নির্বাচন নিয়ে কি এবার দেশে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হতে চলেছে?

গত কয়েকদিনে দেশের নানা প্রান্তের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে যা দেখা যায় তা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার কোন সম্ভাবনা নাই। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে যে সমঝোতা দরকার তার ছিটেফোঁটাও আমরা দেখছি না। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে মারামারি। কখনো কখনো পুলিশ নিরপেক্ষ অবস্থান নিচ্ছে আর কখনো কখনো আবার মারমুখী ভাব নিচ্ছে।
দেশের আগামী সাধারণ নির্বাচনের আর হয়তো এক বছরের কিছু বেশি সময় বাকি আছে। দেশে চলছে অর্থনৈতিক সংকট। ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশকে একটি অর্থনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে হলে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা খুব জরুরী। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দুই পক্ষই সে রাস্তায় হাঁটছেন না। পরস্পর পরস্পরকে সেই অসুর বধের রাস্তাতেই হাঁটছেন। কে কাকে কতটা আক্রমণ করতে পারবেন সেটি হচ্ছে বর্তমান আলোচ্য বিষয়।
ভোলায় পুলিশের গুলিতে নিহত হলো দেশের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধীদল হিসেবে পরিচিত বিএনপির কর্মী। কোথায় যেন বক্তৃতা সুরের মধ্যে যুদ্ধের ভাষা লক্ষ্য করছি। সাধারণ মানুষের যখন অর্থনৈতিক সংকটে ত্রাহি অবস্থা তখন এ ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত, ক্ষমতা দখলের লড়াই, নির্বাচনের প্রতি আস্থা অর্জনে ব্যর্থতা সবই আগামী দিনের ভয়াবহ সংকটেরই দিক নির্দেশনা দিচ্ছে।
নিরপেক্ষ নির্বাচনী সংস্থা নির্বাচন কমিশন তাদের ইভিএমে নির্বাচন করার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ইভিএম ব্যবস্থা সরকারি রাজনৈতিক দল ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। অথচ দেশের নির্বাচন কমিশন সেই ইভিএমের মাধ্যমেই নির্বাচন সম্পন্ন করার ঘোষণা করেছে। ১৫০টি আসনে তারা ইভিএম ব্যবহার করবেন।
দেশের বর্তমান পার্লামেন্টের বিরোধীদল হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল ইভিএম ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করে আসছে, তারপরেও নির্বাচন কমিশন কেন এই ইভিএম ব্যবস্থায় নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন তাও আমরা পরিষ্কার নই। ভারতে যখন ইভিএম চালু করা হয়েছিল তখন নানান বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো প্রথমে ইভিএম ব্যবস্থার বিরোধিতা করলেও ইভিএমে নিরপেক্ষ ভোটের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি জনগণ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সামনে তুলে ধরার ফলে ভারতের বিরোধীদল সমূহ ইভিএমের নির্বাচন মেনে নিয়েছে।
মানুষের মধ্যে ইভিএম ব্যবস্থা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর কথাবার্তায়। সেই বিভ্রান্তি কাটানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ব্যতিরেকে এই ঘোষণা জাতির প্রয়োজনীয় সামাজিক ঐক্যবদ্ধতাকে আরো তীব্র সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচন সারা বিশ্বের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। যদিও নির্বাচন এখনও অনেক দূরের রাস্তা, হয়তো নির্বাচন কমিশনের মাথায় আছে কিংবা চিন্তায় আছে কি করে ইভিএমের প্রতি মানুষের আস্থা অর্জন করা যায়, তারপরেও প্রশ্ন থাকে যে কোন যুক্তিতে ১৫০টি?একইসঙ্গে কোন এলাকাগুলোতে ইভিএম এর মাধ্যমে নির্বাচন করবেন, কেন ওই এলাকা তার যুক্তিও তুলে ধরা দরকার।
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অভ্যন্তরীণভাবে সামাজিক ঐক্যবদ্ধতা গড়ে তোলার কোন প্রচেষ্টাই লক্ষ্য করা যায় না। অতীতে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে সামাজিকভাবে একত্রিত হতে দেখা গেছে যা বর্তমানে একেবারেই শূন্য।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রধান ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ ভ্রমণের আগে বেশ কিছু সামাজিক ঐক্যবদ্ধতার উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছিল। সরকার প্রধানসহ অনেকেই এ ব্যাপারে যে মত প্রকাশ করছিলেন তাতে আমরা আশাবাদী হয়ে পড়েছিলাম যে হয়তো আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক সমঝোতা সৃষ্টি হবে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সে আশা বিলুপ্ত হয়ে গেল। সরকারি দলকে রাজপথে আরও বেশি আক্রমণাত্মক ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী নেতাদের বাড়ি ঘরে আক্রমণের ঘটনাও শুরু হয়েছে। আর প্রায় ক্ষেত্রেই প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
দেশের অবস্থাটা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞানবৃদ্ধি ও বই পড়ার ক্ষেত্রে সরকারি টাকায় বই কেনার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে একজন অতিরিক্ত সচিব ২৯টি বই রচনা করে তালিকাভুক্ত করেছেন, সরকারি ক্রয় তালিকায়। প্রশাসনিক অবস্থাটা কতটা দুর্বল হলে এমন একটি ঘটনা জাতির সামনে উঠে আসে এবং পরবর্তীতে জনপ্রশাসন সচিব বিষয়টিতে পুনঃসিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। এমন ঘটনায় যারা নেতৃত্ব দেন তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো ঘটনা না থাকার ফলেই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এই সমস্ত ঘটনা।