‘মৌলিক কৃষিপণ্যে ট্যাক্স থাকা উচিৎ না’
মানুষের আচার-আচরণ, অভ্যাস কোন সাধারণ নিয়ম বা সূত্র মেনে চলে না। সূত্র মেনে চললে রোজার মাসে খাদ্যসামগ্রীর চাহিদা কম থাকার কথা। রোজা মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এবং সিয়াম বা সংযম সাধনের মাস। কিন্তু এ মাসেই সবধরনের খাদ্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বাজারে তার প্রভাব পড়ে এবং মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। মানুষের কোপানলে পড়েন ব্যবসায়ীরা। এরকম সময়ে বহুল উচ্চারিত শব্দ সিন্ডিকেট। বাজারে পণ্যের চাহিদা- যোগান, মূল্যবৃদ্ধি, অস্থিরতা, মানুষের নাভিশ্বাস।
খাদ্য কৃষিজাত পণ্য। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। চাল কোনো কোনো বছর উৎপাদনে উদ্বৃত্ত হয় বৈকি কিন্তু সেটা আমাদের কোন কাজে আসে না। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় বাড়তি অংশ রপ্তানি করে দিতে হয়। পরের বছর হয়ত রপ্তানির তুলনায় বেশি আমদানি করতে হয়। চালের একটা অংশ গত ২০ বছর যাবত আমদানি করতে হয়।
ভোজ্য তেলের পুরাটাই আমদানি নির্ভর। এই খাদ্যপণ্যটি সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে সয়াবিন তেল। সয়াবিন আমাদের দেশে উৎপাদিত হয় না। ফলে বাজারে পণ্যটির মূল্য অনেকগুলো প্রেক্ষিতের ওপর নির্ভর করে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, ডলারের মূল্য ও পণ্যের যোগান শৃঙ্খলা এবং কথিত ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সব মিলিয়ে পণ্যটির মূল্য নির্ধারিত হয়। এটা নিয়ে অস্থিরতা এবং অসন্তোষ নিরসন হয় না। আমাদের দেশের সরিষা এখন ভোজ্যতেলের সামগ্রিক চাহিদার সামান্যই পূরণ করে।
আমাদের বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। সয়াবিন, পাম, সূর্যমুখী, রাইস ব্র্যান ও সরিষার মধ্যে চাহিদার দিক দিয়ে সয়াবিন সবার উপরে। আমাদের দেশে বিভিন্ন জেলায় বছরে কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ হলেও তা মূলত মাছ ও মুরগির ও অন্যান্য খাদ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।
আমাদের দেশে সাড়ে তিন লাখ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়। এখান থেকে আড়াই লাখ টন উৎপাদন হয়। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন প্রায় ৮০০ কেজি। এই ফলন আরো বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতার ক্ষেত্রে সরিষা ভালো বিকল্প হতে পারে।
অন্যদিকে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এক জরিপে দেখা যায়, আমাদের মাথাপিছু তেলের ব্যবহার বেড়েছে ৪০ শতাংশের উপরে। ২০১৫ সালে মাথাপিছু তেলের ব্যবহার ছিল ১৩.৮ কেজি সেখানে ২০১৯ সালে তা বেড়ে জনপ্রতি ১৮.৭ তে দাঁড়িয়েছে বাৎসরিক হিসেবে। পুষ্টিবিজ্ঞানীরা এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাদের মত হল, রোদে জলে কঠোর পরিশ্রম করা মানুষের শরীরের অনেক ঘাটতি ভোজ্যতেল পূরণ করতে পারে।
এ বছরের সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারের জ্বালানি তেলের মূল্য। জাহাজ ভাড়া প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়াও চাহিদা মোতাবেক সয়াবিনের সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছুটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর সকল পণ্যই অগ্রিম 'আইস' (ইন্টারন্যাশনাল কমোডিটি এক্সচেঞ্জ) নামক একটি বাজার ব্যবস্থার অধীনে ক্রয় বিক্রয় করা হয়। এই ব্যবস্থার আওতায় বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ক্রয়ের কোন সুযোগ নাই। অর্থাৎ বাংলাদেশকে সব সময় সরাসরি সরবরাহকারী কাছ থেকে ক্রয় করতে হয়, যার ফলে দীর্ঘ মেয়াদী ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সোয়াবিন তেল কিংবা আমাদের সুতা উৎপাদনকারী মিলগুলোর কাঁচামাল তুলো (যা আবার সয়াবিনের মতন আমাদের দেশে উৎপাদন হয় না) কোন সংযোগ নাই।
'আইস' পদ্ধতি হল, আগাম কেনা- বেচার মূল্যবৃদ্ধি কিংবা হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সুযোগ। বিশ্বব্যাপী বহুপরিচিত এই ফাইন্যান্সিং এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বহুকাল যাবৎ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে জন্য উম্মুক্ত ব্যবস্থা। এর বড় সুবিধা হল, তাৎক্ষণিক বাজার মূল্য এখানে প্রভাব ফেলতে পারে না। 'আইস' পদ্ধতিতে যেহেতু পণ্যটি আগেই কেনা রয়েছে ফলে আগের দামেই পণ্যটি পাওয়ার কথা। প্রতিবেশী দেশ ভারতের এই ব্যবস্থা বহাল আছে। ভারত এই সুবিধাটির পূর্ণ ব্যবহার করতে পারে।
বিষয়টি নিয়ে বহু আলাপ আলোচনা হলেও আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সঠিক গাইডলাইন তৈরি অভাবে এই ব্যবস্থায় স্থানীয় তেল উৎপাদক কিংবা চিনি উৎপাদক অথবা সুতা উৎপাদনকারীরা অংশ নিতে পারে না। বহুকাল পূর্বে এই সংক্রান্ত একটি বিধি চালু করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিন্তু তা বাস্তবে কার্যকরী হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত বিষয়টি ভালো করে গবেষণা করে অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে সেই অনুসারে তৈরি করা যেন তারা তাদের গ্রাহকের সঙ্গে বিষয়টি সঠিকভাবে নিষ্পত্তি করতে পারে।
আমাদের চিনির চাহিদাও তেলের মতই। বাৎসরিক চাহিদা ১৮ লাখ টন। নিজস্ব উৎপাদন বর্তমানে ১ লাখ টনেরও কম। বিপুল এই ঘাটতি মেটাতে ব্রাজিল, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়া থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করা হয়। চিনির ক্ষেত্র বাজারের ওঠানামার শিকার হয় আমাদের ভোক্তা শ্রেণি।
আমাদের পেঁয়াজের চাহিদা ৩০ লাখ টন। আমাদের উৎপাদন চাহিদার প্রায় কাছাকাছি ২৬ লাখ টন। কিন্তু যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারায় ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। যথাপোযুক্ত সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় আইনের সংশোধন করা ছাড়া এই সমস্ত পণ্যের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহার গড়ে উঠবে না। ফলে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ লাখ টন। ডালও চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ আমদানি করতে হয়।
কৃষি পণ্যের উৎপাদন, রক্ষণাবেক্ষণ ও বাজার নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করে মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আইন গড়ে তুলতে হবে যেন কৃষক ও ভোক্তা লাভবান হন। দেশের বর্তমানে ব্রিটিশ আমলের বেশকিছু আইন কার্যকর রয়েছে তার মধ্যে মজুতদারী আইন একটি যা প্রয়োজনের তুলনায় রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় ফলে। ছোট ব্যবসায়ী এবং খুচরা বিক্রেতারা এই আইনের রোষানলে পড়ে। কৃষিপণ্যের ওপর ট্যাক্সের সংযোজনের যৌক্তিকতা নিয়েও ভাবতে হবে।
কৃষকের নিরাপত্তার জন্য তার উৎপাদিত পণ্যের বাজারের নিরাপত্তার জন্য যেটুকু প্রয়োজন তার বাইরে ট্যাক্স /ভ্যাট রাখা উচিত কিনা সেটা ভেবে দেখতে হবে। কোনো মৌলিক কৃষিপণ্যে ট্যাক্স-ভ্যাট কিছুই থাকা উচিত নয়। জমিতে উৎপাদিত ফসল বা আমদানিকৃত কৃষিপণ্য সম্পূর্ণ ভ্যাট- ট্যাক্সমুক্ত রাখতে হবে। সরকারকে তার উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব আদায়ের ভিন্ন সূত্র খুঁজে বের করতে হবে। যদিও আমরা মধ্য আয়ের দেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছি মাথাপিছু আয় পরিমাণটা খানিকটা ঈর্ষণীয় বটে তথাপি এদেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী এই মাথাপিছু আয় এর বহু নিচু আয় নিয়েই জীবন ধারণ করতে হয়। তাদের দিকে লক্ষ্য রেখেই কৃষিপণ্যের যাবতীয় ট্যাক্স না থাকাই উচিত।
তেলের উপর থেকে রোজার পূর্বে এই মুহূর্তে ভ্যাট ট্যাক্স প্রত্যাহার করা হলো তাতে রোজার মধ্যে ভোক্তা পর্যায়ে কোন সুবিধা হবে না। রমজান সামনে রেখে আমদানিকারক আমদানি সম্পন্ন করে ফেলেছেন। ফলে সরকারের এই সিদ্ধান্ত রোজার বাজারে কোন প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না।
সাম্প্রতিক টিসিবির ট্রাকের পিছনের মানুষের দৌড় অনেকগুলো ভাবনার জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন নামে প্রায় ১২৩ টির মত সুরক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়; যার মধ্যে ওএমএস সহ ১১টি খাদ্য সম্পর্কিত প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। যার বাৎসরিক বরাদ্দ প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। দেশে এতসব সেপটিনেট প্রকল্প থাকা সত্বেও এই জাল ছিন্ন করে মানুষ কেন ট্রাকের পিছনে দৌড়াচ্ছে? গলদটা খুঁজতে হবে।
সরকার ইতোমধ্যে দেশের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের এক কোটি পরিবারকে রেশনিংয়ের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চিহ্নিত পরিবারগুলোর কাছে মাসে দুইবার ২ লিটার সয়াবিন তেল, ২ কেজি করে চিনি, মসুর ডাল, ছোলা এবং ৫ কেজি পেঁয়াজ দেওয়া হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে একটা ইতিবাচক ফলাফল আশা করা যায়। ১ কোটি পরিবার অর্থাৎ ৫ কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল। আমরা আশা করব, তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোন ধরনের পক্ষপাতিত্ব করা হবে না। সরকারের কাছেই নানাভাবে মানুষের তথ্য উপাত্ত ডিজিটাল উপায়ে সংরক্ষিত রয়েছে। দলনিরপেক্ষভাবেই 'দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের' মানুষ খুঁজে তালিকা প্রস্তুত করতে হবে।