শেখ হাসিনা, ভারত ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি
১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে অবস্থান করছেন প্রায় দুই মাসের মত। তবে, তাকে নিয়ে কী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কিছুই জানায়নি ভারত। দীর্ঘদিনের এই মিত্রকে নিয়ে এখন উভয়সঙ্কটে রয়েছে নরেন্দ্র মোদির সরকার।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর তার প্রত্যর্পণ নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। সেই জটিলতার সমাধানে কোন পথে ভারত এগোতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে।
এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকে ভারতে তার অবস্থানের বৈধভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু হয়েছে।
দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রত্যর্পণ চুক্তির ব্যতিক্রমী ধারা যদি ভারত ব্যবহার করে তাহলে তাতে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও নতুন মোড় আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে কৌশলগত দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের কথা মাথায় রেখে ভারত কীভাবে এই জটিলতার সমাধান করতে পারে?
অনেক বছর ধরে অন্য প্রতিবেশীদের মতোই বাংলাদেশকে চোখে চোখে রেখেছেন ভারতের নীতিনির্ধারকরা। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের ভেতরে, ভারতকে কী দৃষ্টিতে দেখা হয় সেদিকে মনোযোগ দেয়ার এবং সেখানকার সেন্টিমেন্টকে স্বীকৃতি দেয়ার। সেটা করতে হবে রাজনৈতিক এবং তৃণমূল পর্যায় উভয়ভাবে।
ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য মিন্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তৃণমূল পর্যায়ে বাংলাদেশের অধিকাংশের দৃষ্টিভঙ্গি হলো বাংলাদেশের চেয়ে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ হলো ভারতের শক্তিশালী মিত্র। এই দল এবং সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই সম্পর্কের পরিচয় এ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদে জন্য ভারতের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে যখন চীনের সঙ্গে স্বার্থের প্রতিযোগিতা চলছে।
ভারতের নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি, সাগর ডকট্রিন এবং অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির জন্য বাংলাদেশ কৌশলগত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিসহ বাংলাদেশের সব মূল বিরোধী দলের সঙ্গে সব চ্যানেল উন্মুক্ত রাখা ভারতের নিজের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভের পেছনে অন্য কারণও রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন ৫৪টি নদী আছে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সেগুলোর পানি ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ বহু পুরোনো।
ভুল তথ্য কীভাবে দুই দেশের মধ্যকার সন্দেহকে উসকে দিতে পারে, তার একটি উদাহরণ ভারি বৃষ্টিপাতে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রতিক বন্যা।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে হঠাৎ ভারি বৃষ্টির পর অতিরিক্ত পানি দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত গোমতী নদী দিয়ে তীব্র বেগে বয়ে যায় ভাটির দেশ বাংলাদেশের দিকে। তাতে ত্রিপুরার ভেতরে এবং বাংলাদেশের ভাটিতে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। তাতে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা অভিযোগ করেছেন, রাতের বেলা ড্যাম থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে পানি ছেড়ে দিয়েছে ভারত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়, যাতে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়- ভারি বৃষ্টির কারণে গোমতী অববাহিকায় বন্যা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষী মনোভাবের পেছনে চীনকেও একটি কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানায়, ভারতের সঙ্গে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে বাংলাদেশে নিজেদের অবস্থান বাড়াতে আগ্রহী বেইজিং। মালদ্বীপের নির্বাচনে জয় পাওয়ার পর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরের জন্য চীনকে বেছে নেওয়া মুইজ্জুকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিল বেইজিং।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা এড়াতে চাইবে দিল্লি। আর সেক্ষেত্রে ভারতীয় পণ্য ও বাণিজ্যের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতার কারণে কূটনৈতিক কৌশল ঠিক করতে এবং ভারতবিদ্বেষী মনোভাব পরিবর্তনে দিল্লি কিছুটা সময় পাবে বলে আশা করছে। সেই কারণে ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে দিল্লিকে সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলতে হবে।
এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে এশিয়ায় তার প্রভাব বাড়াতে চায়। বাংলাদেশের কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ঢাকাকে খুব দরকার ছিল ওয়াশিংটনের। মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারত। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যখনই বাংলাদেশের সুশাসন ও নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র কথা তুলেছে- প্রতিবারই ভারত হাসিনা সরকারকে আগলে রেখেছে। এখন মনে হচ্ছে, ওয়াশিংটন এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করতে উদ্যত হয়েছে।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে ভারতের। আর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আছে একটি প্রত্যর্পণ বিষয়ক অ্যারেঞ্জমেন্ট। ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত হয় ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি। তা সংশোধিত হয় ২০১৬ সালে। এ থেকে সুবিধা পেয়েছে দুই দেশই। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে আসামের উলফা শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয় বাংলাদেশ। জঙ্গি সংগঠন জেএমবি দমনেও সফল হয় তৎকালীন সরকার। এই চুক্তির অধীনে বেশ কিছু বাংলাদেশি পলাতককে হস্তান্তর করা হয়। তবে এখন ভারতের নির্ভরযোগ্য কৌশলগত মিত্র শেখ হাসিনাকে ফেরতের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। বাংলাদেশ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ফেরত চায়নি। বিষয়টি এখন কূটনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক নীতি-নির্ধারণের কৌশলগত ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই পটভূমিতে দিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের সামনে কার্যত তিনটি রাস্তা খোলা আছে। প্রথম রাস্তাটা হলো, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জন্য তৃতীয় কোনো দেশে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা, যেখানে তিনি নিরাপদে ও সুরক্ষিত পরিবেশে থাকার নিশ্চয়তা পাবেন।
দ্বিতীয় পথ, শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে ভারতেই রেখে দেওয়া। আর, তৃতীয় পথটার বাস্তবায়ন হয়ত এখনই সম্ভব নয়। আর তা হলো রাজনৈতিক দল হিসেবে আওমায়ীলীগকে পুনরায় শক্তিশালী করে তুলে হাসিনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে তোলা।
ভারতের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ এখনও ফুরিয়ে যায়নি এবং দলের সর্বোচ্চ নেত্রী হিসেবে তিনি দেশে ফিরে সংগঠনের হাল ধরতেই পারেন। যদিও তা চরম বাস্তবতায় কতটুকু সম্ভব তা চিন্তা করাও প্রয়োজন। গণহত্যার নির্দেশদাতা ও স্বৈরশাসকের তকমা পাওয়া হাসিনার দেশে ফিরে আবার রাজনীতি করাটা কার্যত 'অবাস্তব' এখন।
এই তিনটির মধ্যে প্রথম পথটাই ভারতের জন্য নিরাপদ হতে পারে। কারণ হাসিনার দীর্ঘমেয়াদে ভারতে থাকা ঢাকা-দিল্লী কূটনৈতিক সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এর পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য ঢাকার কাছ থেকে যদি কোনো অনুরোধ আসে, সেটা যে কোনো না কোনো যুক্তিতে দিল্লি খারিজ করে দেবে এটা নিশ্চিত।
শেখ হাসিনাকে নিরাপদ কোনো তৃতীয় দেশে পাঠানোর চেষ্টা এখনও পুরোদস্তুর অব্যাহত আছে। বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে জানা যায়, শেখ হাসিনার যুক্তরাজ্যে যাওয়ার প্রস্তাব প্রথমেই বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ইউরোপের দু-একটি ছোটখাটো দেশের সঙ্গে ভারত এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিল। এরপর মধ্যপ্রাচ্যের আর একটি প্রভাবশালী দেশ কাতারের সঙ্গেও ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে কথাবার্তা শুরু করেছে বলে জানা যাচ্ছে। কাতারের আমির ঢাকা সফরে এসেছিলেন মাস চারেক আগেই। তখনও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদে। যদিও এই সব আলোচনায় তেমন একটা অগ্রগতি হয়েছে বলে খবর নেই।
তবে পাশাপাশি এটাও ঠিক, শেখ হাসিনা নিজে এখনও কোনো দেশে লিখিত আবেদন করেননি। যুক্তরাজ্য বা আমেরিকায় তো নয়-ই, বাকি দেশগুলোতেও না। তার হয়ে এবং তার মৌখিক সম্মতির ভিত্তিতে যাবতীয় কথাবার্তা ভারত সরকারই চালাচ্ছে। অন্য কোনো দেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা থাকলেও ভারত সরকারের ইস্যু করা ট্রাভেল পারমিট দিয়ে তিনি অনায়াসেই ভ্রমণ করতে পারবেন।
রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা
দিল্লি এখন যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তাতে শেখ হাসিনাকে তারা দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে রেখে দিতে পারে এরকম আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামা, নেপালের রাজা ত্রিভুবন বীর বিক্রম শাহ বা আফগান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর মতো বহু বিদেশি নেতাকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় এর আগে দিয়েছে।
তবে এই পদক্ষেপ যদি একান্তই নিতে হয়, তবে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার প্রভাব কী পড়বে, সেটাও দিল্লিকে খেয়াল রাখতে হবে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ১৯৫৯ সালে দালাই লামাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার পর থেকে ভারত-চীন সম্পর্কে যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল আজ ৬৫ বছর পরেও কিন্তু তার রেশ রয়ে গেছে।
ভারতেও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, শেখ হাসিনাকে ভারত যদি আশ্রয় দিয়ে রেখে দেয় তাহলে বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেটা অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে। ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য মিন্ট এক প্রতিবেদনে জানায়, এমনিতেই বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরি হয়েছে। হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে এই সেন্টিমেন্টকে আরও উসকে দেয়া হতে পারে।
তবে, এক্ষেত্রে ভারতের আদতে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ দশা। দীর্ঘদিনের মিত্র শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় না দিলে পরবর্তী সময়ে দিল্লির সঙ্গে কোনো রাষ্ট্র বা নেতা মিত্রতা গড়তে চাইবেন কিনা সে নিয়েও শঙ্কা তৈরি হতে পারে।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান পুনরুদ্ধার
বিবিসি'র এক প্রতিবেদনে ভারতের একজন শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, 'বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা অন্তত তিনবার দুর্ধর্ষ কামব্যাক করেছেন; ৮১', ৯৬' আর ২০০৮ সালে।
এই তিনবারই অনেকে ভেবেছিলেন, তার পক্ষে হয়ত ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না। কিন্তু প্রতিবারই তিনি তাদের ভুল প্রমাণ করেছেন— এর মাধ্যমে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান যে ভারতের শীর্ষ মহল এখনও এটি বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে শেখ হাসিনা এখনও প্রাসঙ্গিক এবং উপযুক্ত সময় এলে তার দলকে রাজনৈতিক পুনর্বাসনে সাহায্য করা সম্ভব।
তবে, তাত্ত্বিকভাবে এই ধারণাটা সম্ভব বলে ধরে নেয়া গেলেও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ধারণা কতটুকু প্রাসঙ্গিক তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন রাজকীয় বেশে লাখো মানুষের স্লোগান মুখর রাজপথে। ১৯৯৬-এর নির্বাচন জিতেছিলেন আন্দোলন করে নিজেকে শক্তিশালী বিরোধীদলীয় প্রধান হিসেবে প্রমাণ করে এবং ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে।
মনে রাখা উচিত, এই তিনটি প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপটের তুলনা সম্ভব নয়। অসংখ্য মানুষ হত্যার সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে গেছে। সাথে আছে আর্থিক কেলেঙ্কারি, 'রাতের ভোট' নামে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ও অস্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা প্রণয়নের একরাশ অভিযোগ। এর আগে যে কয়বারই হাসিনা রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, প্রতিবারই পেয়েছিলেন প্রচুর জনসমর্থন যা এখনকার পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ।
এর পাশাপাশি শেখ হাসিনার মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতাও একটা বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত বয়স একটা বাধা। দ্বিতীয়ত, যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তিনি দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন সেই পরিস্থিতিতে দেশে পুনরায় রাজনৈতিক তাৎপর্য তৈরি করতে প্রয়োজন হবে একটি প্রতিবিপ্লবের যা কতটুকু বাস্তব তা হয়ত শুধু সময় বলতে পারে। এক্ষেত্রে আওয়ামীলীগের পুনরুত্থান সম্ভব হলেও হতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হাসিনার হাতে থাকবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
তবে, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে কোনো নিষিদ্ধ দল নয়। সারা দেশে তাদের নেতা-কর্মী রয়েছেন। শীর্ষস্থানীয় জায়গাগুলোতে পরিবর্তন আনা সম্ভব হলে তাদের অবস্থান পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। কেননা আওয়ামীলীগকে বাইরে রেখে নির্বাচন করলে সে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। আর আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে আসে তাহলে তাদের প্রচার প্রচারণার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে দলের তৃণমূল এমনিতেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকতে পারবে নিশ্চয়, কারণ তাদের নিশ্চিহ্ন করা অত সহজ নয়, তবে সেক্ষেত্রে প্রয়োজন দলের নেতৃত্বে বড়সড় পরিবর্তন এবং জনগণের বিপুল সমর্থন। না হলে দল হিসেবে জনসমর্থন না পেয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়তে হবে তাদের। \
আর জনগণের সমর্থন আদায় করতে চাইলে হাসিনাকে হয়ত এই মুহূর্তে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও মেনে নিতে চাইবেন না।
এছাড়া, গত মাসে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যতগুলো বিবৃতি দিয়েছেন, তা আসলে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো রকম প্রভাব বিস্তার করেনি বরঞ্চ তা বিভ্রান্তি ও হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে।
এক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্রের পুরোনো বেড়াজাল ভেঙে আওয়ামী লীগকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং নতুন নেতৃত্ব বিকাশের পথ তৈরি করতে হবে।
আর যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান সম্ভব হলেও হাসিনা বা শেখ পরিবারের পুনরায় রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা হয়ত সম্ভব হয়ে উঠবে না। সুতরাং আওয়ামীলীগের পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ থাকলেও, হাসিনার সেখানে আবার জায়গা তৈরি করে নেয়াটা আপাতদৃষ্টিতে সম্ভব না।
উত্তাল আন্দোলনের পরিস্থিতিতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলন ও হাসিনার পলায়নের মধ্যে দিয়ে তারা যে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এটি দৃশ্যমান।
রাজনৈতিকভাবে জনগণের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে আন্দোলন দমনে প্রথমে ছাত্রলীগ লেলিয়ে দেয়া হয়েছে, এরপর ব্যবহার করা হয়েছে পুলিশ।
জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার পেছনে অবশ্য অনেক কারণ আছে। প্রথমত, অংশগ্রহণমূলক প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করায় জনগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার লিটমাস টেস্টিং করার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আগেই।
দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন থেকে সংসদ নির্বাচন প্রতিটা জায়গাতেই মনোনয়ন বাণিজ্য ও ভোটের মাঠে টাকা ছড়ানোর প্রতিযোগিতা হয়েছে। এতে ত্যাগী নেতাকর্মীরা মূল্যায়িত হননি। ইউনিয়ন থেকে কেন্দ্র প্রতিটা পর্যায়ে দলীয় পদ বেচাকেনা হয়েছে।
এতে রাজনৈতিকভাবে সবসময় সম্মুখসারিতে থাকা নেতারা পিছিয়ে পড়েছেন। ফলে দলীয় নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে গেছে।
তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূল, প্রতিটা জায়গার দলীয় কাউন্সিল কার্যত অচল হয়ে এক ব্যক্তি নির্ভর হয়ে পড়ায় দলের অভ্যন্তরেও গণতন্ত্র চর্চা বন্ধ হয়ে গেছে। যার কারণে ভেঙে পড়েছে সংগঠন।
আওয়ামীলীগের এঅবস্থা উত্তরণের হয়ত সুযোগ রাতারাতি এখনই নেই। তবে আওয়ামী লীগকে এক ব্যক্তি নির্ভরতা ও ক্ষমতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে সাধারণের কাতারে দাঁড়িয়ে ভাবার সময় এখনই মোক্ষম সময়, যদি আবার তারা রাজনীতিতে ফেরত আসতে চায়।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের ভাবতে হয় রাজনৈতিক ও ক্ষমতা কাঠামোর সংস্কার নিয়ে। ভাবতে হয়, গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতার মতো মৌলিক রাষ্ট্রভিত্তি নিয়ে। প্রতিহিংসার রাজনীতি, লেজুরবৃত্তি ও ক্ষমতার স্বার্থে আবদ্ধ রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
প্রাচীন অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিক চাণক্য বলেছিলেন, অতি পরিচয়ে দোষ আর ঢাকা থাকে না। আর, 'উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু'। সংস্কারের এই সুবর্ণ লগ্নে, কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে ও রাজনৈতিকভাবে এখনই হয়ত এ কথাটি ভেবে দেখবার যথার্থ সময়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।