হামাস ও ইসরায়েল যুদ্ধ: পক্ষ বাছাই করতে হবে চরমপন্থী বনাম শান্তিকামীদের মধ্যে

ইসরায়েলের ওপর হামাসের আক্রমণের নিঃশর্ত সমালোচনা করা উচিত। হামাস এ হামলার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র ও সকল ইসরায়েলিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্য প্রকাশ করেছে।
প্রায় এক দশক আগে জেরুজালেমের সড়কে আত্মঘাতী হামলাগুলোর কথা মনে করুন। সাধারণ কোনো ফিলিস্তিনি কোনো ইহুদির কাছে গিয়ে ছুরিকাহত করতেন। ওই ফিলিস্তিনি ঠিকই জানতেন, তাকে তৎক্ষনাৎ মেরে ফেলা হবে। তবে সেসব 'সন্ত্রাসবাদী' কর্মকাণ্ডে কোনো বার্তা ছিল না, 'ফ্রি ফিলিস্তিন' চেঁচিয়েও কেউ হামলা করত না। তাদের পেছনে কোনো বড় সংগঠন ছিল না। সেগুলো ছিল ব্যক্তির বেপরোয়া সহিংস আচরণ।
কিন্তু পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেল যখন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু উগ্র-ডানপন্থী, বসতি-স্থাপনের সমর্থক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন সরকার গঠন করলেন।
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির বিশ্বাস করেন: '[পশ্চিম তীরে] মুক্তভাবে চলার জন্য আরবদের অধিকারের চেয়ে আমার, আমার স্ত্রীর, সন্তানদের অধিকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ।' আরব-বিরোধী চরমপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তার যোগসাজশ থাকায় অতীতে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি।
মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের জাহির করার পর ইসরায়েল এখন থিওক্রেটিক রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। ইসরায়েল সরকারের দাপ্তরিক প্রোগ্রামে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আলোচনার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
হামাস এবং ইসরায়েল – দুপক্ষেরই অতি-জাতীয়তাবাদী সরকার যেকোনো ধরনের শান্তি-সমঝোতার বিরুদ্ধে — এটা এখন দেখতে পারাটা কঠিন কিছু নয়। দুপক্ষই লড়াই করে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করছে।
হামাস ইসরায়েলে এমন সময় আক্রমণ করল যখন ইসরায়েলের অভ্যন্তরেই বড় দ্বন্দ্ব চলমান। আর এ দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে নেতানিয়াহু সরকারের রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার উদ্যোগ।
ইসরায়েল জাতীয়তাবাদী মৌলবাদী এবং সুশীল সমাজের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট। প্রথম পক্ষ দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চিহ্ণ করে দিতে চায়। অন্যদিকে সুশীল সমাজের এ হুমকির বিষয়ে ধারণা থাকলেও তারা এখনো তুলনামূলক মডারেট ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যোগ দিতে চায় না। বর্তমানে দেশটির এ সাংবিধানিক সংকট একপাশে রাখা হয়েছে এবং জাতীয় ঐক্য সরকার গঠন করা হয়েছে।
নিজের ঘরে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য বাইরের শত্রু কি একান্তই প্রয়োজন? এ দুষ্টচক্র ভাঙার কোনো উপায় আছে কি?
সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্টের মতে, সামনে এগোনোর রাস্তা হচ্ছে হামাসের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার পাশাপাশি যেসব ফিলিস্তিনি ইহুদিবিদ্বেষী নয় এবং যারা আলোচনার জন্য প্রস্তুত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করা। ইসরায়েলি অতি-জাতীয়তাবাদীরা যা-ই দাবি করুক না কেন, আলোচনায় বসতে প্রস্তুত অনেক ফিলিস্তিনিই বাস্তবে আছেন।
যখন থেকে আমরা স্বীকার করব যে সব ইসরায়েলি গোঁড়া জাতীয়তাবাদী নয়, সব ফিলিস্তিনি গোঁড়া ইহুদি-বিদ্বেষী নয়, তখনই আমরা সমস্ত সংঘাত, অমঙ্গলের পেছনের হতাশা আর বিভ্রান্তিকে বুঝতে পারব। আমরা দেখতে পাব — ফিলিস্তিনি, যাদের জন্মভূমি থেকে তাদেরকেই বঞ্চিত করা হচ্ছে এবং ইহুদি, যাদের অতীতের ইতিহাসও একই কথা বলে — তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক মিল রয়েছে।
ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ইহুদিদের সংগ্রামের সময় 'সন্ত্রাসী' শব্দটি একটি ইতিবাচক অর্থ ধারণ করত। মার্কিন সংবাদপত্রে তখন 'সন্ত্রাসীদের' পক্ষে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল, সেখানে ইহুদিদের সাহসী বন্ধু হিসেবে অভিহিত করে বলা হয়েছিল, মার্কিন ইহুদিরা তাদের সঙ্গে আছে।
কে সন্ত্রাসী, কে নয় এ বিতর্কের মাঝেই একটি বিশালসংখ্যক ফিলিস্তিনি আরব কয়েক দশক ধরে অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন। তারা কারা, তাদের ভূমি কোনটা? তারা কি 'দখলিকৃত ভূমি'র, 'পশ্চিম তীরের, 'জুডিয়া ও সামারিয়া'র নাকি ২০১২ সাল থেকে ১৩৯টি রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের অ-সদস্য পর্যবেক্ষক দেশ দ্বারা স্বীকৃত রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের বাসিন্দা?
তারপরও ওই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণকারী ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের অস্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বিবেচনা করে। ইসরায়েলের কাছে কেবল ইহুদিদের জন্য 'স্বাভাবিক' রাষ্ট্র স্থাপনের প্রতিবন্ধকতা এই ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েল কখনো তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়নি, আশা দেখায়নি, ইতিবাচক কোনো সম্ভাবনার কথাও বলেনি।
হামাস ও ইসরায়েলি চরমপন্থীরা একই মুদ্রার দুই রূপ। আর এ সংকটে বেছে নেওয়ার বিকল্প এ দুপক্ষ নয়, বরং মৌলবাদী এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসীরা। ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি চরমপন্থীদের পক্ষে কোনো আপস হতে পারে না, তাদেরকে পরাস্ত করতে হবে ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই ও ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে কথা বলে।
এ কথাটা যতই ইউটোপিয়ান শোনাক, দুটো সংগ্রামই একই ধরনের। যেকোনো আক্রমণ থেকে ইসরায়েলের নিজেদের সুরক্ষার অধিকারকে যেমন নিঃশর্তভাবে সমর্থন দেওয়া উচিত, তেমনি আমাদেরকে নিঃশর্তভাবে গাজা ও দখলিকৃত ভূমির ফিলিস্তিনিদের চরম ও আশাহীন পরিস্থিতির সঙ্গে সহানুভূতি জ্ঞাপন করতে হবে। যারা ভাবেন এখানে একটা 'বৈপরীত্য' আছে, তারাই আদতে এ সংকট সমাধানে বাধা সৃষ্টি করছেন।
স্লাভয় জিজেক: লেখক; অধ্যাপক, দর্শন, ইউরোপিয়ান গ্র্যাজুয়েট স্কুল; ইন্টারন্যাশনাল ডিরেক্টর, ব্রিকবেক ইনস্টিটিউট ফর দ্য হিউম্যানিটিজ অ্যাট দ্য ইউনিভার্সিটি অভ লন্ডন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: সংক্ষিপ্ত অনুবাদ, পরিবর্তিত শিরোনাম। নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।