পৃথিবীর অর্থনৈতিক সংকট ও আমাদের বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরতে হবে
আমরা স্বীকার করি আর না করি বিশ্বের প্রায় সবকটি দেশই অর্থনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি চরম সত্য। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে অর্থনৈতিক শক্তিধর ক্ষমতাশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত সম্প্রতিককালে তাদের পণ্যমূল্যের আকাশচুম্বী দাম সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর এ অবস্থা এখন পৃথিবীর প্রায় সবকটি দেশেরই। কাজেই আমরাও তার থেকে আলাদা কিছু থাকব না এটি অত্যন্ত সত্য কথা।
এমন একটি সংকটময় মুহূর্তে দেশকে যখন ঐক্যবদ্ধভাবে সামনে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা খুবই জরুরি তখনই আমরা দেখছি ক্ষমতাসীন নেতানেত্রীরা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে গণমাধ্যমে উপস্থিত হচ্ছেন; সেটা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, যা-ই কিছু হোক না কেন। আবার মন্ত্রী পরিষদের দু-একজন মন্ত্রী এমন সব ভাষা ব্যবহার করছেন যা নেটিজনদের কাছে হাসির খোরাক হয়ে উঠছে। দেশের অবস্থা বেহেস্তের সঙ্গে তুলনা করলেন একজন মন্ত্রী, আবার তিনিই বললেন বিদেশী কূটনীতিকের সম্পর্কে যে, তিনি [বিদেশি কূটনীতিক] মিথ্যা বলেছেন। এর আগেও তিনি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন একটি বাক্য বলেছিলেন যা-ও কূটনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না।
সরাসরি মিথ্যা শব্দটি উল্লেখ করেছেন তিনি। অথচ দেশের বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষা করার দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী এই ভাষা প্রয়োগ করতে পারেন না। সেই দেশটি সম্পর্কে বিশ্ব জনমত কী হতে পারে তা খুবই পরিষ্কার। এর আগেও তিনি দেশের মানুষকে বিব্রত করেছিলেন। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমাদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। কূটনৈতিক অঙ্গনে এই ধরনের বাক্য পৃথিবীর কোনো প্রান্তে আমরা কখনো শুনিনি বা দেখিনি যে দুটি দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো হতে পারে!
এছাড়া আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি দ্রব্যমূল্য কিংবা অন্যান্য বিষয় নিয়েও একই ধরনের তুলনা একই ধরনের মন্তব্য। কেউ না খেয়ে নেই, গায়ে জামা আছে, আমাদের দেশের মানুষ কেউ কর্মহীন নয় ইত্যাদি মন্তব্য খুবই হাস্যকর। ঠিক আছে, রাজনীতিবিদরা অবশ্যই নানা ধরনের বাক্য রচনা করে তাদের সাফল্যের জয়গান গাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক ইতিহাস। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে কতটুকু এই গান গাইতে হবে তার একটা সীমারেখা তাদের নিজেদের মধ্যে টানতে হবে।
সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদককে প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে উপস্থিত দেখতে পাওয়া যায়। দেখা যায় কাল্পনিক বিরোধীদলকে নিয়ে তিনি বিভিন্ন মন্তব্য করছেন। সাম্প্রতিক কালের এক বক্তব্যে তিনি বলেছেন আমরা দেশ থেকে পালাব না। আমরা জেল খাটব। এই জেলখানার স্বীকৃতিতে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়—কেন তিনি জেল খাটবেন? তিনি এমন কী করেছেন যে জেল খাটার জন্য প্রস্তুত? তাহলে কি বিচার বিভাগের পরিস্থিতি এমন হয়ে গেছে যে সরকারের ইচ্ছার উপরেই সবকিছু বাস্তবায়িত হচ্ছে? প্রত্যয় হয় না। সরকারের ইচ্ছাতেই বিচার বিভাগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে, কিংবা পুলিশি ব্যবস্থা চালু আছে—এসব বলে কেউ কেউ হতাশা প্রকাশ করেন। এ ধরনের মন্তব্য দেশের রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য কতটা সহায়ক?
সমাজের মঙ্গল কিংবা অর্থনৈতিক উন্নতি স্থায়ী হতে পারে না যদি সামাজিক ঐক্য গড়ে না ওঠে। যে কারণে উন্নত দেশগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় সংসদে ব্যাপক আলোচনা করে থাকে। বাংলাদেশের সংসদে তেমন কোনো বড় আলোচনা আমরা কখনো খুঁজে পাই না। বিদ্যুৎ খাতের যে ব্যাপক অনিয়মের কথা নানানভাবে বলা হচ্ছে, কুইক রেন্টাল নিয়ে যে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে, আমরা দেখিনি আমাদের দেশের সংসদে তার উপরে ব্যাপক কোনো আলোচনা হতে।
বিভিন্ন বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আমরা একই অবস্থা লক্ষ করেছি। পত্রিকান্তে জানা গেল সরকার ৩,২০০ মেগাওয়াট এলএনজিনির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন আপাতত বাতিল করেছে। আপাতত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী ২০৩০ সনের মধ্যে নতুন কোনো বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে না নেওয়ার। এই উপলব্ধি কখন হলো? বিশ্বব্যাপী যখন তীব্র জ্বালানি সংকট সৃষ্টি হয়েছে তখনই তাৎক্ষণিক এ সিদ্ধান্ত। তাহলে কি অতীতের প্রকল্প গ্রহণের সময় গভীরভাবে সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি? দেশে বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা কতটুকু সৃষ্টি হয়েছে? পরিকল্পনাগুলো কি কল্পনাপ্রসূত?
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কতটা হবে তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না, কারণ সামগ্রিক পণ্যমূল্য যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা কোনো সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা কার্যকর হবে না, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের কোথাও এই ধরনের হস্তক্ষেপও করা হয় না। কেবল আমাদের দেশেই এমনটা দেখতে পাই। ভোক্তা অধিকার আইন কিংবা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে বাজারের উপরে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করা হয়। মূলত বাজারকে বাজারের উপরই ছেড়ে দিতে হবে। মজুতদারি নিয়ে বাড়াবাড়ি আছে, গণমাধ্যমে মজুতের যেসব খবর প্রকাশ করা হয় তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উসকানিমূলক। বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় মজুতদারি সম্পর্কে আমাদের দেশের গণমাধ্যমের এ এক অদ্ভুত প্রচেষ্টা। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মজুতের এমন ঘটনা ঘটে, কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সরকারের, পুলিশি হস্তক্ষেপ থাকে।
জনগণদের কাছে বাস্তব পরিস্থিতিটাই তুলে ধরতে হবে, বর্তমান পৃথিবীর অর্থনৈতিক সংকট মোচন করার করার কোন সূত্র তাৎক্ষণিকভাবে কোন সরকারের কাছে নাই। বিশ্বই পরিস্থিতি সঠিক ভাবে মানুষকে তুলে ধরা না হয় তবে শ্রীলংকার মতন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। শ্রীলংকার রাজনীতির প্রেক্ষাপট পাল্টে দিয়েছে সে দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহ। বহু বিভাজিত দেশটি সরকারের নানান ব্যর্থতায় একত্রিত হতে পেরেছে, যদিও শ্রীলংকা সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে আরো বহুকাল সময় লাগবে, কারণ রাজনৈতিক সংকট থাকলে শ্রীলংকার যে প্রধান আয়ের ভিত্তি পর্যটন, তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে না। রাজনৈতিক অবস্থার বিবেচনায় সেই পর্যটনের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল।
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।