নির্বাচন কমিশন কি স্থানীয় সংসদ সদস্যকে এলাকা ত্যাগ করার নির্দেশ দিতে পারে?

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় নিয়ে ভারতীয় আইনমন্ত্রীর উচ্চারিত লক্ষণরেখার গল্পটি এখন নানান ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে নানা জায়গায়। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন যখন লড়াইয়ে ব্যস্ত তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে, তখন এই বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। দেশের কয়েকটি অঞ্চলের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যা ঘটছে তা নির্বাচন কমিশনের যোগ্যতা নিয়ে যে বিতর্ক বহু বছর যাবত সৃষ্টি হয়ে আছে সেই বিতর্ক থেকে নির্বাচন কমিশন বেরোতে পারবে কি না সেই প্রশ্ন আবার প্রবলভাবে সামনে চলে এসেছে।
ঝিনাইদহ ও কুমিল্লার মেয়র নির্বাচন নিয়ে চলছে নির্বাচন কমিশনের এই সংগ্রাম। নির্বাচন কমিশনের নানান ঘটনাপ্রবাহ দেশের মানুষের কাছে আরো বেশি আস্থাহীনতার সৃষ্টি করছে। নির্বাচন কমিশন গঠনের পরে নির্বাচন কমিশনাররা বিভিন্নভাবে জনসম্মুখে তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য নানান বক্তব্য দিয়েছেন। প্রতিদিনই গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেছেন। এবং তাদের সেসব বক্তব্যে সেই ১০ কোটি ডলারের ঘোষণা থেকে শুরু করে আরো নানান বিষয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এরপরেও নির্বাচন কমিশন চেষ্টা করে যাচ্ছিল বেশ কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার। কিন্তু সেই লক্ষণরেখার বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। কুমিল্লার নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে এলাকা ত্যাগ করার নির্দেশ দিলে সে আদেশ পালনে অস্বীকার করেন। তিনি নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ঝিনাইদহের মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আগামী বুধবার নির্বাচন নির্ধারিত ছিল। আচরণ বিধি ভঙ্গ করায় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর উপর আক্রমণ করায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নৌকা প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করার ফলে সেই নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আসামাত্রই উচ্চ আদালত কর্তৃক সেই নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ দুটি ঘটনায় নির্বাচন কমিশন সক্ষমতা প্রমাণে ব্যর্থ হলো।
কুমিল্লার ঘটনাটিতে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে এলাকা ত্যাগ করার নির্দেশ প্রদান করার পরে সেই নির্দেশ কার্যকরী না হওয়ার ফলে নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষমতার অক্ষমতা হিসেবেই তুলে ধরেন। তারা বলেন যে আমাদের আর কিছু করার নাই। নির্বাচন কমিশন নিয়ে দীর্ঘদিন চলতে থাকা নানান কথাবার্তা প্রমাণ করে যে, আসলে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের তেমন কোনো আইনি সক্ষমতা নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকারের সদিচ্ছা এবং বিরোধী দলসমূহের মধ্যে এ বিষয়ে আস্থা সৃষ্টি না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনই এই আইনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ করা সম্ভব হবে না। তবে কুমিল্লার সংসদ সদস্য দেশে এক নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। তিনি নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন। আসলেই কি নির্বাচন কমিশনের তেমন কোনো ক্ষমতা আছে যে, কাউকে স্থান থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার অধিকার রাখেন?
অতীতের বেশ কয়েকটি উদাহরণ আছে যা পূর্ববর্তী নির্বাচন কমিশনের কোনো কোনো সদস্য উল্লেখ করেছেন যে, এই ধরনের নির্দেশ পালিত হয়েছে। পালিত হওয়াই যথেষ্ট নয়। তার আইনিভিত্তি আছে কিনা সেটিই প্রয়োজনীয়। আজকে যে সংসদ সদস্য আদেশ মানতে অস্বীকার করছেন তিনি কি কোনো আইন ভঙ্গ করছেন? সে বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে। নির্বাচন কমিশন প্রকারান্তে স্বীকার করে নিয়েছে তাদের কাছে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই, তাই অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে যে, এক্ষেত্রে তাদের কিছু করার নেই। এখন প্রশ্ন হতে পারে, ক্ষমতা না থাকলে কেন ঘোষণা করার মাধ্যমে তারা এ ধরনের নির্দেশ প্রদান করতে গেল? তাদের যদি আইনি সক্ষমতা না দেওয়া হয়ে থাকে কিংবা অতীতে যখন এ ধরনের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, তা কীভাবে কার্যকর করা হয়েছে? এ সম্পর্কে সরকার অথবা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আসা উচিত যে, আসলে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা কতটুকু।
সাম্প্রতিককালের বেশ কয়েকজন প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার বিভিন্ন বিষয়ে মত দিচ্ছেন: এর মধ্যে সদ্য বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনারও আছেন। বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচনের অপরিহার্য শর্তগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে নির্বাহী বিভাগমুক্ত সামগ্রিক একটি নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা যায় অথবা নির্বাচন কমিশন নির্বাহী বিভাগকে ও পুলিশি ব্যবস্থাকে নির্বাচনকালীন সময়ে সম্পূর্ণ যেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেন নির্বাচন কমিশন চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় ঘটানোর জন্য দায়ী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে পারেন। এমন সব মৌলিক বিষয়গুলো নিষ্পত্তি হওয়া সম্ভব কেবলমাত্র দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে। তা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা আদৌ সম্ভব কি না, আমাদের দেশে সেটি এখন বড় প্রশ্ন।