একটি অভূতপূর্ব সামুদ্রিক উদ্ধার-অভিযানের গল্প
সম্প্রতি বাংলাদেশের জাহাজ-দুনিয়ায় একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছে। এ-মাসের গোড়ার দিকে তৈরি-পোশাকভর্তি ১১০০ কন্টেইনারসহ একটি বিশালাকার ভিয়েতনামি জাহাজ এম. ভি. হায়ান সিটি, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে ছেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বেশিদূর না যেতেই কুতুবদিয়া চ্যানেলের মুখে আরেকটি তেলবাহী জাহাজের ধাক্কায় দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সেটির প্রায় ডুবে যাবার উপক্রম হয়।
২০০ কোটি টাকা দামের এই জাহাজটি যদি সত্যিই ডুবে যেত তাহলে এর সঙ্গে জাহাজের ভেতর বোঝাই করা আটশ কোটি টাকার পণ্যসমূহও আক্ষরিক অর্থেই জলে যেত সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়েও বড় ক্ষতি হতে পারত ১৭০ মিটার দীর্ঘ এত বড় একটি নিমজ্জিত জাহাজ ও তার ভেতর থেকে সমুদ্রে ছিটকে পড়া সহস্রাধিক ভাসন্ত কন্টেইনারের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশপথটুকু রুদ্ধ হয়ে গেলে।
কিন্তু কার্যত তেমনটি হতে পারেনি অভিজ্ঞ ও অসম সাহসী, কর্মঠ ও মেধাবী এক নৌপ্রকৌশলীর অবিশ্বাস্য প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, দূরদর্শিতা ও কর্মকুশলতার বদৌলতে। তাঁর নাম মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার, যিনি চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করে দীর্ঘ পনেরো বছর বিভিন্ন বিদেশি জাহাজের প্রকৌশলী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে।
তারপর ১৯৯৮ সালের জাহাজের প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে অবসর নিয়ে, নিজেই 'প্রান্তিক' নামে একটি সুখ্যাত নৌ-প্রকৌশল ও নৌযান উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং দেশ-বিদেশে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে বহু উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। এতটাই যে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারও তাঁকে 'আ পারসন অভ একস্ট্রা অর্ডিনারি এবিলিটি' শীর্ষক একটি পুরস্কারে ভূষিত করে।
দুর্ঘটনার এই খবর পেয়ে এবং বন্দর কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে তিনি অতি সম্প্রতি আফ্রিকা থেকে কেনা তাঁর সর্বাধুনিক ও শক্তিশালী উদ্ধারকারী জাহাজ 'প্রান্তিক সরওয়ার'সহ আরও সাতটি টানা-জাহাজ দিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত সেই সুবৃহৎ জাহাজটিকে চার ঘণ্টার মধ্যে টেনে চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে নিয়ে আসেন। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলে সর্বোচ্চ সাড়ে নয় মিটার ড্রাফট এর জাহাজ প্রবেশ করতে পারে, অথচ দুর্ঘটনা আক্রান্ত জাহাজটিতে পানি ঢুকে তার ওজন বেড়ে যাওয়াতে সেটির ড্রাফট হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১১ মিটার। ফলে জাহাজটিকে বন্দরের চ্যানেলে প্রবেশ করানোর জন্য তাঁকে এমনকি কর্ণফুলী মোহনার কিয়দংশকে নতুন করে ড্রেজিং পর্যন্ত করাতে হয়েছিল।
জাহাজটিকে কোনোমতে মেরিন একাডেমির কাছাকাছি একটি জায়গায় নোঙর করিয়ে এরপর তিনি জনা ত্রিশেক ডুবুরিকে দিয়ে জাহাজের তলদেশে প্রায় দেড়হাজার বর্গফুট আয়তনের একটি পুরু লোহার পাত জোড়া লাগিয়ে জাহাজের মূল ক্ষতস্থানটি ঢেকে দেয়ার উদ্যেগ নেন। এই ডুবুরিদলের সামগ্রিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন দেশের প্রবীণতম আন্ডারওয়াটার ডাইভার, একানব্বই বছর বয়সী মোঃ আবদুল হালিম।
এখানে উল্লেখ্য জনাব সরওয়ার নিজেও একজন দক্ষ ডাইভার এবং এই জলের তলার মেরামত যজ্ঞে অংশ নিতে তাঁকেও কয়েকবার জলে নামতে হয়েছিল। এর পাশাপাশি মূল জাহাজের দানবাকৃতি ক্রেনের মাধ্যমে তাঁরা জাহাজের খোলের ভেতর থেকে কন্টেইনারগুলোকেও দ্রুত বার করে আনার কাজও চলমান রেখেছেন।
কন্টেইনার সরানোর এই কাজ শেষ হলেই তাঁরা পাম্পের মাধ্যমে খোলের মধ্যকার জমা পানিটুকু সেঁচে, জাহাজর ভেতরদিক থেকে ওই ক্ষত বরাবর আরেকখানি লোহার পাত ওয়েল্ডিং করে লাগিয়ে দিলেই আশা করা যাচ্ছে জাহাজটি ফের চলাচলের উপযোগী হয়ে উঠবে। সন্দেহ নেই এটি বাংলাদেশের নৌ-প্রকৌশলের ইতিহাসে সত্যিকার অর্থেই একটি দৃষ্টান্তমূলক, প্রেরণাদায়ক এবং গর্ব করার মতো অর্জন হিসাবে চিহ্নিত হবে।
দিনদুয়েক আগে এই লেখকের সুযোগ হয়েছিল তাদের সেই অবিশ্বাস্য, রোমাঞ্চকর কর্মযজ্ঞখানি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার। আমার সেই দুর্লভ অভিজ্ঞতার আলোকেই এমন অভূতপূর্ব এক অর্জনের জন্য সর্বাগ্রে অভিনন্দন জানাই এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞের নায়ক, একাত্তরের এক বীর মুক্তিযোদ্ধাপুত্র, কর্মবীর জনাব গোলাম সরওয়ারকে। একইসঙ্গে অভিনন্দিত করছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশুনা শেষ করে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসা তাঁর দুই সুযোগ্য সন্তান, প্রান্ত ও বর্ষণকে, যারা সর্বক্ষণ তাদের পিতার পাশে থেকে এই কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তাঁকে মূল্যবান সহায়তা প্রদান করেছে।
এবং বলাইবাহুল্য এই কাজে নেপথ্য থেকে ওদের সবাইকে যিনি অনিঃশেষ অনুপ্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছেন সেই সরওয়ার-জায়া, যিনি নিজেও একজন প্রখ্যাত উদ্যোক্তা ও ফ্যাশন ডিজাইনার নাসরিন সরওয়ার মেঘলার জন্যেও রইল আমার আন্তরিক অভিনন্দন। অমরা বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও যথাযথ স্বীকৃতিটুকু পেলে এঁদের মতো উদ্যোগী, মেধাবী, পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের হাত ধরেই বাংলাদেশ ক্রমে এগিয়ে যাবে উন্নতি ও সমৃদ্ধির শিখরে।