বাংলাদেশের ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড জয়
সময়টা ২০০৪ সাল। আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে (আইওআই) বাংলাদেশ দলের প্রথম পায়ের ছাপ পড়ল। তবে নিয়মানুযায়ী প্রথমেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া যায় না, প্রথমে অংশ নিতে হয় পর্যবেক্ষক হিসাবে। অলিম্পিয়াড, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা বা এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতাকে বাংলাদেশে প্রচলন করা এবং জনপ্রিয় করার অন্যতম পথিকৃৎ, বুয়েটের (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) অধ্যাপক কায়কোবাদ এই গুরু দায়িত্বটা নিলেন। পরের বছরই আইওআই কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ দলকে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাল।
অনেক দেশের ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় ধরে পর্যবেক্ষক হিসেবে থেকে যাওয়ার উদাহরণ থাকলেও, বাংলাদেশ এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকেনি। তবে দুঃখজকভাবে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ দল শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেনি পোলিশ ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায়। পরবর্তীতে ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বাংলাদেশ দল নিয়মিত আইওআই-তে অংশ নেয়, তবে সব সময় পুরো দল গঠন করতে পারেনি।
উল্লেখ্য যে, একটি দেশ থেকে সর্বোচ্চ চারজন প্রতিযোগী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেন। তো পুরো দল না গঠন করা গেলেও সাফল্য এসেছে। যেমন— ২০০৯ সালে দলের একমাত্র প্রতিযোগী হিসাবে আবির এক অসাধারণ ফলাফল করে বসেন; বাংলাদেশের প্রথম পদক হিসেবে সে সরাসরি রৌপ্য পদক ছিনিয়ে নেয়। সুতরাং, আইওআই এর সার্বিক পদক তালিকায় বাংলাদেশের প্রথম পদচারণা ব্রোঞ্জ দিয়ে নয়, বরং রৌপ্য দিয়ে। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে পুরো চারজনের দল পাঠিয়ে আসছে, যদিও ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাফল্য বলতে সর্বসাকুল্যে ৬টি পদক— একটি রৌপ্য (আবির এর কথা একটু আগেই বলেছি) আর বাকিগুলো ব্রোঞ্জ।
২০১৬-১৭ থেকে বাংলাদেশে ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডের কার্যক্রমে একটা গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসা হয় বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রেও অধ্যাপক কায়কোবাদের কথা স্মরণ করতেই হয়। তার উদ্যোগে বাংলাদেশ ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড কমিটি বা সংক্ষেপে বিআইওসি পুনর্গঠিত হয়। বুয়েটের সিএসই বিভাগের কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ/মাঝবয়সী শিক্ষক এবং ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড এবং আইসিপিসি প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার কয়েকজন অ্যালামনাই এই আসরে বাংলাদেশকে ভাল করানোর প্রতিজ্ঞায় এগিয়ে আসেন। এরমধ্যে, কায়সার আব্দুল্লাহ (প্রাক্তন প্রভাষক, সিএসই, বুয়েট এবং এখন গুগলে কর্মরত), নাফিস সাদিক (বর্তমানে গুগলে কর্মরত) এবং মির ওয়াসি আহমেদ (বর্তমানে গুগলে কর্মরত) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার। তারা পুরো কার্যক্রমকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হন।
কায়কোবাদ স্যারের বিশেষ অনুগ্রহভাজন হিসেবে এই দলের সাথে সেই সময় থাকার সৌভাগ্য আমার হয়, আর সেই সুবাদে এই কার্যক্রমের একজন গর্বিত সাক্ষী হিসাবে এই অধমকে তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, বিআইওসি এর তত্ত্ববধানেই বাংলাদেশে ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড কার্যক্রম চলে। ২০১৭ পরবর্তী সময়ে প্রথমে একটা প্রাথমিক রাউন্ড হয়, যেটা সারা বাংলাদেশ জুড়ে প্রায় ৬–৮ টি বড় শহরে একযোগে আয়োজন করতে হয় (এই আয়োজনগুলো করার ক্ষেত্রে দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব সময়েই আমাদেরকে সহায়তা করে এসেছে)। একযোগে আয়োজন করতে হয়, এর কারণ হল— এই পুরো প্রতিযোগিতাটি সিএমএস নামের একটি কন্টেস্ট ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার ব্যবহার করে করা হয়; যেখানে সারা দেশজুড়ে যত প্রতিযোগীই অংশ নেন না কেন, তাদেরকে একই সমস্যার সেট সমাধান করতে হয়। আর কেন সিএমএস কেই আমরা ব্যবহার করি? কারণ আই ও আই এর মূল প্রতিযোগিতা এটি ব্যবহার করেই হয়ে থাকে। আইসিপিসি প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার সাথে যারা পরিচিত, তাদের জন্য উল্লেখ করছি যে, আই ও আই তে কিন্তু প্রদত্ত সমস্যাগুলোর (টাস্ক) প্রতিটি (এক দিনে ৫ ঘণ্টায় মোট তিনটি সমস্যা থাকে) ১০০ নম্বরের হয়ে থাকে। ব্যবহৃত এলগরিদমের এফিসিয়েন্সি বা দক্ষতার ভিত্তিতে প্রতিটি টাস্কে বিভিন্ন নম্বরের সাব-টাস্ক থাকে। ফলে আইসিপিসি প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় একজন প্রতিযোগীর স্ট্রাটেজি আর আই ও আই এর স্ট্রাটেজি একরকম হয় না।
তো প্রাথমিক রাউন্ড থেকে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে প্রণীত মেধা তালিকা থেকে প্রথম প্রায় ৪০-৫০ জনকে মূল রাউন্ডে, অর্থাৎ বাংলাদেশ অলিম্পিয়াড ইন ইনফরমেটিক্স বা সংক্ষেপে বিডিওআই এর জাতীয় রাউন্ডে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ২০১৮ থেকে আমরা বিডিওআই এর জাতীয় রাউন্ডে দুইদিনব্যাপী কন্টেস্ট করে আসছি, কারণ আই ও আই তেও আসলে দুইদিন ব্যাপী কন্টেস্ট হয়ে থাকে।
২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত, প্রতিটি আসরেই বাংলাদেশের অবস্থান যথেষ্ট ভাল; ২০১৮ সাল ছাড়া এর প্রতিটি আসরেই আমাদের দল কমপক্ষে ৩টি পদক পেয়েছে, ২০১৭ সাল এবং ২০২১ সালে সকলেই (অর্থাৎ ৪টি) পদক পেয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৮ সালে দুটি পেলেও তার মধ্যে একটি কিন্তু রৌপ্য (তাসমিম) এবং অপরটি ব্রোঞ্জ (রিজওয়ান)।
উল্লেখ্য যে, ২০১৮ সালে তাসমিমের প্রথম দিনের ফলাফল ছিল স্বর্ণপদক রেঞ্জের; কিন্তু দ্বিতীয় দিন সে সেটা ধরে রাখতে পারেনি। আর ২০১৭ সালে সকলেই ব্রোঞ্জ (তাসমিম, জুবায়ের, রুহান, রুবাব) এবং ২০২১ সালে দুইটি রৌপ্য (মামনুন এবং ফারহান) এবং দুটি ব্রোঞ্জ (নাফিস এবং আরমান) অর্জন করেন। ২০১৯ এবং ২০২০ সালের এই দুই আসরেই বাংলাদেশ দল ছিল অভিন্ন এবং আমরা তিনটি করে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলাম (তাসমিম, রিজওয়ান এবং আরমান)। ২০২২ সালে আবারও আমরা রৌপ্য পাই (ফারহান) দুটি ব্রোঞ্জের সাথে (নাফিস এবং সোম্য)। ২০২৩ সালের ফলাফলও একই; একটি রৌপ্য (সৌম্য) এবং দুটি ব্রোঞ্জ (ফারহান এবং জারিফ)।
কিন্তু খুব কাছাকাছি আসলেও স্বর্ণপদকটা আমাদের অধরাই থেকে যাচ্ছিল। বলা যায়, আমাদের ১৮ বছরের প্রচেষ্টার সফলতা আসল এই ২০২৪ সালে এসে। আমাদের সোম্য স্বর্ণপদক ছিনিয়ে এনে বাংলাদেশের পতাকাকে সমুন্নত করলেন মিশরে আইওআই এর ৩৬তম আসরে এবং বাংলাদেশের ১৯তম অংশগ্রহণে (পর্যবেক্ষণসহ ধরলে ২০তম)। পাশাপাশি আকিব এবং জারিফ এর ব্রোঞ্জপদকের কথাও উল্লেখ্য।
মিশরের এই আসরটি অনেক কারণে আরও গুরুত্ববহ। এমন সময়ে এই আসরটি হল, যখন আমরা ১৫ বছরের দুঃশাসনকে পিছে ফেলে ছাত্রজনতার এক অভুতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছি। তাই বলা যায়, এই নতুন বাংলাদেশের সূচনালগ্নে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ এক আসরে সর্বোচ্চ ফলাফল ছিনিয়ে নিয়ে আসলাম। আমাদের মনে হচ্ছিল, এই গণ অভ্যুত্থানে শহীদদের সম্মানের জন্যই যেন এই সাফল্য, আর তাই তাদের প্রতি এই ফলাফলকে উৎসর্গ করা যায়।
এই আসরের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইদের ওপর ইসরায়েলের অন্যায্য আগ্রাসনের প্রতিবাদে আগামী আসর থেকে ইসরায়েলের প্রতিযোগীদেরকে ইসরায়েল দল হিসেবে অংশগ্রহণ না করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় (তারা অংশ নিতে পারবেন, কিন্তু ইসরায়েল কে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না এই শর্তে)।
মিশরে আমাদের সফরের রোজনামচা নিয়ে অন্য সময়ে লিখব, কারণ সেটা আরেক বিশাল কাহিনী হবে। বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা 'সোনার' সোম্য, 'রূপার' তাসমিম, মামনুন, ফারহান আর 'ব্রোঞ্জের' নাফিস, রিজওয়ানদেরকে নিয়েও আরেকদিন লিখতেই হবে। তারা বাংলাদেশকে আইওআই-তে প্রনিধিত্ব করেই থেমে থাকেননি, তারা নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের অলিম্পিয়াড কার্যক্রমকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। অন্য অনেকের মতো তারা এই কাজের জন্য কোনো স্বীকৃতির অপেক্ষায় থাকেননি (মজার ব্যাপার হল, আমাদের মাঝে অনেকেই আবার স্বীকৃতি 'হাইজ্যাক' করতে ওস্তাদ)।
তবে শেষ করার আগে কয়েকটা কথা না বললেই নয়। অলিম্পিয়াডগুলোর মধ্যে আইওআই-কে সবচেয়ে কঠিন বলে মনে করা হয়। এর কারণ হল, এই প্রতিযোগিতায় একজন প্রতিযোগীকে যেমন তার বিশ্লেষণ ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে হয়– দেওয়া সমস্যাটার সমাধান চিন্তা করে বের করার জন্য— আবার সমস্যা সমাধান করার পর সেটি দক্ষতার সাথে প্রোগ্রামিং করতে হয় এবং সেটাও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। তাই এই প্রতিযোগিতায় ভাল করতে গেলে অনেক অধ্যবসায় দরকার। আর আমাদেরও দরকার এই তরুণদেরকে যথাসম্ভব পৃষ্ঠপোষকতা করা। পৃষ্ঠপোষকতার প্রথম ধাপ হল, তাদেরকে উৎসাহিত করা। কিন্তু দেখা যায় যে, এই প্রতিভাবান ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের স্কুল/কলেজ থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেক সময়ই যথেষ্ট সহায়তা পায় না। আবার সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেও তাদের স্বীকৃত সেরকম নেই। হাত-পায়ের খেলাতে ভাল করলে স্বীকৃতির পাশাপাশি অঢেল টাকা পয়সাও মেলে, কিন্তু বুদ্ধির খেলাতে সেই সুযোগ কই?
যেহেতু আমাদের দেশে সেরকম কদর নেই, আমাদের এই প্রতিভাবান তরুণদের অনেকেই দেশে না থেকে বিদেশের পথে পাড়ি জমান, আর আমরা 'ব্রেইন-ড্রেইন' হয়ে গেল বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলি; কিন্তু তাদের স্বীকৃতি কিংবা থাকার জন্য চ্যালেঞ্জিং কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে ব্যর্থ হই। আর এই পুরো কার্যক্রমেও অনেক সহায়তা দরকার। যেহেতু এই প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করতে গেলে প্রতি প্রতিযোগীকে একটা উন্নত স্পেসিফিকেশনের কম্পিউটারে বসে কাজ করতে হয় এবং নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করতে হয়, সেহেতু এই আয়োজন খুব সহজ নয় এবং ব্যয়বহুলও বটে।
এই প্রসঙ্গে, ডাচ বাংলা ব্যাংকের কথা না স্মরণ করলেই নয়! মূলত ২০১৮ সাল থেকে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা আমাদের অলিম্পিয়াডের কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রচণ্ডভাবে সাহায্য করেছে। তবে আরও পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিশেষত এই তরুণদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। আশা করা যায়, যেই সরকারের প্রধান একজন নোবেল বিজয়ী, অন্তত সেই সরকারের আমলে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে নিয়ে যাওয়া তরুণ প্রতিভাবানেরা যথাযথ স্বীকৃতি পাবেই।
- লেখক: অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ, বুয়েট; ফেলো বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি এবং আইওআই-তে বাংলাদেশ দলের দলনেতা।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।)