‘দুর্গাপূজার উপহার’: সুস্বাদু ইলিশ কি ঢাকা-দিল্লির জটিল সম্পর্ককে সহজ করতে পারবে?
দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ৩,০০০ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ঢাকা-দিল্লির সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে এটি একটি ভালো পদক্ষেপ। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে একটি কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি।
এর আগে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দেশের চাহিদা মেটাতে ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করেছিল। এই নিষেধাজ্ঞা এমন সময়ে এসেছিল যখন ভারত-বান্ধব সরকার শেখ হাসিনার পতনের পর দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছিল।
ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত এমন সময়ে এসেছে যখন উভয় দেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষতি মেরামতের উপায় খুঁজছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুই দেশের প্রথম বৈঠক যা নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হবে। এ বৈঠকের এক সপ্তাহ আগে এ এ ইলিশ রপ্তানির ঘোষণা দেওয়া হয়।
ভারতীয় গণমাধ্যম শুরুতে ইলিশ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় এর সমালোচনা করেছিল। পরবর্তীতে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে এ সিদ্ধান্তের প্রশংসাও করে গণমাধ্যম। ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের শিরোনাম দেয়, 'দুর্গাপূজার উপহার: বাংলাদেশ ৩০০০ টন ইলিশ রপ্তানি করবে'।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকারের আরোপিত এ নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য একটি ধাক্কা ছিল। ভারতীয় গণমাধ্যম তাদের শিরোনামে নিষেধাজ্ঞার নিন্দা করেছিল।
উদাহরণস্বরূপ, হিন্দুস্তান টাইমস ১০ সেপ্টেম্বরে বলেছিল, "বাংলাদেশ খেলা নষ্ট করেছে, দুর্গাপূজার আগে ভারতে পদ্মার ইলিশ মাছ রপ্তানি নিষিদ্ধ"। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ইলিশ রপ্তানি নিষিদ্ধ করা 'একটি দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক রুচির ঐতিহ্যকে অমান্য করা'।
১৫ সেপ্টেম্বরে দ্য প্রিন্ট বলেছিল, 'বাংলাদেশ আমাদের সেখানে আঘাত করেছে যেখানে আমাদের ব্যথা লাগে। ইলিশ ছাড়া দুর্গাপূজা অসম্পূর্ণ থাকবে'। লেখাটিতে বলা হয়েছে, "ইলিশ শুধু একটি মাছ নয়। এটি একটি আবেগ এবং দীক্ষা উভয়ই। এটি এমন একটি খাবার যা আমাদের কাজ করতে বাধ্য করে। আমাদের এর অসংখ্য কাঁটা থেকে মিষ্টি পানির মাছের প্রায় নিখুঁত গঠন বুঝতে হয় এবং এটি পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজার সময় আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।"
সুস্বাদু ইলিশ রপ্তানির খবরে মেজাজ বদলে গেছে। দুর্গাপূজা উৎসবের জন্য ভারতের 'বিশেষ অনুরোধে' সাড়া দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইলিশ মাছ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
হাসিনা শাসনের পতনের পর গণঅভ্যুত্থানে গঠিত মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাক্ষাৎকারে এই পদক্ষেপ একটি ভালো অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তৌহিদ ও জয়শঙ্কর উভয়েই পেশাদার কূটনীতিবিদ। তারা ইতোমধ্যে ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কথা বলেছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, "সব সমস্যা সমাধান করে আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে আমাদের সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে চাই।"
দুই দেশের মধ্যে চলমান বর্তমান উত্তেজনা স্বীকার করে তৌহিদ বলেছেন, "আমাদের এ উত্তেজনা অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে। আমরা যদি সমস্যাগুলো মোকাবেলা না করি তাহলে আমরা সেগুলো সমাধান করতে পারব না।"
চার দিন আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বরে জয়শঙ্কর এনডিটিভিকে বলেছিলেন, "বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতন সেই দেশের 'অভ্যন্তরীণ বিষয়'। কিন্তু ভারত তাদের সঙ্গে একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক চালিয়ে যেতে আগ্রহী। কারণ প্রতিবেশীগুলো একে অপরের ওপর নির্ভরশীল।"
জয়শঙ্কর আরও বলেছিলেন, "যা ঘটছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ আমাদের প্রতিবেশী এবং সম্পর্কটি আমাদের দিক থেকে স্থিতিশীল রাখতে চাই। আমাদের ভালো বাণিজ্য আছে। আমাদের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক ভালো। আমি এ সম্পর্কটি এভাবেই রাখতে চাই।"
যদিও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নরেন্দ্র মোদি ও মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে সাক্ষাতের সম্ভাবনা কম। কারণ বাংলাদেশি সমকক্ষ ড. ইউনূস পৌঁছানোর আগেই মোদি নিউইয়র্ক ছেড়ে যাবেন বলে কথা রয়েছে। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে এ আলোচনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পেশাদার কূটনীতিবিদ হিসেবে তৌহিদ ও জয়শঙ্কর দুজনই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি ভালোভাবে জানেন। তাছাড়া দুর্গাপূজার উপহার এ ইলিশ রপ্তানি হাসিনা পরবর্তী উত্তেজনাকে প্রশমিত করে দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নে অবদান রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
ইলিশ কূটনীতির সাফল্য ও ব্যর্থতা
ইলিশ কূটনীতি আড়াই দশকেরও বেশি আগে চালু করেছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি এ নীতি চালেু করেছিলেন।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের আগে হাসিনা তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ইলিশ পাঠিয়েছিলেন। এটি ছিল ইলিশ কূটনীতির সূচনা।
তিনি বছরের পর বছর ধরে কূটনীতির এই নতুন রূপ চালিয়ে গেছেন। ২০১০ সালে, তিনি অন্যান্য উপহারের সাথে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের জন্যও ইলিশ নিয়ে গিয়েছিলেন। আবার, ২০১৬ সালে তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আগে তিনি মমতাকে ২০ কেজি ইলিশ পাঠিয়েছিলেন।
২০১৭ সালের এপ্রিলে, ভারত সফরকালে হাসিনা তাঁর ইলিশ কূটনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। তিনি রাষ্ট্রপতি প্রণবের জন্য ২০ কেজি ইলিশ ও অন্যান্য উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা আশা করছিলেন এতে হয়ত তিস্তা ইস্যুতে স্থবিরতা ভাঙবেন।
সফরকালে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনের রান্নাঘরের দায়িত্ব নিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রপতির রাতের খাবারের জন্য 'স্টিমড ইলিশ বা ভাপা ইলিশ' রান্না করেছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে, ইলিশ কূটনীতি তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে স্থবিরতা ভাঙ্গতে ব্যর্থ হয়েছিল। মমতার বিরোধিতার কারণে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করা যায়নি।
২০১১ সালে, যখন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকায় সফরকালে তিস্তার বিষয়ে বড় ঘোষণা দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু সেখানেও বাধা দেন মমতা।
মোদি সরকার গত দশকে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি। ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন ঢাকা সফরে আসেন, তিনি তিস্তা ইস্যু সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে হাসিনা যখন নয়াদিল্লি সফর করেন মোদিও তখন একই আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
এমনকি ২০১৭ সালে বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল, তখন হাসিনা সরকারের দুই মিত্র ভারত ও চীন রোহিঙ্গা নির্মূল বন্ধ করতে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে তার পাশে দাঁড়ায়নি।
২০১৫ সালে মোদির প্রথম ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ ভারতের সাথে একটি 'শক্তিশালী বন্ধন' অনুভব করেছিল এবং আশা করা হয়েছিল এতে 'দুই দেশের জনগণের পাশাপাশি অঞ্চলের উপকারও হবে।' ২০১৬ সালে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং যখন ঢাকায় এলেন তখন ঢাকা বেইজিংয়ে একটি 'নতুন কৌশলগত অংশীদার' পেয়েছিল।
কিন্তু উভয় মিত্রই বাংলাদেশের এ আহ্বান উপেক্ষা করেছিল। কারণ তারা মিয়ানমারে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে প্রতিযোগিতায় ছিল এবং এখনও আছে।
এখন বাস্তবতা ভিন্ন। কারণ শেখ হাসিনার পতনের পর ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে সম্পর্ক সবচেয়ে অবনতি ঘটেছে। সমালোচকরা বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ভারতের নীতিকে দায়ী করেছেন। হাসিনার আওয়ামী লীগ ছাড়া ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বর্তমান বিরোধী দল ও তার মিত্রদের তার স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে আসছে এবং তাদেরকে 'বিপজ্জনক ইসলামি শক্তি' হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন এখন নতুন করেন শুরু করা প্রয়োজন।
ইলিশ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার মানে ইলিশ কূটনীতির পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। দ্য টেলিগ্রাফের আখ্যা দেওয়া 'দুর্গাপূজার উপহার' কি এ উত্তেজনা প্রশমিত করে সম্পর্কের নতুন সূচনা করতে পারবে?
এ বিষয়ের প্রাথমিক দায়িত্ব এখন তৌহিদ হোসেন ও এস জয়শঙ্করের উপর। কারণ শেখ হাসিনার পতনের পর দুই দেশের উত্তেজনা কীভাবে কমানো যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে তারাই প্রথম একটি দ্বিপাক্ষিক সম্মেলনে বৈঠক করতে যাচ্ছেন।