জঁ লুক গদার সম্পর্কে দু-একটি জানা কথা, আরেকবার

১
'ত্রুফো মারা যাওয়ার পর আন মারি মিয়েভেল আমায় বলেছিলো—এখন সে মৃত, এখন তোমায় কে বাঁচাবে?', যেহেতু সে ছিলো নবতরঙ্গের একমাত্র মানুষ যাকে প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করেছিলো, অন্তত চেষ্টা করেছিলো গ্রহণের।' গদারের এই মন্তব্যের পর জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো—কেমন করে তিনি আপনাকে রক্ষা করেন?
১৯৫৯ সাল। মে মাসের চতুর্থ দিবস। কানে দেখানো হলো দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ। নুভেল ভাগ বা নিউ ওয়েভের যাত্রা শুরু বললেন অনেকে। কানের ঠিক বাইরেই শ্যাতু দে নাপুলে 'আর্ট' পত্রিকা তরুণ চিত্র পরিচালকদের এক বিতর্ক আহ্বান করলো। এবং এই ধরনের 'পারিবারিক' ছবি প্রথমবারের মতো দেখা গেলো। কালো চশমা পরা গদারকে দেখা গেলো একেবারে পেছনের সারিতে, খুব একটা খেয়াল না করলে বোঝা যাবে না এই ভদ্রলোকের পরিচয় আর ত্রুফো একেবারে সামনে, কান উৎসবের অবিসংবাদী নেতা। গদারের প্রকাশ্য আবির্ভাব বোধ হয় এই প্রথম, সচকিতে।
তরুণ অনামা পরিচালকদের উপর বাজি ধরতে মরিয়া প্রযোজকদের একজন হলেন জর্জ দে বোগার্দ, তাঁর সাথে দেখা হলো গদারের প্যারিসে। তখন তারুণ্যের চলচ্চিত্র সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠার এক প্রতীক ছিলো। কিন্তু ত্রুফো আর শ্যাব্রল খেলা ফাইনাল করে দিলেন। মে মাসের নবম দিবসে কান থেকে, দুজনেই আলাদা পত্র দিলেন বোগার্দকে, গ্যারান্টর বা জামিনদার হিসেবে—ত্রুফো চিত্রনাট্যের জন্যে এবং শ্যাব্রল পরিচালনার জন্যে। এটি চুক্তি। বন্ধুদের সাহায্য পেয়ে গদার এবার কাজ শুরু করতে পারবেন—'ব্রেথলেস' ছবিটি নিয়ে।
দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ এবং কানবিজয়ের আগেই ত্রুফো বিখ্যাত। কাহিয়ে দু সিনেমার তরুণ, নির্ভীক সাংবাদিক-ক্রিটিক, তাঁর কলমের খোঁচায় মারা পড়ছেন মিথ্যে কিংবদন্তীরা, সকলেই ভীত-সন্ত্রস্ত। তথাকথিত কোয়ালিটি সিনেমা তারকাভারে জর্জরিত আর স্টুডিও সিস্টেম হলো বস্তাপচা—কান উৎসব পিছিয়ে পড়া, অতি প্রাতিষ্ঠানিক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ভাঁড়দের আখড়া—লেখায় এসব মতামত বিস্ফোরক ভূমিকা রাখলো, তিনি আটান্নতে কান থেকে নিষিদ্ধ হলেন। ফলে ঠিক পরের বছর কানে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্যে শিরোপা অর্জন এক মধুর প্রতিশোধ এবং সিনেমার ইতিহাসে এক প্রেরণাসঞ্চারী ইতিহাসে। এসব ঘটনা ঘটছে যখন—কাহিয়ে দু সিনেমার অফিসে ত্যক্তবিরক্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে আছেন গদার, তুলনায় স্বল্প পরিচিত ক্রিটিক—'বিরক্তিকর! সবাই কানে। আমি এখানে কী করছি! কানে যাওয়ার জন্যে পয়সার ব্যবস্থা করতে হবে। ত্রুফো একটা বেজন্মা, আমার জন্যে তার কোনো চিন্তা নেই।' শাজেলিজের এক ক্রিটিককে এই গল্প করেছিলেন গদার পরবর্তী জীবনে।

গদার জানতেন এই মুহূর্তকে ধাওয়া করতে হবে। তিনি ত্রুফোর কানবিজয়ী ফিল্ম নিয়ে রিপোর্ট লিখেছিলেন 'আর্ট' পত্রিকায়—''সিনেমা শেষ হওয়ার পরে ছোটো সিনেমাহলের সব আলো কমে এলো। নীরবতা দীর্ঘতর হলো। কোয়েই দ ওর্সের ফিলিপ এরল্যাঙ্গার ঝুঁকে এলেন তখন সংস্কৃতিমন্ত্রী আন্দ্রে মার্লোর দিকে—'এই ছবিটিই কি ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্ব করবে?' তিনি, মন্ত্রীমশায় সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন—কেন নয়!''
জঁ লুক গদার, ক্লদ শ্যাব্রলের মতোই তখন ইতস্তত ভ্রাম্যমাণ, কী করবেন বুঝতে পারছেন না। ত্রুফো আর গদার দুজনকেই টেনেছিলো মিশেল পোর্তাইল নামের এক অপরাধী। এই লোকটি লা হাব্রে যাওয়া পথে এক মোটরসাইকেল আরোহীকে খুন করে। আমেরিকায় বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছিলো মিশেল। ধরা পড়ে প্লেস দে লা কনকর্ডের কাছে। মিডিয়া ব্যস্ত হয়ে উঠলো এই খুনীকে নিয়ে, যাবজ্জীবন হয়ে গেলো তার। ত্রুফো 'ডিটেকটিভ' আর 'ফ্রা-সোয়া' পত্রিকার সংবাদ কর্তিকা কেটে রাখলেন। এই ঘটনা ত্রুফোকে উত্তেজিত করেছিলো। ওই সময়ে গদার মরিয়া হয়ে খুঁজে চলেছেন প্রযোজক।
ত্রুফো প্রাথমিক চিন্তা দাঁড় করালেন 'ব্রেথলেস' সিনেমার। 'গল্পটা শেষ করতে পারলে আমাকে জানিও। আমি সংলাপগুলো লিখবো।' রিশ্যেলু দ্রুতের মেট্রো স্টেশনে নামার সময় গদার বললেন। ত্রুফো সম্মত হলেন, তিনি বন্ধুকে প্রথম ফিচার ফিল্ম উপহার দিলেন। অল্প কয়েক পাতা পড়েই বোগার্দ টাকা ঢালতে রাজি হলেন। চলচ্চিত্রটি ত্রুফোর আদি সিনেমার মতো একেবারেই হলো না। 'আমি তোমায় ফাইনাল চিত্রনাট্য কদিন বাদেই পড়াচ্ছি ভাই আমার।'—গদার ত্রুফোকে লেখেন ছবিটি তুলতে শুরু করবার আগেই। 'শত হলেও এটি তোমার চিত্রনাট্য। আমার ধারণা তুমি চমকে উঠবে দেখে। সত্য বলতে কী, আমার মনে হচ্ছে না ছবিটা তোমার ভালো লাগবে। সংক্ষেপে, এটি এমন এক মানুষের গল্প যে সারাক্ষণ মৃত্যুর কথা ভাবে আর এক নারীর কথা আছে, সে কিন্তু পুরো বিপরীত চিন্তার।'
বোগার্দকে চিত্রনাট্য শোনাতে রাজি হননি গদার। তবে প্রযোজক চেপে ধরতে শোনালেন চিত্রনাট্য, শুনে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। 'ঠিক এই জিনিস খুঁজছি,' উত্তেজনায় বলে ফেললেন। তবে মাস দুই পর বোগার্দ দেউলিয়া হয়ে গেলেন। গদারেরও কিছুই হারানোর ছিলো না। ফলে তাঁরা সাহস হারালেন না।
'সোমবার—জর্জ দে বোগার্দ। ভোর! পোকার খেলা শুরু হলো। আমি আশা করি কিছু পয়সা আনতে পারবো... উফ, উত্তেজক পুরনো দুনিয়া! আমাকে বিশ্বাস করবার জন্যে কৃতজ্ঞতা—আগাম মার্জনা চাই যদি আগামী মাসে খারাপ মেজাজে থাকি। আমি আশা করি, আমাদের সিনেমা সুন্দরভাবে সরল অথবা সরলভাবে সুন্দর—আমি ভীত-সন্ত্রস্ত। কাজের মধ্যেই আছি, সব ঠিক আছে। তোমায় চিঠি লেখা যেন নিজের বাবা-মায়ের কাছে লেখা, যেন আমাদের যৌথ খেলার প্রথম কিস্তি তোমায় পাঠাচ্ছি, গিয়্যেম অ্যাপোলোনিয়ারের কথায়—এভ্রিথিং টেরিবলি—গদার।'
প্রযোজক পরিচালকের সম্পর্ক কেমন হতে পারে, আমরা গদারের এই ছোট চিঠি থেকে বুঝতে পারি, নবতরঙ্গের শুরুটা ছিলো এমনই আন্তরিক প্রাণখোলা। ত্রুফো ছবি তোলা ভালোমতো দেখছিলেন। তাঁর ছবির কাজও চলছিলো সমান তালে। শাজেলিজের কাছেই পারগোলায়, গদারের সাথেই ছিলেন ত্রুফো। সাথে ছিলেন আরেকজন, তরুণ অভিনেতা জঁ পল বেলমন্দো। বেলমন্দো পরবর্তী জীবনে গদারের মারফত ছড়িয়ে পড়বেন নতুন তারুণ্যের বুদ্ধিদীপ্ত প্রতীক হয়ে। ১৯৬০ সালে জঁ ভিগো পুরস্কার পেল 'ব্রেথলেস'। চলচ্চিত্র পুরস্কার উপকারী কি না—প্রশ্ন করা হয়েছিলো গদারকে। তিনি সহজ উত্তর দিয়েছিলেন, পুরস্কারের ফলে ছবিটির দিকে মানুষের মন আকৃষ্ট হয়।

অবশ্য নুভেল ভাগ আন্দোলনের জন্ম ব্রেথলেস কিংবা দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ সিনেমার অনেক আগেই যখন কাহিয়ে দু সিনেমার তরুণ ক্রিটিকরা স্বল্পদৈর্ঘ্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলেন। এরিক রোহমের আর জ্যাক রিভেত মূলত এই আন্দোলনের জনক বলে কিছু থেকে থাকলে তাই। সাতান্নতে ত্রুফো ভঙ্গুর আলো হাতে তুলে নিলেন, নির্মাণ করলেন 'দ্য ব্র্যাটস', প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য তাঁর, যেন ছোটো গল্প লিখে হাত পাকিয়ে উপন্যাসে প্রবেশ করবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 'সিনেমা ৫৮' পত্রিকায় নবতরঙ্গ নামটি প্রথম বারের মতো আসে। সমাজবিজ্ঞানের এক চালু টার্ম ধার নিয়ে, ফ্রাসোয়া গিরোদ লা এক্সপ্রেস পত্রিকায় এই টার্ম ব্যবহার করেছিলেন সাতান্নর শুরুতে ফরাসী যুবসমাজের আশা, বাসনা আর হতাশাকে বিবৃত করবার জন্যে। গদারও কয়েকটা স্বল্পদৈর্ঘ্য নির্মাণ করেন। যেমন—অল বয়েজ আর কলড প্যাট্রিক। সাতান্নর জুনে ত্রুফো দ্য ব্র্যাট তুলছিলেন, 'শার্লোট অ্যান্ড হার বয়ফ্রেন্ড' আটান্নতে করলেন জঁ লুক, বেলমন্দো আলজেরিয়াতে থাকায় তাঁর স্বর গদার স্বয়ং ডাব করেছিলেন।
২
আমার প্রথম গদার দেখা পার্টির বড় ভাই নিজামের বাসায়, যিনি পরে আমার মেন্টর হয়ে উঠবেন। সাথে বন্ধুরা ছিলো। ডিভিডিতে ডিরেকটরস কমেন্ট্রিসহ সিলেক্ট করে চালিয়ে দিয়েছি ভুলে। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। অত্যন্ত ভাব নিয়ে বলেছিলাম—'আরে এটা গদারের ব্রেথলেস, এটাই তাঁর শৈলী বা স্টাইল যা-ই বলিস।' ঘুমন্ত নিজাম ভাই মাঝ রাতে উঠে আমায় খুব বকাবাদ্য করেছিলেন।
প্রসঙ্গটা তুললাম এজন্যে, দেখেছি দুই হাজার পরবর্তীকালে অনেকেই গদার দেখেছে কোনো কিছু না বুঝে কিংবা উপলব্ধি না করে কেবল তিনি গদার এবং তাঁর ছবি দেখলে নিজেকে বোদ্ধা প্রমাণ করা যাবে এই কথা ভেবে। বড় হতে হতে দেখলাম প্রতিষ্ঠানিবিরোধী কথাসাহিত্যিক সুবিমল মিশ্রের লেখায় গদারের প্রভাব, লেখক নিজেও নানা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিশেষ করে জাম্পকাটের ব্যাপারটি। সিনেমার মধ্যে প্রবন্ধের ধরনের যে বিস্তার, এক ধরণের বুদ্ধিদীপ্ত দার্শনিক তর্ক উসকে দেয়ার প্রবণতা—এসব উপাদান মিশ্র গদার থেকেই স্বীকারোক্তিসহ গ্রহণ করেছেন।
আমি বন্ধুদের মজা করে বলতাম জাম্পকাট বিশ্বচলচ্চিত্রে গদারের পর সবচেয়ে ভালো দেখা গেছে আমাদের দেশে। সেলুলয়েড কেনার পয়সার অভাবে এই রীতির উদ্ভব আর আমাদের দেশে কত সুন্দরভাবেই সেলাই মেশিন চালাতে চালাতে গ্রুপ অভ ইন্ড্রাস্টিজ দেয়া যায় কিংবা ধরা যাক বাদাম বিক্রি করতে করতে শিল্পপতি।
প্রেম আর কাম এই দুইয়ের পারস্পরিকতার মধ্যে যে অনুভুতিপ্রবণ ইন্টেলেকচুয়ালিটি তা-ও তিনিই প্রথম দেখালেন। তাঁর চরিত্রেরা তাই প্রবল পড়ুয়া, ঘর জুড়ে থাকে বই, তাদের দাম্পত্যও তর্কশীল ও একইসাথে তীব্র ফিজিক্যাল।
৩
হত্যা হয়ে যাওয়া, প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু—এই দুইয়ের বাইরে গদার বেছে নিলেন স্বেচ্ছামৃত্যু। যেন দুই সীমান্তের মাঝে নো ম্যানস ল্যান্ড, সাদা কালোর মধ্যবর্তী ধূসরতা। প্রায় শতাব্দীর সমান বয়সী গদারকে বছরখানেক আগেও, অতিমারির প্রাবল্যের মধ্যে দেখা গেছে তরুণপ্রতিম। আমরা যখন প্রাণভয়ে নিজেদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টায় জোরেশোরে ঘরে হাঁটছি, সবজি খাচ্ছি তখন তাঁকে এক জুম আলোচনায় দেখলাম, ঢাউস চুরুট টানতে টানতে কথা বলছেন চিরাচরিত ভঙ্গিতে। এই ভঙ্গিটি মৃত্যুর প্রতি প্রকাশ্য বিদ্রোহ বলেই মনে করি, তাঁর অন্তর্গত শ্লেষের শক্তিতে তিনি পৃথিবীর সহনাগরিকদের মতো মৃত্যুকে পাত্তাই দেননি।

মহাভারতের পিতামহ ভীষ্মের ছিলো ইচ্ছামৃত্যু। আমাদের বিশ্বচলচ্চিত্রের পিতামহ বেছে নিলেন স্বেচ্ছামৃত্যু। ভাবতে ভালো লাগে এইভাবে নিজেকে ব্রেথলেস করে না দিলে তিনি কখনোই মারা যেতেন না। মনে হয়, নশ্বর পৃথিবীতে অন্তত দু-একজন কেন অবিনশ্বর থাকবেন না?
পরম বন্ধু ফ্রাসোয়া ত্রুফোর 'লেটার্স' বইয়ের ভূমিকাটি জঁ লুক গদার শেষ করেছিলেন তিনটি বাক্যে—'ফ্রাসোয়া হয়তো মারা গেছে। আমি হয়তো বেঁচে আছি। কোনো পার্থক্য আছে কি?' এখন, গদার এই মরপৃথিবীতে নিজের শরীরকে উপস্থিত করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে শরীর নামক একানব্বই বছর বয়সী উপস্থিতিকেই ধ্বংস করে দিলেন স্বেচ্ছায়, নিশ্চয়ই তাঁর হাতের সব তাস দেখানো এখনো শেষ হয়নি, তিনি শরীর অতিক্রমী বাঁচার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন নিশ্চিতভাবে, এক সিনেমা থেকে অন্য সিনেমায় নিজেকে তিনি বদলে ফেলছিলেন যেমন, এটিও তেমন এক বদল, শরীরের অনুপস্থিতিতে যত দিন যাবে তিনি আরো বেশি করে বেঁচে উঠবেন বলেই আমার বিশ্বাস, প্রিয় আন মারি মিয়েভিলে।
- সূত্র: 'টু ইন দ্য ওয়েভ' তথ্যচিত্রটির প্রতি রচনাটি ঋণী