ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোর ভূমিকা শুধু আমেরিকাকে লাভবান করছে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের ওপর পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে তার অধীনস্ত করার যে পরিকল্পনা নেয়- তার অংশ হিসেবেই প্রথমেই সে ১৯৪৪ সালে মার্কিন মুদ্রাকে পৃথিবীর প্রধান বাণিজ্যিক মুদ্রার স্বীকৃতি নিয়ে নেয়।
এরপর ১৯৪৯ সালে গঠন করে ন্যাটো। যখন ন্যাটো গঠিত হয় তখন সামরিক জোটটির সদস্যভুক্ত হয় মোট ১২টি দেশ। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে তৈরি হয় ন্যাটোর হেডকোয়ার্টার। এ জোটের জন্মের পর থেকে বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া বহু ঘটনায় ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর ভেতরে প্রতিবাদ হয়েছে। যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধে হয়েছে, আবার পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোয় সামরিক আগ্রাসন নিয়েও হয়েছে প্রতিবাদ।
গত সোমবার (২০ জুন) দীর্ঘ ৭৩ বছরের মধ্যে সর্বপ্রথম ন্যাটোর বিলুপতি চেয়ে এর সদর দপ্তরের সামনে ব্রাসেলস লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ ঘটেছে। বিবিসির তথ্যমতে তা ৮০ হাজার, সংগঠকদের দাবি লক্ষাধিক আর পুলিশের ভাষ্য ৭০ হাজার। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা যাই হোক না কেন- বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে এ ধরনের সমাবেশ সম্ভবত এই প্রথম- যেখানে ন্যাটো বিলুপ্তির দাবি করা হয়েছে।
এই দাবি মূলত উঠেছে কারণ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো মার্কিন কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারছে না। তাছাড়া, অর্থনৈতিকভাবে তারা অনেক আগে থেকেই মার্কিন ব্যবস্থার সঙ্গে যোগ না দিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছে। ইউরোপিয় ইউনিয়ন তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক মুদ্রা ব্যবস্থা চালুও করেছিল। ফলে মার্কিনীরা পৃথিবীর অন্য ভূখণ্ডেসমূহ যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রে সেই সক্ষমতা ততটা নয়।
ন্যাটোর জন্ম হয়েছিল- মার্কিন কতৃত্বে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সাথে সামরিক চুক্তির ভিত্তিতে। মূলত পশ্চিমা আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্যই ন্যাটো গঠন। গত ৭৩ বছর ধরে জোটটি তাই করে যাচ্ছে। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোকে ধ্বংস করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এই জোট। এখন যুদ্ধকে ইউরোপের সীমানায় নিয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ঘটেছে এসব ইউরোপীয় দেশে। বেলজিয়ামে ৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি চলছে। বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই এই মূল্যস্ফীতি হানা দিয়েছে। এ বাস্তবতায় ধনী রাষ্ট্রসমূহ তাদের নিজ দেশের অর্থনীতিকে হয়তো সামাল দিবে নানানভাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে সুদের হার বাড়িয়েছে একলাফে পয়েন্ট ৭৫ শতাংশ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও একই অবস্থা। কিন্তু এর শেষ কোথায় হবে?
যে দেশকে কেন্দ্র করে বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত অর্থাৎ রাশিয়ার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে কোনও আলোচনা পশ্চিমা বিশ্বের কোথাও তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। রাশিয়ানরা নিজেদের দেশে মুদ্রাস্ফীতি তেমন ঘটেনি বলেই দাবি করছে। তবে সত্য হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে। তবে তা নিয়ন্ত্রিত পর্যায় আছে।
ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর বর্তমান জনসংখ্যা বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ আর ভূখন্ড হচ্ছে সাড়ে ১৬ শতাংশ। এই সাড়ে ১২ শতাংশ জনসংখ্যার দেশগুলি পৃথিবীর সিংহভাগ সামরিক, অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারী। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের তারা যেকোনো মুহূর্তে তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারে। যেমনটি তারা করেছে আফগানিস্তান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং বর্তমানের পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে। কিন্তু এবারের বিষয়টা একটু অন্য রকম হয়েছে।
ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর প্রধান অংশ ইউরোপে অবস্থান করে। সে দেশগুলোর সীমানায় এবার যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ চলছে দুটো ন্যাটো বহির্ভূত দেশের মধ্যে। যার একটি ইউক্রেন অপরটি রাশিয়া। ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য ন্যাটো দীর্ঘদিন যাবত ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সমর্থন যুগিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। পরিণতিতে বর্তমান যুদ্ধ। ইউক্রেনের একজন কৌতুক অভিনেতা রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর দ্রুততার সাথে ন্যাটো নির্ধারিত পথে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। যে যুদ্ধে ন্যাটো সেনাবাহিনী সক্রিয় কোন অংশগ্রহণ না করলেও অস্ত্র জোগানের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের হতাহতকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যেই সীমিত রেখেছে।
ন্যাটো ব্যর্থ হয়েছে কোভিড -উত্তর পৃথিবীতে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখতে। ফলে পৃথিবীর নানান দেশে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে কিংবা পণ্য বহনের পরিবহনের প্রতিবন্ধকতায় নানান দেশে পণ্যমূল্য বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। দীর্ঘকাল যাবত তেল উৎপাদনকারী দেশ- ইরান, ভেনিজুয়েলা ও রাশিয়ার উপর নানান বিতর্কিত নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখে ২০১৭ সালে বাজারকে আকাশচুম্বী করা হয়। ইরান বাদে বাদবাকি ওপেকভুক্ত দেশগুলো উৎপাদন সীমিত করে বিশ্বের তাবৎ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জিম্মি বানিয়ে তেলের দামকে আকাশে তুলেছে।
পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার যাদের তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মালিকানার ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশ- জড়িত তাদের তেলের মূল্য আকাশচুম্বী করে বিশ্বের বাদবাকি দেশগুলোকে দারিদ্রের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তেল বিক্রির এই অর্থ ঘুরে ফিরে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পকেটস্থ হচ্ছে অস্ত্র বাণিজ্যের মাধ্যমে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধেও তেলের ওপর নানান নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মূলত লাভবান হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর পশ্চিম এশিয়ার কিছু দেশ। এর বাইরের দেশগুলো দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার মধ্যে আমরাও আছি।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চীন তার নিজস্ব সক্ষমতায় রাশিয়া ও ইরান থেকে তেল কিনে কিছুটা সংকট সমাধান করছে । কিন্তু পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে ন্যাটোর ভূখণ্ডে যে পরিমাণ মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়েছে তার পরিণাম হবে একটি অবশ্যম্ভাবী 'স্ট্যাগফ্লেশন'। যা দীর্ঘকাল ধরে চলবে এবং ফলশ্রুতিতে দরিদ্র দেশগুলো আরো দরিদ্র হবে। এমনি একটি সময় আমাদের দেশটি মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য যে লড়াই করে যাচ্ছে- তার পরিণতি কী হবে তা এখনও অস্পষ্ট। তবে বেলজিয়ামে গতকালের ওই প্রতিবাদ মিছিল ব্রাসেলসের ন্যাটো সদর দপ্তরে কতটুকু ভূমিকা রাখবে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে তা আগামীতে তা বোঝা যাবে।
স্ট্যাগফ্লেশন (উচ্চ হারের মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও মন্থর জিডিপি প্রবৃদ্ধি) শুরু হওয়ার যে বার্তা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে তা থেকে রক্ষা পেতে হলে এই মুহূর্তে করণীয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া। বিশ্বকে একটি স্বাভাবিক পণ্য বিনিময় ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই নতুন বছরে কতটুকু করতে হবে তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। তবে পৃথিবীর নানান দেশে যেভাবে সংক্রমণের হার আবার বাড়তে দেখা যাচ্ছে তা হয়তো আবার আতঙ্কের কারণ হবে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক