তুরস্ক-রাশিয়ার সম্পর্ক গভীর হচ্ছে, নাখোশ পশ্চিমারা
তুরস্ক ও রাশিয়ার অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক গভীর করে চলেছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং ভ্লাদিমির পুতিন। এনিয়ে নড়েচড়ে বসছে পশ্চিমা সরকারগুলি। তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, রাশিয়াকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সাহায্য করলে ন্যাটো সদস্য তুরস্কের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত শুক্রবার রাশিয়া ও তুরস্ক উভয় দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে বাণিজ্য ও জ্বালানিতে সহযোগিতা নিয়ে চার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়।
যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক প্রভাবশালী পশ্চিমা গণমাধ্যমকে এনিয়ে তাদের উদ্বেগের কথাও জানান ছয় জন পশ্চিমা সরকারি কর্মকর্তা।
রাশিয়া ও তুরস্কের সহযোগিতাকে 'খুব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ' করা হচ্ছে বলে জানান ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক কর্মকর্তা। তুরস্ক রাশিয়ার জন্য একটি বাণিজ্যিক প্লাটফর্ম হয়ে উঠছে বলেও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
আরেক কর্মকর্তা অবশ্য বলছেন, রাশিয়ার প্রতি তুরস্কের সাম্প্রতিক আচরণ 'খুবই সুযোগসন্ধানী' ধরনের। 'তুরস্ক যেন এনিয়ে আমাদের শঙ্কার বিষয়টিতেও মনোযোগ দেয়, আমরা সে চেষ্টাই করছি'।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বারংবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, যেসব দেশ রাশিয়াকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে বাণিজ্য করতে সহায়তা করবে–তাদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দফায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।
এমনকী এই নিষেধাজ্ঞা মার্কিন সরকারের আইনি অধিকার বহির্ভূত হলেও তাতে পিছু হটবে না ওয়াশিংটন। এই পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে ততোটা মুখ খোলেনি ইইউ। কিন্তু, ২৭ দেশের ইউরোপীয় ব্লকটিও মার্কিন সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করতে পারে।
গত জুনে তুরস্ক সফরে যান যুক্তরাষ্ট্রের উপ–অর্থমন্ত্রী (ডেপুটি ট্রেজারি সেক্রেটারি) ওয়ালি অ্যাডেইমো। এসময় তিনি তুর্কি সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যাংকারদের সাথে বৈঠক করেন। তুরস্ক যেন রাশিয়ার অর্থ নিরাপদে বিনিময় মাধ্যম না হয়ে ওঠে, এনিয়ে সতর্ক করেন তিনি।
জ্যেষ্ঠ আরেকজন পশ্চিমা কর্মকর্তা ইঙ্গিত দেন, আঙ্কারা সীমা অতিক্রম করলে পশ্চিমা কোম্পানি ও ব্যাংকগুলিকে তুরস্ক ছেড়ে চলে আসার আহ্বান জানাতে পারে পশ্চিমা দেশগুলি। বিশেষ করে, শুক্রবার এরদোয়ান পুতিনকে যেসব সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- তিনি তার বাস্তবায়ন করলে এমনটা করা হতে পারে।
ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশের প্রতি পশ্চিমাদের এমন হুমকি নজিরবিহীন। এতে ৮০ হাজার কোটি ডলারের তুর্কি অর্থনীতিতে ধস নামতে পারে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেসব দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে– তারা পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকে তুরস্কের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করার নির্দেশও দিতে পারে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাথে আলাপকালে অন্য পশ্চিমা কর্মকর্তারা এই ইঙ্গিতকে নাকচ করে দেন। এই উপায় আইনি ও ব্যবহারিক দুই দিক থেকেই সমস্যার সৃষ্টি করবে বলে মনে করেন তারা।
পশ্চিমা আর্থিক খাতের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত তুরস্ক। কোকাকোলা থেকে শুরু করে ফোর্ড, বশ ও বিপির মতো কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে সেখানে ব্যবসা করে উচ্চ মুনাফা অর্জন করছে।
ইউরোপীয় এক কর্মকর্তা তাই মনে করেন, 'তুরস্কে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকায়– তারা এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করতে পারে'।
কিন্তু, 'আঙ্কারা মস্কোর আরও ঘনিষ্ঠ হলে- নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনাকে তখন উড়িয়ে দেওয়া যাবে না'- মন্তব্য করেন তিনি।
ইইউ জোটে নানান বিষয়ে বিভাজন রয়েছে; তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তা ঘটতে পারে। ইইউ একক সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে–তখন যেসব সদস্য দেশ তুরস্ককে শাস্তি দেওয়ার পক্ষে তারা পৃথকভাবে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। 'যেমন তারা আর্থিক খাতের বড় কোম্পানিগুলোর প্রতি তুর্কি কোম্পানিতে অর্থায়ন সীমিত করার নির্দেশ দিতে পারে'।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপর তিন কর্মকর্তা জানান, ব্রাসেলসে এখনও আঙ্কারার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। কারণ, সোচিতে পুতিন ও এরদোয়ানের মধ্যে বৈঠকের খুঁটিনাটি দিক এখনও জানতে পারেননি তারা। বিস্তারিত জানার পরই ইইউ বিধিনিষেধ নিয়ে আলোচনা করা হবে কিনা- সে সিদ্ধান্ত নেবে।
গত ফ্রেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আগ্রাসনের পর থেকেই মস্কো ও কিয়েভ উভয়ের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন এরদোয়ান। শুক্রবার এরদোয়ান ও পুতিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক ও জ্বালানি খাতে সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে চার ঘণ্টার বেশি সময় আলোচনা করেছেন। এর একদিন পরই ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলির কর্মকর্তারা তুরস্ককে সতর্ক করলেন।
জ্বালানি খাত নিয়ন্ত্রণে রাশিয়ার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সান্ডার নোভাক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাশিয়ার গ্যাস কিনতে রুবলে মূল্য পরিশোধে রাজি হয়েছে তুরস্ক। ব্যাংকিং খাতে সহযোগিতা তৈরি করাসহ, রুবল ও লিরার ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বিল পরিশোধ নিয়েও আলোচনা করেছেন পুতিন আর এরদোয়ান।
রাশিয়া থেকে ফেরার সময় এরদোয়ান সাংবাদিকদের বলেছেন, রাশিয়ার সাথে এমআইআর পেমেন্ট কার্ড নিয়ে 'অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে'। রাশিয়াতে ভিসা ও মাস্টারকার্ড এর সেবা বন্ধ থাকায়- বিকল্প এই কার্ডের মাধ্যমে তুর্কি ব্যবসায়ীরা সেদেশে গিয়ে লিরায় মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। আবার রাশিয়ার পর্যটকরাও তুরস্কে এসে রুবলে মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা ভয় পাচ্ছেন, এর মাধ্যমে রাশিয়ানরা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর সুযোগ পাবে।
বিগত কয়েক বছর ধরেই তুরস্কের সাথে পশ্চিমা দুনিয়ার সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। এর আগে ২০২০ সালে রাশিয়া থেকে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনায় আঙ্কারার ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞাও দেয় ওয়াশিংটন। তবে এসব বিধিনিষেধের কবলে পড়েছিল কেবল তুরস্কের প্রতিরক্ষা খাত; দেশটির বৃহত্তর অর্থনীতিকে এর লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে ন্যাটোতে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সদস্যপদ লাভে ভেটো দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন এরদোয়ান। এতে পশ্চিমা অনেক দেশ তুরস্ককে একটি অনির্ভরযোগ্য মিত্র বলে ভাবতে শুরু করেছে।
তারপরও, তুরস্ক হলো শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলা এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ইউরোপের অপরিহার্য সহযোগী। ২০১৬ সালে ইইউ এর সাথে এক চুক্তির আওতায় নিজ দেশে ৩৭ লাখের বেশি সিরিয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে তুরস্ক। নাহলে শরণার্থী ঢলে ইউরোপকে আরও ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হতো।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তুরস্কের কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থানের গুরুত্বও বেড়েছে ন্যাটোর কাছে। কারণ দেশটি কৃষ্ণসাগর ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে সংযোগস্থল বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীতে জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে।
সম্প্রতি এরদোয়ানের কূটনীতিক প্রচেষ্টাতেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শস্য রপ্তানির একটি চুক্তি হয়েছে। এর মাধ্যমে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট এড়ানোর লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
- সূত্র: ফিন্যান্সিয়াল টাইমস