ডলার বিক্রিতে অত্যধিক মুনাফা: বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ কি যথেষ্ট?
গত কয়েকদিন ধরেই আলোচনাটা চলছিল যে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যে বেসরকারি ব্যাংকগুলো রয়েছে তারা অতিরিক্ত মুনাফা করছে। নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে তারা নানান ভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসৃত নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে অব্যাহতভাবে এই কাজগুলো করে যাচ্ছিল। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলছেন, ''ডলার ক্রয়-বিক্রয়ে অত্যধিক লাভ করার কারণে ছয়টা ব্যাংকের, যার মধ্যে দেশি পাঁচটা আর বিদেশি একটা আছে। ব্যাংকগুলো অত্যধিক লাভের সাথে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
এরপরই সংবাদ মাধ্যমে খবর ব্যাংকগুলোর নামসহ প্রকাশ হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা কি যথার্থ? কেবলমাত্র ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তিকে অপসারণ করাই কি যথেষ্ট?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে ইতোমধ্যে দেখা গেছে যে ব্যাংকগুলো ৪০০ শতাংশ মুনাফা করেছে।
দেশের প্রচলিত ভোক্তা অধিকার আইনে একজন খুচরা বিক্রেতা তার গোডাউনে কেন ১০০ কেজি তেল থাকলো তা নিয়ে তাকে যেভাবে ভোক্তা অধিকার আইনের দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়, তখন এই ডলার মুনাফাকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ব্যবস্থা কি অপ্রতুল নয়?
এর আগে ২০০২ সালে পাঁচটি ব্যাংক থেকে ওই পাঁচ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের অপসারণ করা হয়েছিল।
ইতঃপূর্বে ২০০২ সালের দিকে পাঁচটি ব্যাংকের এমডিকে অপসারণ করা হয়েছিল ভারতীয় এক ব্যবসায়ী জালিয়াতির মাধ্যমে ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে। কিন্তু ওই ঘটনায় পাঁচ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এবারের ঘটনাতেও পরিচালনা পরিষদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
সরকার যখন বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ ও তার যথাযথ ব্যবহারের জন্য নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তখন এই ব্যাংকগুলো কোন শক্তির বলে এ ধরনের কাজ করতে পারল! আমরা কি ধরে নেব, এদের পিছনের শক্তি হচ্ছে রাজনৈতিক শক্তি?
ব্যাংক মালিকদের প্রায় শতভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয় দ্বারা পরিচিত। বর্তমান সরকারের আমলেই সবচেয়ে বেশি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং এদের প্রায় সবারই রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। যে ব্যাংকগুলোর নাম এখানে এসেছে তার মধ্যে একটি বিদেশি ব্যাংকও আছে।
এই অতি মুনাফার ফলে যে ব্যবসায়ী কিংবা যে খুচরা বিক্রেতা অথবা যে ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হলো তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা কি হবে? কেন কেবলমাত্র অপসারণের মাধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল? বাংলাদেশ ব্যাংক কেন তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করল না?
আজকে শুধু এই ডলার কেলেঙ্কারিই নয়, নানান অপরাধেই তাদেরকে ছাড় দেওয়া হয়। এবং শেষ পর্যন্ত সব কিছুর দায়ভার চাপে ব্যাংকের গ্রাহকের উপর। সব অভিযোগ ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতা, গ্রাহকের ওপর।
বাংলাদেশে বহু বছর যাবত নানা ব্যাংকের নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসছে, কিন্তু সেই অভিযোগে কখনো কোন ব্যাংকের পরিষদের কাউকেই অভিযুক্ত হতে দেখা যায়নি। তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি।
ব্যাংকিং কোম্পানি আইন অনুসারে একসময় পরিবারের শেয়ার হোল্ডিংয়ের ২৫ শতাংশ সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া ছিল, বর্তমানে সেই ২৫ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। ছয় বছরের অধিক কাল ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে কাজ না করার সীমা নির্ধারণ করা ছিল- এ দুটি আইনই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে এই সরকারের আমলে।
ফলে ব্যাংকগুলো পরিণত হয়েছে ব্যক্তিগত, পারিবারিক সম্পদে। এই সমস্ত ব্যাংক মালিকদের কেবলমাত্র ব্যাংকের মুনাফার দিকেই নজর। ফলে এ ধরনের অতি মুনাফা অর্জনের ঘটনায় কর্মচারীদের ভাগ্যেও জোটে বিভিন্ন ধরনের বোনাস এবং উচ্চ বেতন।
বাংলাদেশের জিডিপির সিংহভাগ অর্জিত হয় সেবা খাত থেকে আর সেবা খাতের মূল চালিকা শক্তিই হচ্ছে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এই ব্যাংক বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ মালিকানা দলীয় ভিত্তিতে প্রদান করার ফলে এসব অনিয়মের তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এর প্রভাব সরকারি ব্যাংকগুলোতেও আছে।
ঠিক এই মুহূর্তে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের অনেকেরই ব্যবসা এই সরকারি ব্যাংকের সাথে, সরকারি ব্যাংকের ডলারের সুবিধাও তারা নিচ্ছেন। এমনকি এই ব্যাংকিং খাতে এ কথাও প্রতিষ্ঠিত যে ব্যাংক মালিকরা পরস্পরের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদান করেন কম সুদে। পারস্পরিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান করা হয় অল্প সুদের হারে।
বেনামি ঋণ আদান প্রদানের হার ও সর্বোচ্চ বেশি এই সমস্ত বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে। গভীর অনুসন্ধান করলে এর প্রতিটি ইতিহাস বেরিয়ে আসবে। মালিকদের বিনিময় মূল্য হচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের নানান-সুযোগ সুবিধা।
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।