গ্রেপ্তারের সময় ইয়াবা গুঁজে হুমকির সঙ্গে কিল-চড়-ঘুষি; ফর্মে ফেরত আসা পুলিশকে অভিনন্দন
পুলিশ তার আসল ফর্মে ফিরতে শুরু করেছে— এর চেয়ে বড় স্বস্তির খবর এই মুহূর্তে আর নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থেকে পুলিশের ফর্মে ফেরার খবর পাওয়া গেছে।
গজিয়াবাদ কিংবা দিল্লি থেকে পুলিশের সেই ওসির গ্রামের বাড়ি কোথায় জানতে চাওয়া হয়নি। আমাদেরও তার ঠিকুজি খোঁজার দরকার নেই। পুলিশ যে তার আদি এবং আসল চরিত্রে ফিরে যেতে পেরেছে, এটাই আমাদের জন্য বড় খবর। অনেক বড় পাওয়া।
হে পুলিশ বাহিনী, আপনারা আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করুন। অভিনন্দন গ্রহণ করে আমাদের কৃতার্থ করুন।
দুই মাস ধরে ফর্মহীন ছিল পুলিশ। তবে আমাদের ক্রিকেটারদের মতো ফর্মে ফিরতে তারা দীর্ঘ সময় নেয়নি। এটাই এ মুহূর্তে দিকহারা মানুষের দিশা পাওয়ার মতো ঘটনা।
পুলিশ যদি রাজনৈতিক চাপে কিংবা বা প্রভাবশালীদের টাকার গরমে লেজ না নাড়ায়, তাহলে সেটা কিসের পুলিশ বাহিনী! পুলিশ মানেই হতে হবে ভুয়া বা উদ্দেশ্যমূলক মামলায় অভিযান ও গ্রেপ্তার। পুলিশ মানেই হাতে অস্ত্র বা পকেটে ইয়াবা গুঁজে দেওয়া। গ্রেপ্তারের সময় কিছু কিল-চড়-ঘুষি। অভিযানে নগদ নারায়ণও আদায় করে নিতে হবে।
পুলিশের এসব চরিত্র যদি আমরা না দেখি, তাহলে তাদের উপস্থিতি টের পাই না। নিজেদের অনিরাপদ মনে করি।
ঠিক দুইমাস আগে (৫ আগস্ট) ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর পুলিশের কেউ কেউ পালিয়ে গেছেন। কেউ কেউ কাজে ফিরতে দেরি করেছেন। যারা কাজ শুরু করেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিল ভয় এবং দোটানা ভাব।
কিন্তু, বেশিদিন তো এরকম চলতে পারে না। পরিস্থিতি যেহেতু মোটামুটি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, পুলিশও দোনোমনো অবস্থা পেরিয়ে ফিরে যেতে শুরু করেছে তার আসল চরিত্রে।
আশার কথা সেটা শুরু হয়েছে।
শুরুটা হয়েছে আশুগঞ্জ থেকে। আশা করা যায়, শিগগিরই সেটা সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে। ছড়িয়ে যেতেই হবে। না হলে আমরা কীভাবে বুঝব যে, পুলিশ বাহিনী সক্রিয় হয়েছে! না হলে কীভাবে বুঝব যে, আসল জায়গা বাদ রেখে সাধারণ মানুষকে দৌড়ের ওপর রাখার পূর্ব চরিত্রে ফিরে গেছে পুলিশ। আফটার অল, তারা জনগণের সেবক। মানুষকে তো সেটা টের পেতে হবে।
আশুগঞ্জে কী হয়েছে সেটি হয়তো অনেকেই জানি। যারা জানেন না তাদের জন্য ঘটনার বিস্তারিত জানানোর আগে নবারুণ ভট্টাচার্য'র 'পুলিশ করে মানুষ শিকার' কবিতার শেষ কয়েকটি লাইনে একটু চোখ বুলিয়ে নিতে পারি:
"পুলিশ করে মানুষ শিকার
মানুষ শিকার করে পুলিশ
দলের পুলিশ কলের পুলিশ
কত ছলাকলার পুলিশ
যাচ্ছে নোনা সোঁদা হাওয়ায়
চা সিগারেট চাখতে চাখতে
কোন থানেতে মানত রাখতে
বনবিবি না দক্ষিণরায়।"
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে পুরনো সেই শিকারী পুলিশের সন্ধান পেয়েছি আমরা। দৈনিক প্রথম আলোতে যে খবর ছাপা হয়েছে সেটি যদি আমরা সংক্ষেপ করে আনি, তাহলে ঘটনা দাঁড়ায় এরকম:
- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় বিএনপির বহিষ্কৃত এক নেতার মামলায় বিএনপির নেতা গ্রেপ্তার।
- বহিষ্কারের পেছনে গ্রেপ্তার বিএনপি নেতার হাত ছিল বলে ছাত্র আন্দোলনে হামলার ঘটনায় ওই বিএনপি নেতাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
- বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তারের সময় পরিকল্পিতভাবে ঘরে ইয়াবা রেখে ইয়াবাসহ আটকের কথা বলে নগদ সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ও স্বাক্ষর করা ৯টি চেক নেওয়ার অভিযোগ।
- পূর্বপরিকল্পিতভাবে ইয়াবা উদ্ধারের কথা বলে মাদকের মামলাসহ বিভিন্ন মামলা দেওয়ার হুমকি।
- গ্রেপ্তারের সময় হাতকড়া দিয়ে কপালে এবং ঘাড়ের ডান পাশে কিল–ঘুষি।
- থানায় সারারাত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
- এসব বিষয় কাউকে বললে আশুগঞ্জ থানার বিভিন্ন মামলাসহ ঢাকার বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর হুমকি।
- জনদাবির মুখে ছাত্র আন্দোলনে হামলার মামলা থেকে বাদী (বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা) তার নাম হলফনামার মাধ্যমে প্রত্যাহার করার পর বিএনপি নেতার মুক্তি।
- ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর পুলিশের এক পরিদর্শক ও দুই উপপরিদর্শককে প্রত্যাহার।
এ বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, ৫ আগস্টের পর পুলিশ ভাঙা মন নিয়ে কাজ শুরু করলেও তারা আবার আগের মতোই মোটিভটেড হতে পেরেছে। পুলিশ যখন নিষ্ক্রিয় ছিল, তখন উচ্চ পর্যায় থেকে বারবার আমরা মোটিভেশনের কথা শুনেছি। বুঝতে পারছি সেই মোটিভেশন তাদের মধ্যে ফিরে এসেছে।
তবে, এটা বুঝতে পারছি না যে, পুলিশের যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেই সংস্কার হলে তাদের মধ্যে মোটিভেশন আরো বাড়বে কিনা। আরো বাড়লে মানুষ আরো বিপদের মুখে পড়বে কিনা সেটিও প্রশ্ন।
এতদিন তাদের প্রভু ছিল অসৎ-দুর্বিনীত-লুটেরা রাজনৈতিক শক্তি। সাধারণের হাতে অস্ত্র কিংবা পকেটে ইয়াবা গুঁজে দেওয়া পুলিশ সংস্কারের পর নিজেরাই যখন নিজেদের প্রভু হবে, তখন তাদের মন কী যে চাইবে সেটি সৃষ্টিকর্তাই জানেন।