প্রচলিত ধারণার বিপরীতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা; অগ্রগতির এ ধারা ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ!
বাংলাদেশের নাম শুনলেই অনেকেই মনে করেন দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশ। অবশ্য এর কারণও আছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর এটি ছিল বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাংলাদেশের চিরচেনা চিত্র—যেমন, এই বছরেই গণ-অভুত্থানের মুখে টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। বর্তমানে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করছে।
তবে, দারিদ্র্যের এই চিরাচরিত ধারণাকে ভেঙে বাংলাদেশ দ্রুত নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, যেখানে গড় আয় প্রায় ২,৫০০ ডলার। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাদ পড়ার পথে রয়েছে দেশটি।
দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে উঠে আসার পাশাপাশি, বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছে। দুটি পরিসংখ্যান-ই এর প্রমাণ দেয়।
১৯৯০ সালে যেখানে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু ছিল প্রায় ৫৮ বছর, ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ বছরে। দ্য ল্যানসেট-এ প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া, মৃত্যুর হারও ব্যাপকভাবে কমেছে: ১৯৯০ সালে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১,৫০০ জন মারা যেত, ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭১৫ জনে।
এই সাফল্যগুলো এমন একটি দেশে অর্জিত হয়েছে, যার মাথাপিছু জিডিপি ২ হাজার ৬৮৮ দশমিক ৩১ ডলার এবং মোট দেশজ উৎপাদনের মাত্র ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা হয়। তুলনামূলকভাবে, অন্যান্য নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলো জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করলেও বাংলাদেশের মতো এমন অগ্রগতি অর্জন করতে ব্যর্থ।
আমি নিজে কাশ্মীরে জন্মেছি, তাই এই অঞ্চলের বিষয়ে বেশ ভালো ধারণা আছে। মেডিক্যাল ট্রেনিংয়ের সুবাদে আমি ঢাকাতে বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছি।
সেখানকার স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির পেছনে বিভিন্ন উদ্যোগের সমন্বিত কার্যক্রম দেখে, দেখে আমি মুগ্ধই হয়েছি বলা চলে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং অর্থায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি কমিউনিটি-ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যা মূলত গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এসব উদ্যোগের অধীনে ছোট ছোট স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে নারীদের প্রজনন সেবা, টিকাদান কার্যক্রম এবং পুষ্টি সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশের একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন
মুখে খাওয়ার স্যালাইন বা ওরস্যালাইন (ওরাল রিহাইড্রেশন সল্যুশন) এর উদ্ভাবক বাংলাদেশ। ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওরস্যালাইনকে স্বীকৃতি দেয়।
ডায়রিয়ার কারণে শরীর থেকে যে লবণ (বিশেষ করে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম), চিনি ও পানি বেরিয়ে যায়, তা পূরণে একটি পানীয়ের মাধ্যমে শরীরে তা ফিরিয়ে আনা—শুনতে সহজ মনে হলেও এটি ছিল এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন।
বাংলাদেশের গবেষক রফিকুল ইসলাম ও মাজিদ মোল্লা, যারা ঢাকার কলেরা গবেষণাগারে (বর্তমানে আইসিডিডিআর,বি নামে পরিচিত) কাজ করতেন, আমেরিকান চিকিৎসক ডেভিড ন্যালিন ও রিচার্ড ক্যাশের সঙ্গে মিলে এই সল্যুশনের উদ্ভাবন করেন।
তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ওরস্যালাইন ব্যবহারের ফলে প্রাপ্তবয়স্ক কলেরা রোগীদের শিরাপথের মাধ্যমে স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন ৮০ শতাংশ কমে গেছে।
গ্লোবাল হেলথ বিশেষজ্ঞ থমাস জে. বল্লিকি বলেন, "ওরস্যালাইন বিংশ শতাব্দীতে ৫০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সহায়তা করেছে"। দ্য ল্যানসেটও এটিকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা অগ্রগতিগুলোর একটি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই এখন সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন উঁকি দেয় তা হলো— বাংলাদেশ কি তার স্বাস্থ্য অগ্রগতির এ ধারা ধরে রাখতে পারবে এবং স্বাস্থ্যখাতের নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে কতটুকু সক্ষম হবে?
বাংলাদেশের শুরুতেই যে বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত তা হলো সংক্রামক রোগসমূহের মোকাবিলা।
বিশ্বব্যাংক গত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার অনুদান ও সুবিধাজনক ঋণের মাধ্যমে সংক্রামক রোগের চিকিৎসা, প্রতিরোধ ও রেফারেল সেবার উন্নতির জন্য কাজ করছে। বিশেষ করে ডেঙ্গুর মতো মশাবাহিত রোগগুলো, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা মোকাবিলায় প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
একই সময়ে যক্ষ্মার মতো রোগের কারণে মৃত্যুসংখ্যা কমেছে।
তবে নতুন চ্যালেঞ্জও আসছে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস ও আলঝেইমারের মতো অসংক্রামক রোগের কারণেও মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাচ্ছে—এটিকে মহামারিবিদরা 'দ্বৈত বোঝা' বলে অভিহিত করেছেন।
এছাড়াও, ২০২৩ সালের আগস্টে অনুমোদিত বিশ্বব্যাংকের ২০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা যেমন- উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয়ের মতো কর্মসূচিগুলো চালু রয়েছে। তবে এই কর্মসূচিগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদি সমর্থন প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যখাতে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত কর্মী না থাকা এবং উচ্চ চিকিৎসা ব্যয়, যা সবার জন্য সমানভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে প্রথমবারের মতো একটি জাতীয় মেডিকেল শিক্ষা কৌশল তৈরি করছে, যা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি মেটাতে সাহায্য করবে। পাঠ্যক্রম, অনুমোদন এবং শিক্ষক উন্নয়নের মতো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছে সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর বিভিন্ন দেশে সহায়তা করার ইতিহাস রয়েছে। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকটের সময় গ্লোবাল ফান্ড টু ফাইট; এইডস, টিউবারকিউলোসিস এবং ম্যালেরিয়া মোকাবিলায় ৯ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮৭ ডলারের জরুরি তহবিল অনুমোদন করেছিল, যাতে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।
বাংলাদেশের এই সংকটময় সময়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা অপরিহার্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন সংক্রান্ত এনজিওগুলোর একসঙ্গে কাজ করা জরুরি, যাতে দেশটির স্বাস্থ্যখাতের অগ্রগতি অব্যাহত থাকে এবং গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিগুলোতে গতি ধরে রাখা যায়।
এবং এক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশি জনগণের পক্ষ থেকেও বিশাল সমর্থন পাবে।
আমি তাদের দৃঢ়তা ও অভিযোজন বা মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করেছি। ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসে এক হাজারেরও বেশি গার্মেন্ট শ্রমিক নিহত হয়।
আমি ঢাকায় আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের সঙ্গে কাজ করেছি, যেখানে আমি প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মীদের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মৌলিক কৌশল শিখিয়েছি। এটি ছিল দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনাগুলোর একটি, যেখানে সম্পদ ও উপকরণের অভাব ছিল। তবুও, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এক হয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে যতটা সম্ভব মানুষকে উদ্ধার করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন।
এ ধরনের স্থানীয় ও বৈশ্বিক সহযোগিতার মানসিকতা বাংলাদেশকে গ্লোবাল সাউথের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন
ড. জুনায়েদ নবী একজন জনস্বাস্থ্য গবেষক, যিনি স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার ও উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করেন। তিনি পূর্বে বাংলাদেশে সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন (সার্ক) স্কলার হিসেবে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। বর্তমানে তিনি অ্যাস্পেন ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র ফেলো এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের মিলেনিয়াম ফেলো।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।