‘মব জাস্টিস’ উত্থানের নেপথ্যে
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার শাসন অবসান হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে সহিংসতা, নারী হয়রানি এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকার থেকে ক্রমাগত সতর্কতা এবং ব্যাপক জনরোষ সত্ত্বেও, কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দ্রুত বা যথেষ্ট পদক্ষেপের আপাত অভাব রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
এমনকি সম্প্রতি বুধবারে (১৮ সেপ্টেম্বর) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) ভোররাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত আরেক ব্যক্তিকে একইভাবে হত্যা করা হয়, যার সাথে "সাধারণ ছাত্র" জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে বুধবার সকালে, প্রায় ৪০ জনের একটি দল কুড়িল টোল প্লাজায় ব্যারিকেড ভাংচুর করে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কয়েকজন শ্রমিককে লাঞ্ছিত করে এবং একটি পিকআপ ভ্যানের ক্রসিং ঘিরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
'মব জাস্টিস' এর নামে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার পেছনের কারণগুলো অন্বেষণ করতে এবং ভবিষ্যতে এই জাতীয় ঘটনা প্রতিরোধ করার সম্ভাব্য ব্যবস্থা নিয়ে বিশেষজ্ঞ সারা হোসেনের মতামত নিয়েছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
'জবাবদিহিতার জন্য গুরুতর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে, যেটা দেখানোর মাধ্যমে এই ধরনের (মব জাস্টিস) আরও ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব'
"মব জাস্টিস" শব্দটি একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা বা এক বা একাধিক ব্যক্তির মাধ্যমে সম্পত্তি ধ্বংসের ঘটনা বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক এবং এসব প্রতিরোধ করার পাশাপাশি জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনতে জরুরী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন৷
আমাদের এসবের পেছনের কারণগুলোকেও মোকাবিলা করতে হবে। পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে এসব ঘটনা ঘটেছিল এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, একটি সংস্থা ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে 'মব-এর হামলায়' ১ হাজার ২৩৮ জন মারা যাওয়ার কথা জানিয়েছে। এছাড়া, ২০১৫ সালের একটি ঘটনায়, লোকেরা গুলি চালিয়ে এবং লোহার রড দিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার গাড়িবহর ভাঙার চেষ্টা করে।
সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবং বিভিন্ন ধরনের মানুষের বিরুদ্ধে একাধিক 'মব জাস্টিস'-এর অবতারণা ঘটেছে; যার স্বীকার হয়েছে, নারীরা, অসহায় গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দলের সদস্যরা এবং আদালতে জুলাই-অগাস্টে ঘটে যাওয়া ছাত্র হত্যা ও অন্যান্য হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত উচ্চপদস্থ সাবেক মন্ত্রীরা।
কিছু ক্ষেত্রে, যারা হামলা চালিয়েছে তারা মানুষকে মারধর করেছে বা তাদের অপমান করেছে। এসব ব্যক্তিরা, রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত শত্রুতা বা বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থার অভাব থাকায় এমন ঘটনা ঘটিয়েছে বলে মনে হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অনুপস্থিত থাকলে বা কাজ করতে ব্যর্থ হলে এসব ঘটনা ঘটে।
উদাহরণস্বরূপ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল দুটি পোস্টে দেখা গেছে, ঢাকা এবং কক্সবাজারে কয়েকজন মহিলাকে প্রকাশ্য স্থানে পৃথকভাবে পুরুষরা হয়রানি, অপমান এবং মারধর করছে। অধিকার গোষ্ঠীগুলোকে প্রশাসনকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে, কিন্তু অন্যজনকে নয়।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, ছাত্র সমন্বয়কারী ও জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদসহ অন্যরা বারবার বলেছেন, কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে; তবুও সময়োপযোগী এবং নিরপেক্ষ তদন্ত, বিচার এবং দায়ীদের শাস্তি হওয়া জরুরী।
সম্ভবত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা সহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এই ধরনের আক্রমণ রোধ করতে পারে, তবে এটি দেখার বাকি রয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক এবং শৃঙ্খলামূলক নিষেধাজ্ঞাও থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আইনজীবীদের ওপর আদালতে শালীনতা বজায় রাখার, আদালত প্রাঙ্গণে লোকেদের আক্রমণ বা ভয় দেখান থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব থাকে– তবে তাদের বার কাউন্সিল বা বার অ্যাসোসিয়েশন থেকে অনুমোদন দেওয়া উচিত।
কেউ কেউ হয়ত বছরের পর বছর ধরে নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হয়ে, কয়েক মাস বা বছরের জন্য জেলে থাকার পরে এবং ক্ষমতাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দায়ের করা একাধিক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাদের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস হওয়ার পর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে।
যারা এ ধরনের আইন লঙ্ঘন করেছে বা নির্দেশ দিয়েছে, তাদের জবাবদিহির জন্য একটি গুরুতর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে– সেটা দেখানো "মব জাস্টিস"-এর মতো ঘটনাকে প্রতিরোধ করতে পারে।
সারা হোসেন সুপ্রিম কোর্ট-এর এডভোকেট এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক।