রুবলের দাম ঊর্ধ্বমুখী, পুতিন আগের চেয়েও শক্তিশালী—পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞার দান উল্টে গেছে!

রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা সাম্প্রতিকতম আন্তর্জাতিক ইতিহাসের সবচেয়ে অপরিকল্পিত ও বিপর্যস্ত একটি পলিসি। ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তা না হয় ঠিক আছে, কিন্তু মস্কোর বিরুদ্ধে যে অর্থনৈতিক লড়াই জারি রেখেছে পশ্চিমারা, তা কোনো কাজেই দিচ্ছে না। বরং ক্ষতি হচ্ছে কিছু উলুখাগড়ার।
বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম আকাশছোঁয়া, হুহু করে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি, বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা, অসংখ্য মানুষ গ্যাস, খাবার, সার সংকটে ভুগছেন। এতকিছু হচ্ছে, তারপরও পুতিনের বর্বরতা কেবল বাড়ছেই, যেমনটা বাড়ছে রাশিয়ার নাগরিকদের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করাটা যেন গর্হিত কাজ। এ বিষয়টি নিয়ে বিশেষ ধারণা নেই নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের। অন্যদিকে কৌশলগত থিংকট্যাংকগুলোও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। ব্রিটেনের ভবিষ্যত নেতা ঋষি সুনাক ও লিজ ট্রুজ আরও কঠিন নিষেধাজ্ঞা দেবেন বলেন হম্বিতম্বি করছেন। এরপরও নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে একটু সন্দেহ প্রকাশ করলেই আপনি হয়ে যাবেন 'পুতিনপন্থী' আর 'ইউক্রেনবিরোধী'। নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে পশ্চিমাদের ক্রুসেডের রণহুংকার।
নিষেধাজ্ঞার বাস্তবতা হলো এগুলোর মাধ্যমে প্রতিশোধের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এ শীতে ইউরোপকে জমিয়ে দিতে পুতিনের সামনে কোনো বাধা নেই। নর্ড স্ট্রিম ১-এর মতো বড় বড় পাইপলাইন থেকে ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বেড়ে গেছে৷ পূর্ব ইউরোপের গম ও অন্যান্য খাদ্যশস্য আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতে পৌঁছানো প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
ব্রিটেনের অভ্যন্তরে গ্যাসের দাম এক বছরে তিনগুণ হয়েছে। এসব থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত রাশিয়ার চেয়ে আর কেউ হচ্ছে না। দেশটি এশিয়ায় স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ জ্বালানি রপ্তানি করছে। এর ফলে মস্কোর ব্যালেন্স অভ পেমেন্টে নজিরবিহীন উদ্বৃত্ত তৈরি হয়েছে। এ বছরের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রাগুলোর তালিকায় রয়েছে রুবল। মস্কোর বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ বা দেশটির অলিগার্করা তাদের ইয়ট নিয়ে ভিন্নস্থানে সরে গেলেও এসব বিষয়ে পুতিনের কোনো মাথাব্যথা নেই। কারও ভোট নিয়ে তার কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
বিশ্ব অর্থনীতির এ আন্তঃনির্ভরতাকে এখন যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ন্যাটোর রাজনীতিবিদেরা ইউক্রেনে সামরিক সাহায্য বাড়ানোর বিষয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা সামরিক সক্ষমতা নিয়ে ভালোই জানেন। অথচ অর্থনীতি বিষয়ে তারা যেন কিচ্ছুটি বোঝেন না। এ নিয়ে তারা সবাই কুব্রিকের সিনেমার চরিত্র ড. স্ট্রেঞ্জগ্লোভের মতোই সুর মেলাচ্ছেন। এ রাজনীতিবিদেরা বোমা মেরে রাশিয়ার অর্থনীতকে 'প্রস্তর যুগে ফেরত নিতে চান'।
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ফল ব্রিটেনের ওপরে কীভাবে পড়তে পারে এ নিয়ে আভাস দিয়ে বরিস জনসনের মন্ত্রীসভায় কখনো কোনো প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছিল কিনা। যদি বাণিজ্য অবরোধে ক্ষতি হয়, তার অর্থ অবরোধ সফল- নিষেধাজ্ঞার পেছনে এটাই অনুমান বলে মনে হচ্ছে। যেহেতু নিষেধাজ্ঞা সরাসরি মানুষ হত্যা করে না, তাই এটি আগ্রাসনের একপ্রকার গ্রহণযোগ্য রূপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বর্তমান নিষেধাজ্ঞাগুলো নয়া-সাম্রাজ্যবাদের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ ধারণাটি হলো পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের ইচ্ছেমতো ওয়ার্ল্ড অর্ডার পাল্টাতে পারবে। এ নিষেধাজ্ঞাগুলো হয়তো সামরিক শক্তির জোরে দেওয়া হয়নি, কিন্তু বৈশ্বিক এ অর্থনীতিতে এগুলো পুঁজিবাদী শক্তির দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এসব নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্যের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে পশ্চিমাবিশ্বের 'ভালো কিছু একটা করার অনুভূতি'।
মার্কিন অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ নিকোলাস মুল্ডার এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি জানান, গত ৫০ বছরে ৩০টির বেশি নিষেধাজ্ঞা 'যুদ্ধের' মধ্যে বিপর্যয়কারী ফল না হলেও কেবল ন্যূনতম ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে এগুলোর জেরে 'জনগণ যেন তাদের রাজপুত্রদের বন্দি করতে বাধ্য হয়'। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবে এর উল্টো ফল দেখা গেছে। বিশ্বের প্রায় সবগুলো একনায়কতন্ত্র পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থেকে লাভবান হয়েছে।
মস্কো না ছোট, না দুর্বল। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ও দনবাস দখলের পর থেকে পুতিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া শুরু হয়েছে। ওসব নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য ছিল ওই অঞ্চলগুলোতে রাশিয়ার কর্মপন্থা বদলে দেওয়া ও আগ্রাসন কমানো। কিন্তু ওই নিষেধাজ্ঞা যারপরনাই ব্যর্থ হয়েছে। ওগুলো নাকি দুর্বল ছিল, তাই কাজে দেয়নি- এমন কৈফিয়তই শোনা যায়।
হালের নিষেধাজ্ঞাগুলো এযাবৎকালে কোনো পরাশক্তির ওপর দেওয়া সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। এগুলো হয়তো এখন কাজ করছে না, কিন্তু যথাসময়ে করবে। এসব নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ায় মাইক্রোচিপ, আর ড্রোনের যন্ত্রপাতির জন্য হাহাকার পড়ে যাবে। এগুলোর কারণে পুতিনের 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি' দশা হবে, তিনি শীঘ্রই শান্তির জন্য হাত-পা ধরতে চাইবেন।
পুতিন যদি মাফ চান, সেটা হবে যুদ্ধক্ষেত্রে। দেশের ভেতরে রাশিয়া বর্তমানে 'নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে'। নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির সঙ্গে চীন, ইরান, ও ভারতের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আখেরে লাভ হয়েছে 'পুতিনের সঙ্গে হাত থাকা ভেতরের রাঘববোয়াল, শাসনক্ষমতায় থাকা অনুগামীদের'। এরা প্রচুর লাভের মুখ দেখছেন এখন।
রাশিয়ার ভেতরে মার্কিন ম্যাকডোনাল্ডের জায়গা করে নিয়েছে দেশটির মালিকানাধীন 'কুশনো অ্যান্ড টশকা'। অবশ্যই রাশিয়ার অর্থনীতি এখন দুর্বল। কিন্তু পুতিন এখন শক্তিশালী। এদিকে নিষেধাজ্ঞার কারণে এশিয়ায় নতুন একটি অর্থনৈতিক জগৎ একত্রিত হচ্ছে। এটি এ অঞ্চলে চীনের ভূমিকাকে আরও প্রবলতর করছে। এসব কি পূর্বেই অনুমান করা হয়েছিল?
অন্যদিকে পশ্চিমাবিশ্ব ও এর জনগণকে মন্দার মুখে পড়তে হয়েছে। বিভিন্ন দেশে নেতৃত্বের আসন টালমাটাল হয়েছে, নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে পড়েছে। গ্যাস-সংকটে পড়া জার্মানি ও হাঙ্গেরি আর কয়দিন পরে পুতিনের কথায় ওঠাবসা করবে। সব দেশে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে গেছে।
কিন্তু তারপরও কেউ নিষেধাজ্ঞাকে জবাবদিহিতার মুখে ফেলতে সাহস করছে না। নিজেদের ভুল স্বীকার করা বা পিছু হটা যেন তাদের পক্ষে পাপকাজ। আগ্রাসনের অশেষ পরিহাসে বারবার প্রলুব্ধ হয়েছে পশ্চিমাবিশ্ব। অথচ শেষ পর্যন্ত তাদের প্রসিদ্ধ শিকার আগ্রাসিরাই। সে যা-ই হোক, বোধহয় আমাদের যুদ্ধ নিয়েই মেতে থাকা উচিত।
- দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত
- সাইমন জেনকিন্স: গার্ডিয়ানের কলাম লেখক
- অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত