রাশিয়া অর্থনৈতিক যুদ্ধে জয়ী - এবং পুতিনের সৈন্য প্রত্যাহারের পশ্চিমা আশা সুদূরপরাহত

রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার তিন মাস হয়ে গেল, তবে এখনো পশ্চিমাদের পরিকল্পনামাফিক কিছুই হচ্ছে না, বরঞ্চ অবস্থা আরও সঙ্গিন হচ্ছে।
পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞাকে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে পুতিনের ওপর তা আরোপ ব্যাপারটা এমন নয়। বরং হাতে থাকা অন্য দুটি পথ; কিছু না করা বা সামরিকভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জড়ানোর চেয়ে এটিই সবচেয়ে উপযুক্ত পথ খোলা ছিল তাদের সামনে।
ইউক্রেনে আক্রমণ চালানোর পরপরই প্রথম ধাপের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় রাশিয়াকে। তখন ভাবা হয়েছিল ইউক্রেন অল্পকিছুদিনের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু তা হয়নি, বরং নিষেধাজ্ঞা আরও কড়া করা হয়েছে।
ইউক্রেনে আক্রমণ বন্ধ করে রাশিয়া ঘরে ফিরে যাবে, এমন কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য এতে বিশেষ আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের রপ্তানিমূল্য বেড়ে গেছে। এতে করে রাশিয়ার আয় বেড়েছে, যুদ্ধের খরচ সহনীয় পর্যায়ে থেকেছে।
২০২২ সালের প্রথম চার মাসে রাশিয়ার ৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের উদ্বৃত্ত তৈরি হয়েছে যা ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় তিনগুণ।
এর আগে গত সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ান তেলরপ্তানির ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ফলে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে গিয়েছে। এতে লাভ হয়েছে ক্রেমলিনের। নিজেদের জ্বালানির জন্য বিকল্প বাজার খুঁজে পেতে রাশিয়ার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। গত বছরের তুলনায় চীনের কাছে ৫০ শতাংশ বেশি তেল ও গ্যাস রপ্তানি করেছে রাশিয়া।
তবে তার মানে এ নয় যে নিষেধাজ্ঞার আঁচড় রাশিয়ার গায়ে একটুও লাগেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর তথ্যমতে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে আমদানি ভেঙে পড়ায় রাশিয়ার অর্থনীতি এ বছর ৮.৫ শতাংশ কমে যাবে। নিজেদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে রাশিয়ার অনেক পণ্যের বড় মজুত রয়েছে, কিন্তু একটা সময়ে সেগুলোর পুরোটা ব্যবহার করে ফেলতে হবে।
ইউরোপের রাশিয়া-নির্ভরশীলতা কমাতে কিছুটা সময় লাগছে, সেজন্য হঠাৎ বড় ধরনের অর্থনৈতিক ধাক্কা থেকে বেঁচে গিয়েছেন পুতিন। পুঁজির নিয়ন্ত্রণ ও শক্তিশালী বাণিজ্য উদ্বৃত্তের কারণে রুবল এখন শক্তিশালী। যেসব যন্ত্রাংশ পশ্চিমাদেশগুলো থেকে আমদানি করত রাশিয়া, সেগুলোর বিকল্প বাজার খোঁজার জন্য সময় রয়েছে ক্রেমলিনের হাতে।
ডাভোসে গত সপ্তাহে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম-এর বার্ষিক সভায় বিশ্বনেতারা পৃথিবীবাসীকে যে বার্তা দিয়েছিলেন, তা ছিল রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ইউক্রেনের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এ নেতারা দীর্ঘকালীন যুদ্ধের অর্থনৈতিক মূল্য নিয়ে নিজেদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন।
এ উদ্বিগ্নতা পুরোপুরি সমর্থনযোগ্য। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের কারণে পণ্যের দামের ওপর আরও বেশি চাপ পড়েছে। যুক্তরাজ্যের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার এখন ৯ শতাংশ, গত ৪০ বছরে যা দেশটির সর্বোচ্চ। পেট্রলের দাম রেকর্ডহারে বেড়েছে। অক্টোবরে (যুক্তরাজ্যে) জ্বালানির দাম বছরপ্রতি ৭০০ থেকে ৮০০ পাউন্ডে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে।
গত চার মাসে এ নিয়ে তিনবারের মতো সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী রিশি সুনক। এ বছরের শেষদিকে জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ সামলানোয় ব্রিটিশ নাগরিকদের সহায়তা করতে আরও সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণার কথা রয়েছে।
যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা অর্থনীতি ধীর বা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতিবৃদ্ধির একটি দশা পার করছে। এটি অনেকটা ১৯৭০-এর দশকের স্থবিরতার মতোই মনে হচ্ছে। ব্যাংক অভ ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মনে করছে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানতে তাদেরকে সুদহার বৃদ্ধি করতে হবে। বেকারত্বও বাড়বে খুব শীঘ্রই। রাশিয়ান গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল থাকায় অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোকেও একই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
এ যুদ্ধের কারণে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো যে সমস্যা ভোগ করছে তার ব্যাপকতা অন্য মাত্রার। তাদের অনেকের জন্য অর্থনৈতিক স্থবিরতার চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে দুর্ভিক্ষ। এর পেছনের কারণ হচ্ছে ইউক্রেনের ব্ল্যাক সি বন্দর থেকে গম রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম-এর নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলি বলেন, 'এ মুহূর্তে ইউক্রেনের গোলাগুলোতে খাদ্যশস্য উপচে পড়েছে। অন্যদিকে বিশ্বের চার কোটি চার লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দিকে এগোচ্ছেন।'
আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন, জাতিসংঘ- বিশ্বের প্রতিটি বহুজাতিক সংস্থার ভেতরে এখন একটি সম্ভাব্য মানবিক সংকটের আশঙ্কা ঘিরে ধরেছে। এখানে হিসেবটা সাধারণ: যতক্ষণ পর্যন্ত উন্নত দেশগুলো নিজেরা এনার্জি রপ্তানিকারক হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে না, ততক্ষণ তাদেরকে তিনদিক থেকে ধাক্কা সামলাতে হবে। এ ত্রিমুখী ধাক্কায় জ্বালানি ও খাদ্যসংকটের কারণে অর্থনৈতিক সংকট জোরালো হবে।
নিজেদের জনগণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বনাম আন্তর্জাতিক দেনাদারদের অর্থ পরিশোধ করার বিকল্পের ক্ষেত্রে বিশ্বের দেশগুলো দ্বিতীয়টিই বেছে নেবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর প্রথম দেশ হিসেবে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে শ্রীলঙ্কা। তবে এটিই যে শেষ কোনো দেশ হতে যাচ্ছে তার সম্ভাবনা খুব কম। ১৯৯০-এর পর আবারও বিশ্ব আরেকটি তীব্র দেনাসংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
খাদ্যকে 'অস্ত্রীকরণ'-এর দায়ে পুতিনের সমালোচনা খুবই সঠিক, তবে তার এ প্রচেষ্টাকে অবাক চোখে দেখার কোনো উপায় নেই। শুরু থেকেই লম্বা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন পুতিন, তার বিরুদ্ধে থাকা আন্তর্জাতিক জোট ভেঙে টুকরো হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।
নিষেধাজ্ঞা যে কাজ করছে না তার প্রমাণ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইউক্রেনকে অ্যাডভান্সড রকেট সিস্টেম সরবরাহের ঘোষণা। এখন আশা হচ্ছে জ্বালানি নিষেধাজ্ঞা ও রাশিয়ানদের সম্পদ জব্দ যে কাজটি করতে পারেনি, পশ্চিমাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র তা করতে সক্ষম হবে। আর সেই কাজটি হচ্ছে: ইউক্রেন থেকে সেনা সরিয়ে নিতে পুতিনকে বাধ্য করা।
যুদ্ধক্ষেত্রে পুতিনের সম্পূর্ণ পরাজয় এ পরিস্থিতির সমাপ্তি ঘটাতে পারে, কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় তা ঘটবে না বলেই মনে হচ্ছে। এছাড়া আরও কিছু সম্ভাব্য পরিণতি অবশ্য রয়েছে। একটি হতে পারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শেষ পর্যন্ত রাশিয়াকে বাধ্য করবে পিছু হটতে। অন্য সম্ভাবনাটি হচ্ছে আলাপআলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছানো।
নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ পুতিন করবে না, এবং অর্থনৈতিক-যুদ্ধের উলুখাগড়া হবে অন্যরা- উন্নত দেশগুলোতে জীবনযাত্রার মান কমে যাবে; উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্ভিক্ষ, ফুড রায়ট, দেনাসংকট ইত্যাদি দেখা যাবে।
রাশিয়ান বাহিনীর নৃশংসতার কারণে ক্রেমলিনের সাথে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো আপাতত অসম্ভব বলে মনে হতে পারে, কিন্তু অর্থনৈতিক বাস্তবতা বলছে: আগে হোক বা পরে, চুক্তি একটা হবেই দুপক্ষের মধ্যে।
ল্যারি এলিয়ট দ্য গার্ডিয়ান-এর অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক।
ইংরেজি থেকে অনূদিত।