দেশীয় প্রযুক্তিতে ডেমু ট্রেন মেরামতে সাফল্য, হবে বিপুল অর্থ সাশ্রয়

এবার দেশীয় প্রযুক্তিতে ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট বা ডেমু ট্রেনের সফল ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। দেশের প্রকৌশলীরা চীনা প্রযুক্তির বদলে দেশীয় প্রযুক্তিতে এ সাফল্য পেয়েছেন। এতে করে চীনের প্রযুক্তিতে যেখানে খরচ হতো ৬০০ কোটি টাকা, সেখানে মাত্র ১০০ কোটি টাকাতেই সচল করা যাবে এ ধরনের ২০টি ট্রেন।
রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) তৃতীয়বারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে লোডসহ একটি ডেমু ট্রেন- পার্বতীপুর থেকে পঞ্চগড় রেলপথে চালানো হয়েছে। গতি ছিল ঘন্টায় ৭২ কিলোমিটার। রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা পেলে যেকোনো দিন আনুষ্ঠানিকভাবে রেল বহরে যুক্ত হবে ডেমু ট্রেনটি।
রেলওয়ে বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চীন থেকে ২০১৩ সালে ৬৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০টি ডেমু ট্রেন আনা হয়। এগুলি পরিচালিত হতো, এক ধরনের বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে। এসব ট্রেন ২০ বছর মেয়াদ ধরা হলেও, আমদানির মাত্র ৪-৫ বছরের মধ্যেই একের পর এক বিকল হতে থাকে। ৯ বছরের মধ্যেই ২০টি ডেমু ট্রেনই বিকল হয়ে পড়ে।
চীনের তানশাং ইন্টারন্যাশনাল ও ডানিয়াল টেকনিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউড ডেমু ট্রেনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য ট্রেনগুলি আমদানি করা হয়। এর দু'দিকে দুটি ইঞ্জিন ও মাঝখানে বসার আসনে ৩শ যাত্রীর আসন রয়েছে।
ডেমু ট্রেনের বিশেষ সফটওয়্যারের বিষয়ে চীনা কোম্পানি বিশেষ গোপনীয়তা অবলম্বন করে। ট্রেন হস্তান্তর করা হলেও, এই সফটওয়্যার তারা হস্তান্তর করেনি বা এ সম্পর্কে দেশীয় প্রকৌশলীদেরও জানায়নি।
প্রতিটি ট্রেনে আছে ৪০টি মডিউল, এসব মডিউলের সঙ্গে সফটওয়্যার সেটআপ দেয়া রয়েছে। কোনও মডিটউল বিকল হলে, সেটি পরিবর্তনের সময় সফটওয়্যারও সেটআপ দেয়া হয়। যার প্রতিটির দাম প্রায় ৭ লাখ টাকা। এসব সফটওয়্যার সেটআপ দিত চীনা প্রকৌশলীরা। ফলে সফটওয়্যার কেনার পাশাপাশি তাদের পারিশ্রমিকও দিতে হতো।
কিন্তু, ট্রেনগুলো বিকল হতে শুরু করলে, নতুন নতুন মডিউল স্থাপন ও সফটওয়্যার সেটআপ খরচ দিতে গিয়ে হিমশিম অবস্থায় পড়ে রেলওয়ে বিভাগ। এরপর বিকল হওয়া ডেমু ট্রেনগুলি মেরামত করা হয়নি দীর্ঘদিনেও।
এরইমধ্যে, বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মঞ্জুর-উল-আলম ট্রেনগুলোকে সচল করতে দেশীয় প্রকৌশলীদের শরণাপন্ন হন। এগিয়ে আসেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক শিক্ষার্থী ও আনবিক শক্তি কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান।
তিনি গবেষণা করেন ডেমু ট্রেন নিয়ে । দেড় বছরের চেষ্টায় মাত্র ৭২ দিন কাজ করে চীনা প্রযুক্তি সরিয়ে ফেলে, দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি ডেমু ট্রেন সচলও করেন। আসাদুজ্জামানকে সহযোগিতা করেন, প্রকৌশলী আজিম বিশ্বাস-সহ পার্বতীপুর ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বলেন, 'করোনাকালীন সময়ে ট্রেন মেরামতের কাজ শুরু করা হয়। ওই সময়ে, নানান ধরনের যন্ত্রাংশ আমদানি করতে কিছুটা দেরি হয়েছে। এই কাজটি সম্পন্ন করতে আমাদের দেড় বছর সময় লেগেছে। তবে আমরা কাজ করেছি মাত্র ৭২ দিন। এখন আমরা যে পর্যায়ে আছি, তাতে আমরা সফল'।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার ট্রায়াল হয়েছে তাতে করে লোড, গতি, পরিচালনা সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। আমাদের হিসাব অনুযায়ী, চীনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০টি ডেমু সচল করতে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার প্রয়োজন, আর দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে খরচ পড়বে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এই টাকা বরাদ্দ পেলে আগামী ৩ মাসের মধ্যেই ২০টি ডেমু ট্রেন সচল করা সম্ভব।
ডেমু ট্রেনের লোকো মাষ্টার মশিউর রহমান ও সহকারী লোকো মাষ্টার নুরুজ্জামান বলেন, দেশীয় প্রযুক্তিতে ট্রেনটি মেরামত করায়, চালাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ট্রেনের প্রয়োজনীয় গতি ঠিক আছে, যা ঘন্টায় প্রায় ৭২ কিলোমিটার।
পার্বতীপুর লোকোমোটিভ ইয়ার্ডের ইনচার্জ কাফী-উল-ইসলাম বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানেই ডেমু ট্রেন রয়েছে। অকেজো অবস্থায় পার্বতীপুরের লোকোশেডে ২টি ডেমু ট্রেন রয়েছে। গত বছরের ২৪ মার্চ মেরামতের জন্য ট্রেন দুটিকে ডিজেল লোকো ওয়ার্কশপে হস্তান্তর করা হয়। দেশের প্রকৌশলীরা গত বছরের ২ এপ্রিল থেকে একটি ট্রেন সচল করার কাজ শুরু করেন। মেরামত চলাকালেই ২৯বার ডেমু ট্রেনটির ট্রায়াল দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে যাত্রী লোড ছাড়া ২৭ বার ও যাত্রী নিয়ে দুইবার পঞ্চগড় ও লালমনিরহাট রুটে চালানো হয়েছে।
রেলওয়ের প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, 'প্রায় এক বছর ধরে আমরা সহজ প্রক্রিয়ায় এটি চালুর চেষ্টা করেছি। এখন আমরা মোটামুটি সফল। ট্রায়ালও সফল হয়েছে। অবশ্য আগামী ৪-৫ মাস পর্যবেক্ষণ করার পরই আমাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। এরপর সবকটি ডেমু ট্রেনকেও এই প্রক্রিয়ায় ঠিক করা হবে। চীনের প্রযুক্তি জটিল ছিল, সেটি সহজ করতে এই প্রক্রিয়া।'