ন্যাটোর মতো সামরিক জোট নয়, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় দরকার জাতিসংঘের ক্ষমতায়ন
ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মান রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল অনেকগুলো রাজা শাসিত অঞ্চল নিয়ে। প্রথমদিকে তাদের লক্ষ্য ছিল, একটি জার্মান জাতি গঠন করা। জার্মানির অর্থনৈতিক বিকাশ ও জনগণের কল্যাণ করা। পরবর্তীতে জার্মানরা যখন ইউরোপের শান্তি বিনষ্ট করলো এবং শেষপর্যন্ত হিটলারের নেতৃত্বে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করলো- তখন পৃথিবীব্যাপী এক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধের পেছনের মূল দর্শন ছিল, উপনিবেশিক শাসনের বিকাশ ঘটানো। একদিকে ব্রিটিশ উপনিবেশ, ফরাসি উপনিবেশ অন্যদিকে জার্মানদের নতুন উপনিবেশ তৈরির স্বপ্ন, যার মধ্যেই নিহিত ছিল যুদ্ধের মূল বীজ।
হিটলারের জার্মানিকে প্রতিহত কিংবা পরাজিত করতে বিশ্বব্যাপী যে সমঝোতা গড়ে উঠেছিল, সেই সমঝোতার ভিত্তিতেই জার্মানি পরাজিত হয়েছিল। যার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। জার্মানিকে হারাতে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা স্ট্যালিন, ইংল্যান্ডের চার্চিল আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রুজভেল্ট একত্রিত হয়েছিলেন- ইউরোপে জার্মানি এবং এশিয়ায় জাপানকে পরাজিত করার জন্য।
সেই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি মধ্য দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন ফাঁদ সৃষ্টির জন্য এক নতুন সামরিক জোট সৃষ্টি করলো। আনুষ্ঠানিকভাবে যার নাম হল, উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট- সংক্ষেপে ন্যাটো। ১৯৪৯ সালে ন্যাটো গঠিত হওয়ার পর, সোভিয়েত রাষ্ট্রনায়ক স্ট্যালিন মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের মিত্র কমিউনিস্ট দেশগুলোকে নিয়ে ১৯৫৫ সালে বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও পারস্পারিক সহায়তা চুক্তি- ওয়ার'শ প্যাক্ট গঠন করেন। ওয়ার'শ স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপের আটটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত সম্মিলিত প্রতিরক্ষা চুক্তি। ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে- ঐ একই বছরের মে মাসে ওয়ারশ প্যাক্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ওয়ার'শ চুক্তিটি ন্যাটোর ক্ষমতার ভারসাম্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও বিলুপ্তির কারণে সেই ভারসাম্য আর থাকেনি।
গত ৯০- এর দশক থেকে ন্যাটো পৃথিবীতে একক সামরিক শক্তি, যার নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের সকল সামরিক তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন ন্যাটো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমরা লক্ষ করেছি, একের পর এক সারা বিশ্বের নানান প্রান্তে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমে কোরিয়া, তারপর ভিয়েতনাম। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর প্রায় সবকটিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের মনোনীত রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য একের পর এক সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে আর এই সকল অপকর্মের সহযোগী হয়েছে ন্যাটো। জীবাণু অস্ত্রের মিথ্যা অভিযোগে ইরাক আক্রমণ ও দখল করে নেওয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও যুদ্ধ ছাড়া- শান্তিপ্রতিষ্ঠা করতে পারেনি এই জোট। মিশরের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে যে সামরিক জেনারেল ক্ষমতা দখল করল; তাকেও সমর্থন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপিয় মিত্রদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে পৃথিবীব্যাপী ন্যাটোর যে সামরিক উপস্থিতি- তা পৃথিবীর কোথাও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারছে কিনা সেটা আজ প্রশ্ন হয়ে সামনে আসছে। বরং এই সমর শক্তির জোরে পৃথিবীর সর্বত্র অন্যায় যুদ্ধ বা যুদ্ধাবস্থা জারি রেখেছে তারা। সামরিক দিক থেকে কম শক্তিধর দেশগুলোর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জননিরাপত্তা প্রায়শই হুমকির মধ্যে পড়ে। দেশগুলো জাতীয় আয়ের বড় অংশ দিয়ে বাধ্য হয়, সামরিক খাতে ব্যয় করতে। অস্ত্র কিনতে হয় ন্যাটোভুক্ত দেশগুলি থেকেই। পৃথিবী এই চক্র থেকে বের হতে পারছে না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত লীগ অব নেশন্স দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাতিসংঘে রূপলাভ করে। ১৯৪৫ সালে ৫১টি দেশ একটি যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। যার লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইন, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি এবং মানবাধিকার বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি। জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা এখন ১৯৩ টি। পর্যবেক্ষণে আরও দুটি দেশ। জাতিসংঘ সনদের ১১১টি ধারা রয়েছে যা ১৯টি অধ্যায়ে বিভক্ত। যেকোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সনদের ২নং ধারা অনুযায়ী, সকল সদস্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সমতা জাতিসংঘের ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মানব জাতির উদ্বেগের কারণ এমন যেকোনো বিষয় বিহিত করার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা এই ধারাতেই বলা আছে।
এখন প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘ কী পারছে, সনদের বিধানগুলো বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে? আমরা এখন জ্বলন্ত উদাহরণ ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে আছি। একটু একটু করে একটি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল, জাতিসংঘ পারেনি এই যুদ্ধ এড়াতে। অথচ সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে যেকোনো স্থানে হামলা পরিচালনার ক্ষমতার মধ্য দিয়ে ছোট শক্তির দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব হরণ করা হয়েছে। শক্তিধর দেশগুলো কর্তৃক একের পর এক স্থল, আকাশ ও জলসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা রয়েছে, যেখানে জাতিসংঘ নিশ্চুপ থেকেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর নিন্দা প্রস্তাব নেওয়া যায়নি।
ব্রিটেন ব্রেক্সিট এর মাধ্যমে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গেলেও, সামরিক জোট ন্যাটো ত্যাগ করেনি। বরং ব্রিটেন সেখানে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ব্রিটেন জানে, বিশ্বকে শাসন করতে হলে সামরিক শক্তির উপরই নির্ভর করতে হবে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের যখন পতন ঘটে, তখন ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা ১৫। পশ্চিম জার্মানি নবীনতম সদস্য। ১৯৫৫ সালে পশ্চিম জার্মানি ন্যাটোতে যোগ দেয়। সোভিয়েত পতনের পর ন্যাটো তার কৌশল বদল করে। ন্যাটো পূর্বাঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়। সাবেক সোভিয়েত পক্ষ অবলম্বনকারী দেশগুলোকে টার্গেট করে তারা এগুতে থাকে। এই অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে ন্যাটোর সদস্য এখন ৩০। সাবেক সোভিয়েতের তিনটি দেশ এখন ন্যাটোর সদস্য। ৩১তম দেশ হওয়ার কথা ছিল ইউক্রেনের। তাতেই মস্কোর ঘোর আপত্তি। ফলাফল প্রায় এক দশকের উত্তেজনা- অবশেষে যুদ্ধ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের যে বাস্তবতা তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে বিশ্বে। পরাক্রমশালী সোভিয়েত দেশে দেশে লাল পতাকা তুলে সমাজতন্ত্র ঘোষণা করছে। ধনতান্ত্রিক ইউরোপ তাতে শংকিত হয়। তাদের দরকার নিরাপত্তা, গঠিত হলো ন্যাটো। এই যদি হয় ন্যাটো গঠনের প্রেক্ষাপট তাহলে বিশ্ব তো সেখানে দাঁড়িয়ে নেই। সমাজতন্ত্রীদের বিকল্প সামরিক জোট ওয়ারশ প্যাক্টের বিলুপ্তি ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির অন্তত ছয় মাস আগে। এখন একটি পরিবর্তিত বিশ্ব। যেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের সুরক্ষার অগ্রাধিকার রয়েছে। সেখানে কি এখনো ন্যাটো প্রাসঙ্গিক?
বিশ্বব্যাপী ন্যাটোর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন যখন জোরাল হচ্ছে তখন দেখছি, ন্যাটো সদস্য সংখ্যা বাড়াতে তারা আরও আগ্রাসী রূপে হাজির হচ্ছে। বিশ্বে এখন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, মানবিক উন্নয়ন ও সহযোগিতার জন্য জোট গঠিত হয় না। সবাই ঝুকছে সামরিক জোটের দিকে। ব্রিটেন তার বড় উদাহরণ। লক্ষ্য কেবল সামরিক শক্তির উপর ভর করে নিজেদের বাণিজ্য ও অস্ত্র ব্যবসা চালু রাখা।
বর্তমান বাস্তবতায় পৃথিবীতে যেকোনো ধরনের সামরিক জোটের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। পৃথিবীতে সামরিক জোট বিরোধী জনমত দৃঢ় হচ্ছে। ন্যাটো, কোয়াড, অকাস বা ছোট-বড় কোনো ধরনের সামরিক জোট আপত বা চূড়ান্ত কোন বিচারেই মানুষের কল্যাণে আসে না।
জাতিসংঘের কাছে আমাদের মত দেশগুলোর মানুষের প্রত্যাশা আরও বেশি। বিশ্বসংস্থাটির কোন নির্বাহী ক্ষমতা হয়ত নেই, কিন্তু তারা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে জানতে চাইতে পারে। কেন এত বিপুল মরণাস্ত্র সম্ভার? কেন এত ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা? কেন এত যুদ্ধবিমান বা জাহাজ? কার নিরাপত্তা, কীসের নিরাপত্তা? জাতিসংঘ এই প্রশ্ন কখনো তুলেছে বলে জানি না।
ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে জাতিসংঘের কেন প্রশ্ন তৈরি হয়নি- এটা বিস্ময়কর। মিয়ানমারে সহিংস উপায়ে জাতিগত নির্মূলের অংশ হিসেবে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে উৎখাতের ঘটনা বা ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে কাশ্মীরের মানুষকে অবরুদ্ধ করে রাখা অথবা ধর্ম, বর্ণ, জাতিগোষ্ঠি দ্বারা সামাজিক বিভাজন নিয়ে জাতিসংঘকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে প্রশ্ন করতে দেখিনা।
জাতিসংঘ কেবল ভেটো প্রদানকারী দেশ বা নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর প্রতিষ্ঠান নয়। আমরা বরং জাতিসংঘকে সর্বজনীন বিশ্বপ্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখতে চাই। যদি কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়- তাহলে সংস্থাটির সেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এক দেশ কেন অন্য দেশকে শাস্তির আওতায় আনবে? যেকোনো অবরোধ আরোপের ক্ষমতা কেবল বিশ্বপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতিসংঘের হাতেই থাকা উচিত।
এখন জাতিসংঘেরই দায়িত্ব হওয়া উচিত একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া। সামরিক, আর্থিক ও বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা দুর করা।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক