বিচারপতি কি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিতে পারেন!
ভারতীয় উপমহাদেশের দুটি দেশে আদালতকে কেন্দ্র করে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধান বিরোধী নেতা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একজন জেলা পর্যায়ের নারী জয়েন্ট ডিস্ট্রিক্ট জাজকে উদ্দেশ্য করে গণজমায়েতে মন্তব্য করাতে, ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তাকে আদালত অবমাননার শুনানিতে তলব করেন।
ইমরান খান জয়েন্ট ডিসট্রিক্ট জাজ সমতুল্য নারী বিচারক জেবা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়েছিলেন। ওই নারী বিচারকের আদালতে ইমরান খানের দলের এক নেতার রিমান্ড আবেদন করেছিল পুলিশ। সেই রিমান্ড আবেদনে সাড়া দিয়ে দুদিনের রিমান্ড দিয়েছিলেন ওই বিচারক। তার এই রিমান্ড দেওয়া ইমরান খান পছন্দ করেননি, তিনি বিচারককে হুমকি দেন।
সরাসরি বিচারকের বিরুদ্ধে এই ধরনের মন্তব্য করার ফলে উচ্চ আদালত অর্থাৎ ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আদালত অবমাননার অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এই অভিযোগ উত্থাপনের পরে ইমরান খান উচ্চ আদালতে উপস্থিত হয়ে সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনা করেন তার মন্তব্যের জন্য। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিচারিক আদালতের সেই নারী বিচারকের আদালতে উপস্থিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করেন। মামলাটির পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে ৩ অক্টোবর।
পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধী দলের নেতা বিশ্বখ্যাত এই মানুষটি বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশের মানুষকে উসকে দেওয়ার জন্যই এরকম মন্তব্য করেছেন বলেই ধারণা করা যেতে পারে। পরিণতিতে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার যে ঘাটতি রয়েছে তা-ই প্রমাণ করল। পাকিস্তানের বিচারাঙ্গণের এমনি সব নানান বিষয়ে বহুকাল ধরেই চলছে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি সংঘটিত হয় ভারতের পশ্চিমবাংলার হাইকোর্টের একজন বিচারকের টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়া নিয়ে।ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে একটি দ্বৈত বিচার ব্যবস্থা চালু ছিল, যা ১৮৫৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন বিলুপ্তির মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলে ভারতীয়দের জন্য যে আদালত ছিল তার নাম সদর আদালত। তার দুটি অংশ ছিল।
আর সুপ্রিমকোর্ট নামক তার একটি প্রতিষ্ঠান ছিল যা কেবলমাত্র ইউরোপিয়ানদের জন্য সীমিত ছিল। ভারতীয়দের কোন উচ্চ আদালত ছিল না। ১৮৫৭ সনের সিপাহী বিপ্লবের পরিণতিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশে তার শাসন ক্ষমতা হারায়। ১৮৫৯ সাল থেকে ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সরাসরি ভারত শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। রানি ভিক্টোরিয়া ভারত শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে প্রথমেই ভারতের বিচার বিভাগের সংস্কার সাধিত হয়। ১৮৬১ সালের হাইকোর্ট স্থাপনের আদেশের ফলে ১৮৬২ সালের পহেলা জুলাই ভারতের কলকাতায় প্রথম হাইকোর্ট স্থাপিত হয়। দেড়শ বছরের অধিক কালের এই পুরনো হাইকোর্টটি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম হাইকোর্ট।
এই প্রাচীন হাইকোর্টেরই একজন বিচারক অভিষেক গাঙ্গুলী। সম্প্রতিককালে এবিপি আনন্দ নামক একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে দুই পর্বের এক সাক্ষাৎকার প্রদান করেন যা এই উপমহাদেশের এক বিরল ঘটনা। কর্মরত বিচারক কিংবা বিচারপতিরা কখনো কখনো এজলাসে মামলা পরিচালনার সময়ে নানান বিষয়ে ছোটখাটো মন্তব্য করে থাকেন। কিন্তু বিচার বিভাগকে নিয়ে সরাসরি টেলিভিশনের সামনে বক্তব্য তুলে ধরার প্রথম নজির স্থাপন করেছেন এই বিচারপতি অভিষেক গাঙ্গুলী।
অভিষেক গাঙ্গুলীর ব্যক্তি জীবনেও চমৎকারিত্ব আছে। আদি কলকাতা নিবাসী আইনজীবী পরিবারের সন্তান এই গাঙ্গুলী। স্নাতক শেষে দীর্ঘদিন বেকার থাকার পরে ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার দিয়ে চাকরি নেন ভূমি অধিদপ্তরে। এই দপ্তরের কর্ম থাকা অবস্থায় নানান অনিয়মের সঙ্গে তাল মিলাতে না পেরে চাকরি ত্যাগ করেন এই বিচারপতি। তারপর তিনি আইনজীবী হিসাবে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। ২০১৮ সালে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এই বিচারপতি। বিচারক আদালতে একক বেঞ্চে তার নানান আদেশ মোটামুটি সারাদেশের নজর কাড়ে ।
একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা দশ বছর যাবত তার অবসর ভাতা না পাওয়ার ফলে আদালত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার পাওনা পরিষদের জন্য নির্দেশ দেয়, এবং সে আদেশ কার্যকর হয়। সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটায় এই আদালত তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে স্কুল শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত এক ব্যাপক জালিয়াতির বিষয়টি উদঘাটন করেন সিবিআই তদন্তের মাধ্যমে। এবং কোটি কোটি টাকা লেনদেনের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। ফলে অভিষেক গাঙ্গুলীর আদালত ও সমস্ত আদেশকে কেন্দ্র করে তৃণমূল কংগ্রেসের আইনজীবীরা তার আদালত বর্জনের হুমকি দেয়। এবং আরো কিছু ঘটনা ঘটে, কিন্তু বিচারপতি অভিষেক গাঙ্গুলী তার দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখে।
এবিপিতে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারের অভিষেক গাঙ্গুলী বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেন: তার মধ্যে প্রধানত হচ্ছে তার ব্যক্তি জীবনের কিছু ঘটনা। যেমন বিচারপতি হওয়ার পরে ব্যক্তি জীবনে তাকে অনেক বন্ধুকে ত্যাগ করতে হয়েছে। তবে তার সরাসরি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার প্রদানের যুক্তি কি বোঝা গেল না। তার এই সাক্ষাৎকার প্রচার স্থগিত রাখার জন্য কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চের শরণাপন্ন হয়েছিলেন একদল উকিল। কিন্তু তাদের সে আবেদন প্রধান বিচারপতির এজলাস খারিজ করে দেন এবং বিচারপতি গাঙ্গুলীর মত প্রকাশের উপর কোন বাধার সৃষ্টি করেন নাই।
মমতা ব্যানার্জির ভ্রাতুষ্পুত্র অভিষেক ব্যানার্জি। তিনি এই বিচারককে উদ্দেশ্য করে বেশ কিছু মন্তব্য ছুড়ে দেন। বিচারপতি গাঙ্গুলি সে বিষয়েও তার সাক্ষাৎকারে কথা বলেন। অভিষেক ব্যানার্জির বিরুদ্ধে তিনি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতেন তা সাক্ষাতকারে উল্লেখ করেন। একই সাথে তিনি দ্বৈত বেঞ্চে মমতা ব্যানার্জির ভ্রাতুষ্পুত্র অভিষেক ব্যানার্জির করা মন্তব্য গুরুত্ব না পাওয়াতেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
প্রশ্ন হলো, টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে আদালতের একজন বিচারক কিভাবে দ্বৈত বেঞ্চ সম্পর্কে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন? এটা বিচারবিভাগকে শক্তিশালী করে না দুর্বল করে সেটিও একটি প্রশ্ন?। আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থায়ও নানান ইতিহাস আমরা স্মরণ করতে পারি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মামলা যখন উচ্চ আদালতে চলছিল তখন একাধিক বিচারপতি সেই মামলা পরিচালনায় অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন।
এছাড়াও আরও বেশ কিছু ঘটনা আছে যা আমাদের দেশের বিচারবিভাগ সম্পর্কিত সচেতন মানুষদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে সব সময়। নারীর পোশাক সম্পর্কিত মন্তব্য, জামিন আদেশ, আবার সেই আদেশ স্থগিত হওয়া সবই দেশের সচেতন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৬ সংশোধনী বাতিলের আদেশের উপর আপিল বিভাগের রিভিউ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দেশের বিচারবিভাগ সম্পর্কিত বিষয়ে যারা দৃষ্টি রাখেন তারা এই রিভিউ রায়ের বিষয়ে আগ্রহ সহকারে অপেক্ষা করছেন। রিভিউ পিটিশন ফলাফলের কি হয় দেখার জন্য।