আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ

ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্রের আগামী জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন ২০২৩ সালের অগাস্ট মাসে নির্ধারিত হয়ে আছে। ইমরান সরকারের পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের ফলে বন্ধ হয়ে যায় এবং নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে আগামী বছরেই সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
পাকিস্তানের সাংবিধানিক অবস্থান ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য দুইটি দেশ থেকে একটু ভিন্ন অবস্থানে আছে। কারণ হচ্ছে পাকিস্তান তাদের সংবিধানের বেশ কিছু সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে একক ক্ষমতার হাত থেকে পরিত্রাণ দিয়ে কিছুটা গণতান্ত্রিক করা হয়েছে; যেমন সেই দেশের বিচার বিভাগের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষের, অর্থাৎ পাকিস্তানের সিনেটের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য দুটি দেশ, বাংলাদেশ ও ভারত পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশে সরাসরি নির্বাহী বিভাগ এই মনোনয়ন দিয়ে থাকে। ভারতের অবস্থান বাংলাদেশ থেকে একটু ভিন্ন। যদিও ভারতীয় বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা হয়, তথাপি এ বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। বর্তমানে ভারতীয় বিচার বিভাগ বিজেপি মনোভাবাপন্ন, বিরোধী দলের অনেকেই এ কথা বলে থাকেন।
উপমহাদেশের এই তিনটি দেশের মধ্যে একমাত্র ভারতেই একবার ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি করে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে কতবার সাধারণ নির্বাচন স্থগিত অথবা অনুষ্ঠিত হয়নি, অথবা সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে—তার দীর্ঘ ইতিহাস আজকের আলোচ্য বিষয নয়। আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন। এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে এরইমধ্যে। বাংলাদেশের স্বীকৃত বিরোধী দল, যারা অতীতে একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে তারা বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট নয়। তারা তাদের মতের মতো একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। সেই ব্যবস্থাটি হচ্ছে, তাদের ভাষায়, বর্তমানে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত করে নির্বাচন করার দাবি।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে এই ধরনের কোনো ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সমঝোতা হলেই কেবল সেই ব্যবস্থা সৃষ্টি করা যেতে পারে। বাংলাদেশের বিগত দুটি নির্বাচন, ২০১৩ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে নানান বিতর্ক এবং নানান ঘটনা দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ওই দুটি নির্বাচন দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আগামী নির্বাচন কোন দিকে যাবে কিংবা কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে, তা এখনই পরিষ্কার নয়। তবে গণমাধ্যমের খবর: সরকারের পক্ষ থেকে দেশের মানুষের কাছে স্বীকৃত বিরোধীদল, প্রকৃত যে বিরোধী দল বিএনপিকে এই নির্বাচনে আনার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হবে। আমরা সরকারি দলের এই অবস্থানে আশাবাদী। দেশে আগামীতে সর্বদলীয় ভিত্তিতে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। কিন্তু আজ গণমাধ্যমের আরেকটি তথ্য নতুন বিতর্ক জন্ম দিল কি না তা-ও একটি প্রশ্ন! বলা হয়েছে আগামীতে জাতীয় নির্বাচন শতভাগ ইভিএম মেশিনে অনুষ্ঠিত হবে। ইতিমধ্যে ইভিএম মেশিন নিয়ে স্বীকৃত বিরোধীদল বিএনপি ভিন্ন মত প্রকাশ করেছে।
ভারতে যখন সাধারণ নির্বাচনে ইভিএম মেশিন সংযোজন করা হয়েছে তার আগে এই ইভিএম মেশিনের কার্যকরিতা, ইভিএম মেশিনেরর নিরপেক্ষতা নানানভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভারতে নির্বাচন কমিশন দেশব্যাপী জনগণকে ইভিএম মেশিনের নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা প্রমাণ করার নানান কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। বাংলাদেশে ইভিএম মেশিনের প্রাথমিক ব্যবহার ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে স্থানীয় নির্বাচনে। কোনো কোনো অঞ্চলে স্থানীয় নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমে করা হয়েছে। সরকার ও রাষ্ট্র যদি মনে করে আগামী নির্বাচন একটি সর্বজনীন নির্বাচন হবে এবং তার গ্রহণযোগ্যতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে অর্জন করতে হবে, তাহলে এখন থেকেই সেই রাজনৈতিক সমঝোতার রাস্তায় হাঁটতে হবে। বিরোধী দলকে তাদের নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিগুলো পালন করার সুযোগ সম্পূর্ণভাবে করে দিতে হব।
গত কয়েক বছর যাবত দেখা যাচ্ছে যে ওই স্বীকৃত বিরোধী দলের কর্মসূচিকে কখনো দলীয় কর্মীদের দ্বারা, কখনো স্থানীয় প্রশাসন দ্বারা বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। ফলে দেশে আগামী নির্বাচনে সর্বজনীন অংশগ্রহণের যে লক্ষ্য, তা বাস্তবায়ন হবে কি না সেটি প্রশ্নযোগ্য!
গণমাধ্যমে সরকারি দলের নেতা মন্ত্রীদের আরো বেশি সাবধান হতে হবে, আক্রমণাত্মক দেহভঙ্গি ও বাক্য ত্যাগ করতে হবে। সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রধান শর্তই হচ্ছে সামাজিকভাবে পরস্পরের কাছে দায়বদ্ধতা। বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক সম্পর্ক এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পরস্পরের মধ্যে বাক্যবিনিময় হয় কি না সন্দেহ।
অতীতকালে সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের মন্ত্রীদের সাথে বিরোধীদের এক ধরনের সামাজিক যোগাযোগ দেখা যেত। এখন তা একেবারেই বিলুপ্ত। এমনি একটি সামাজিক অবস্থানে দেশের সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে, তা প্রায় অসম্ভব।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে আগামী দিনের সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলার প্রধান দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেই দিক থেকে সংঘাতের পথ পরিহার করে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু আজকের সরকারপ্রধানের বক্তব্য আর অন্যদিকে মন্ত্রীদের বক্তব্যের মধ্যে একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়—সরকারপ্রধান যেখানে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন সেখানে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের কাউকে কাউকে এখনও তাচ্ছিল্যের সাথে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য আগামী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী যে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। ইতিমধ্যে আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা আমাদের পোশাক খাতের রপ্তানির জন্য পুরোপুরি পশ্চিমা দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। সে কারণে আমাদের আগামী নির্বাচন নিয়ে যেন কোনো প্রশ্নের সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।