্ধক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর; সেগুলোকে ভ্যালু আর্মস বলা হয়।
তবে বেশি বিক্রি করতে পারলেই যে চীনের ওপর ওই দেশগুলো নির্ভরশীল হয়ে পড়বে তাও নয়। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশই কোনো একটি দেশের ওপর অস্ত্রের জন্য নির্ভরশীল না হয়ে একাধিক দেশ থেকে নিজেদের অস্ত্র ক্রয় করে।