ডেঙ্গু হলেই রক্ত বা প্লাটিলেট দেওয়ার দরকার নেই

অনেকেই প্রশ্ন করেন, ডেঙ্গু হলে রক্ত দিতে হবে কি না, বা প্লাটিলেট কমে গেলে প্লাটিলেট দিতে হবে কি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু রোগীকে রক্ত দেওয়ার দরকার নেই। হিমোগ্লোবিনের লেভেল ভালো থাকলে, রক্তক্ষরণ না হলে রক্ত দেওয়ার দরকার নেই। যদি ব্লিডিং বেশি হয়, তাহলে ডাক্তার প্রয়োজন মনে করলে রক্ত দিতে পারেন। 'ব্লাড ফর ব্লড', অর্থাৎ ব্লাড লস হলে ব্লাড দিতে হতে পারে, নাহলে দরকার নেই। রক্তের জন্য রক্ত, ডেঙ্গুর জন্য নয়।
এছাড়া প্লাটিলেট যদি কমে যায়, তাতেও মানুষ অস্থির হয়ে যায়। আসলে অধিকাংশ রোগীকে প্লাটিলেট দেওয়ার দরকার হয় না। প্লাটিলেটের মাত্রা ২০-৩০ হাজারে নেমে এলেও প্লাটিলেট দরকার হয়। সাধারণত জ্বরের চার-পাঁচ দিন পর প্লাটিলেট কমতে থাকে। আবার ৬ দিন পর ন্যাচারাল ওয়েতে প্লাটিলেট বাড়তে থাকে। সেজন্য ডেঙ্গু হলেই রক্ত নিয়ে ভয় পাওয়া যাবে না। প্লাটিলেট দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বিশেষ দুই-একটা কেসে প্লাটিলেট দেওয়ার দরকার হতে পারে, নিয়মিত সবাইকে প্লাটিলেট দেয়ার দরকার নেই। মানুষ যেন ভুল না বোঝে যে ডেঙ্গু হলে রক্ত বা প্লাটিলেট দিতে হবে।
সাধারণত ডেঙ্গু হলে প্রায় ৯০ শতাংশ রোগী বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হতে পারে। ডেঙ্গু হলে প্যারাসিটামল ছাড়া কোনো ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা যাবে না। ডেঙ্গুতে পেইনকিলার খেলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ে। প্রচুর পরিমানে পানি, শরবত, গ্লুকোজ, ডাব খেতে হবে। জ্বর থাকলে গা স্পঞ্জ করতে হবে। এতেই অধিকাংশ রোগী সুস্থ হয়ে যাবে। তবে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে, যাতে প্লাটিলেট টেস্ট করে দেখা যায়। রক্তের প্লাটিলেট তিন-চার দিন পরপর পরীক্ষা করে দেখতে হয়, কারণ এটি কমতে থাকলে ঝুঁকিটা বাড়ে। তাই প্লাটিলেট ১ লাখের নিচে নামলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াটা নিরাপদ। এছাড়া প্রেশার কমে গেলে, খেতে না পারলে, বমি হলে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এগুলো শকে চলে যাওয়ার লক্ষণ।
ডেঙ্গু সাধারণত ক্ল্যাসিক্যাল ও হেমোরেজিক। ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু রোগীদের শরীরে অনেক ব্যথা হয়, তীব্র জ্বর হয়। কিন্তু এখন ডেঙ্গুর লক্ষণে কিছু পরিবর্তন এসেছে। সাধারণত জ্বরে চার-পাঁচ দিন পর প্লাটিলেট কমে যায়, কিন্তু ইদানিং দুই-একদিনের মধ্যে প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। আবার অনেকের প্রচণ্ড জ্বরও হয় না। কিছু কিছু লক্ষণ মডিফাইড হচ্ছে। বর্তমানে যেহেতু ডেঙ্গু সিজন চলছে, তাই জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা হলে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। ডেঙ্গু শুরুতে ডায়াগনসিস করা গেলে জটিলতা কম হয়।
সাধারণত যেকোনো ভাইরাস সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে চলে যায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যারা বাড়িতে চিকিতসা নেয়, তারা সাধারণত সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে সুস্থ্ হয়ে যায়।
ষাটোর্ধ্ব, কিডনি, হার্টের রোগসহ যারা বিভিন্ন ধরনের কো-মর্বিডিটিতে ভোগে তাদের ডেঙ্গু পজিটিভ হলে হাসপাতালে যেতে হবে। তাদের ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ অনেক হার্টের রোগী ব্লাড থিনার খায়, অ্যাসপিরিন খায়—তাদের ডেঙ্গু হলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে সেসব ওষুধ কিছুদিন বন্ধ রাখতে হবে, তারপর সুস্থ হলে আবার খেতে পারবে।
ডেঙ্গু যেহেতু ভাইরাস, তাই অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার নেই। সেকেন্ডারি ইনফেকশন থাকলে ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন।
শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়াই ঝুঁকিটা বেশি। শিশুরা দিনে ঘুমায়। এডিস মশাও দিনে কামড়ায়, তাই মশারি টানাতে হবে দিনের বেলা। ছোট বাচ্চারা স্কুলে বা বাড়িতে হাফ প্যান্ট পরে, সেজন্য পায়ে মশা কামড়ায়। ডেঙ্গুর মৌসুমে বাচ্চাদের ফুল প্যান্ট, ফুল হাতা জামা পরলে ভালো হয়্। ডেঙ্গু ছোঁয়াচে রোগ না, ডেঙ্গু আক্রান্ত মায়েরা সন্তানকে ব্রেস্ট ফিড করাতে পারবেন।
এখন কোভিড রোগীও বাড়ছে। অন্যন্য সিজনাল জ্বর হচ্ছে। একইসাথে কোভিড ও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তাই জ্বর হলে ডেঙ্গু ও কোভিড টেস্ট করতে হবে। অবহেলা করা যাবে না। করোনায় কিছু কিছু ওষুধ দেওয়া হয়, যেগুলো ডেঙ্গুতে দেওয়া যায় না। করোনা ও ডেঙ্গু দুটোই হলে কী করতে হবে, সে চিকিৎসা ডাক্তারদের জানা আছে; কিন্তু রোগীকে সময়মতো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
ডেঙ্গুর কার্যকরী ভ্যাকসিন এখনো আবিস্কার হয়নি। ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ—ডেন ১, ২, ৩, ৪। একটি সেরোটাইপ দ্বারা কেউ একবার আক্রান্ত হলে পরেরবার অন্য সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হয়। চারটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধে কাজ করবে এমন ভ্যাকসিন এখনো নেই।
করোনাভাইরাস অদৃশ্য শত্রু, কিন্তু ডেঙ্গুর শত্রু চেনা। এডিস মশা থেকে ডেঙ্গু হয়। ডেঙ্গু ছিল, আছে; নির্মূল বোধহয় সম্ভব না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। প্রশাসন ও জনগণ সমন্বিতভাবে কাজ করলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। যখন ডেঙ্গু আসে তখন মশা মারার তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু শীতেও ডেঙ্গু রোগী কিছু পাওয়া যায়। তাই বছরব্যাপী সমন্বিতভাবে মশক নিধন কার্যক্রম বজায় রাখতে হবে। বাড়িতে, রাস্তায়, নির্মাণাধীন বাসায় জমা পানিতে মশা জন্মায়। নিজের বাড়ি নিজেকে পরিষ্কার রাখতে হবে। ৫ দিনের বেশি জমা পানি রাখা যাবে না।
- ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক