পশ্চিমা মিডিয়া ও ইউক্রেনের প্রকৃত সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

ইউক্রেন যুদ্ধে কে জিতবে তা নির্ভর করছে কে কী বলছে তার ওপর!
রাশিয়া বলছে পরিকল্পনা অনুযায়ী তারাই জিততে চলেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে অপ্রত্যাশিত হলেও ইউক্রেন পশ্চিমা সমর্থন পেয়ে প্রতিরোধে অবিচল থাকায় জয়টা তাদেরই হতে চলেছে।
একদিক দিয়ে ভাবলে অথরিটারিয়ান বা কর্তৃত্ববাদী রাশিয়ার কথা অবশ্য বিশ্বাস করা যায় না। যুদ্ধের মতো বিষয়ে তো আরও নয়। ওদিকে উদারপন্থী পশ্চিমারা মুক্ত ও স্বাধীন পর্যবেক্ষণ প্রকাশের সুযোগ দিলেও বাস্তবতা ভিন্ন। চীনা সমরবিদ সান জু'র কথা বলা যায় এখানে। তিনি বলেছিলেন, 'সব যুদ্ধই দাঁড়িয়ে আছে ছলচাতুরির ওপর'।
সেই হিসেবে যুদ্ধের ধোঁয়াশা কমাতে কোনো পক্ষকেই বিশ্বাস করা যায় না বা করা উচিতও নয়। কারণটা হলো উভয় পক্ষ শুধু সরাসরি যুদ্ধ করছে না, তারা এক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেও লিপ্ত যার ওপর নির্ভর করছে ইউক্রেন যুদ্ধের জয়-পরাজয়।
প্রকৃতপক্ষে দুপক্ষই নিজেদের বাছাইকৃত কিছু সত্য ও অসত্য বক্তব্য প্রচার করে চলেছে। একইসঙ্গে প্রতিপক্ষের বক্তব্যগুলো প্রচারেও বাধা দিচ্ছে তারা। যুদ্ধের এই বিশাল ক্ষয়ক্ষতি, সেটা রক্ত দিয়ে হোক কিংবা কোষাগারের টাকা দিয়ে- তাকে যুক্তিসংগত করে তুলতে উভয়পক্ষকেই কাঠখড় পুড়াতে হচ্ছে ।
রাশিয়া চায় ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ করার মনোবল ভাঙতে। 'যে যুদ্ধে কখনোই জেতা সম্ভব নয়' সেখানে ইউরোপের সমর্থন কমানোতেই তাদের আগ্রহ। এদিকে ইউক্রেন ও ইউরোপীয় দেশগুলোকে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার উৎসাহ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি বহু মার্কিন কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে ইউক্রেনের দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধার সম্ভব নয় এমনটা মনে করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য ভিন্ন।
তোতাপাখির মতো মুখস্ত বুলি আওড়ানোর বিকল্প নেই রাশিয়ার গণমাধ্যমগুলোর। রাষ্ট্রীয় বক্তব্যই তারা প্রশ্নাতীতভাবে তুলে ধরে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের সেই স্বাধীনতা থাকলেও তারা ন্যাটো ও পেন্টাগনের বিবৃতি ও প্রতিবেদন বিশ্বাস করতেই পছন্দ করে, সেখানে তাদের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন।
উদাহরণস্বরূপ পেন্টাগনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (কেন অনিচ্ছুক?) একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান যে, 'রাশিয়া তাদের সামরিক বাহিনীর ৮৫ শতাংশ সৈন্যকে ইউক্রেন যুদ্ধে নিয়োজিত করেছে' এবং 'তাদের সীমান্ত এলাকা ও বিশ্বের অন্যত্র সামরিক কভারেজ কমিয়েছে'।
তিনি আরিও বলেন, 'রাশিয়া এখনও বুঝতে পারেনি কীভাবে কার্যকরভাবে সব অস্ত্র প্রয়োগ করা যায়' এবং 'প্রতিদিন হাজার হাজার রাশিয়ান সৈন্য নিহত হচ্ছে'। এর মধ্যে 'কয়েক হাজার লেফট্যানেন্ট ও ক্যাপ্টেন', 'কয়েকশ কর্নেল' এবং 'অনেক জেনারেল'ও রয়েছে।
এখন আমি সত্যিই জানিনা এই দাবিগুলোর কোনটি সত্যি আর কোনটি মিথ্যা। এমনকি এগুলো সেনা কর্মকর্তারা ইচ্ছাকরেই প্রচার করছে নাকি সাংবাদিকরা ছড়াচ্ছে সেটা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করছি না। কিন্তু কথা হলো এই বক্তব্যগুলো জনসাধারণ, অভিজাত গোষ্ঠী ও বিশেষজ্ঞদের কানে যাচ্ছে, তাদের মতামত প্রভাবিত করছে। এই মানুষদের অধিকাংশের বিশ্বাস, ইউক্রেন তারচেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে সক্ষম না হলেও বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।
কিন্তু পশ্চিমা বিশেষ করে অ্যাংলো-আমেরিকান গণমাধ্যমগুলো সম্ভবত তাড়াতাড়িই সব ভুলতে বসেছে। আফগানিস্তান, ইরাক বা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সরকার যা করেছে তার সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের সম্পর্ক সম্ভবত তারা খুঁজে পাচ্ছে না।
২০১৯ সালে ওয়াশিংটন পোস্ট জানায় যে ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা ১৮ বছর ধরে আফগানিস্তান সম্পর্কে সত্য গোপন করে আসছেন। অনেক কথা তারা বাড়িয়ে বলতেন এবং যুদ্ধে জেতা যে সম্ভব নয় সেই অকাট্য প্রমাণ তাদের কাছে থাকা সত্ত্বেও তারা গোপন করেন।
অন্যভাবে বললে তারা মিথ্যা বলতেন। কিন্তু গণমাধ্যম, থিংক ট্যাংক এমনকি প্রভাবশালী বিশ্লেষকরাও এই 'অফিশিয়াল' কর্মকর্তাদের কথায় নির্ভর করতে শুরু করেছিলেন। এমনকি তারা ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কে মিথ্যাচার করেছেন সেই বিষয়টি সামনে আসার পরেও তাদের বিশ্বাসে কমতি ছিল না।
সুতরাং সরকার স্বৈরাচারী হোক কিংবা গণতান্ত্রিক, এটা কোনো আশ্চর্যের কিছু নয় যে তারা সকলেই কৌশলগত কারণে যুদ্ধ সম্পর্কে মিথ্যা বলে। সত্যি বলতে এর একটা দারুণ নামও রয়েছে- স্ট্র্যাটেজেম, যার অর্থ নিজ পক্ষকে আশ্বস্ত করে শত্রুকে বিপর্যস্ত করতে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো।
অবাক করার মতো বিষয় হল কীভাবে 'মুক্ত' বিশ্বের 'স্বাধীন' সব গণমাধ্যম যারা অতীতে পেন্টাগন পেপারস কিংবা আফগান পেপারসের মতো সরকারি প্রতারণার অনেক বিষয় সামনে আনতে সাহায্য করেছে, তারাই এখন সরকারি বক্তব্যগুলো এত নিষ্ঠার সঙ্গে প্রচার করে যেন তারা নিজেরাও এই যুদ্ধে জড়িত।
খ্যাতনামা সব আমেরিকান ও ব্রিটিশ জার্নালে সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞরা পুতিনকে একপাক্ষিকভাবে ফ্যাসিবাদী, বিপজ্জনক বা এধরনের সমার্থক শব্দে আখ্যায়িত করছে। ভারসাম্য বা বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষার সামান্যতম চেষ্টাও কেউ করছে না। এসব দেখলে যেকেউ বিশ্বাস করবে পশ্চিমা গণমাধ্যম জয় নিশ্চিত হওয়া অবধি পুতিন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর সঙ্গে ক্রুসেডে যোগ দিয়েছে। কিন্তু এখানে 'জয়' বলতে আসলে কী বোঝাচ্ছে? সমস্ত ইউক্রেনকে মুক্ত করা? নাকি রাশিয়াকে এতটা দুর্বল করে দেওয়া যাতে তারা ইউরোপের অন্যান্য দেশকে আর হুমকি দিতে না পারে?
ন্যাটোর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো রাশিয়াকে পরাজিত করা এবং চীন যেন রাশিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ না করে তা নিশ্চিত করা। এরজন্য ইউক্রেনকে মূল্য দিতে হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। আর সেকারণেই দুপক্ষই খরচ বা অন্য কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া আশা করছে সময়ের সঙ্গে ইউক্রেন পুরোপুরি ভেঙে পড়বে আর ইউরোপই একসময় পিছিয়ে যেতে বাধ্য হবে।
আর ইউক্রেন জিতুক বা হারুক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় ইউক্রেনীয়রা যেন যুদ্ধ চালিয়ে যায় যতক্ষণ না পর্যন্ত রুশ সেনারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তাদের অর্থনীতি ডুবতে বসে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন আফগানিস্তানের পর বিপর্যস্ত হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই ইউক্রেনের পর পুতিনের রাশিয়ায় ফাটল ধরতে পারে সেই বাজি ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তারপরও কথা আছে। ইউক্রেন আফগানিস্তান নয়। রাশিয়াও দেশটিকে নিষ্পত্তিযোগ্য ভূ-রাজনৈতিক সম্পদ হিসেবে দেখে না।
আর তাই যদিওবা ইউক্রেন রাশিয়ান বাহিনীকে অপ্রত্যাশিতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাধ্য করছে, এটি নিশ্চিত নয় যে তারা আরও ছয় বছর দূরে থাক, ছয় মাসও টিকতে পারবে কি না।
খেরসনের চলমান যুদ্ধের পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে, তা থেকে হয়তো ভবিষ্যত কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যতদিন রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধে না গিয়ে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে যাবে, ততদিন মোটামুটি মাঝারি মেয়াদে এই যুদ্ধ চলতে থাকবে বলে ধারণা করা যায়। বড়জোর এটা এক অচলাবস্থায় পৌঁছাবে কিন্তু অবধারিতভাবে কোনো পক্ষই জিতবে না।
- লেখক: মারওয়ান বিশারা আল-জাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা