ব্যাংক খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাহসী হতে হবে

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর দেশের প্রাক্তন অর্থসচিব ছিলেন। তার নিয়োগের মধ্য দিয়ে দেশে নতুন আসার আশার সঞ্চার হচ্ছে। দেশের খ্যাতিমান সব অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকিং খাতের ব্যক্তিত্বরা যখন সম্ভাব্য স্ট্যাগফ্লেশন (নিম্নমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময়ে উচ্চ হারের বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে এ সমন্বিত অবস্থাই স্ট্যাগফ্লেশন) উৎকণ্ঠিত তেমন একটি সময় দেশের মুদ্রা ব্যবস্থার দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।
আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা। এই শিক্ষা ব্যবস্থা পশ্চিমী মুক্তবাজার অর্থনীতির দ্বারা প্রভাবিত। ফলে অর্থনীতির সকল রোগের মহৌষধ হিসেবে পশ্চিমা অর্থনীতির ধ্যান-ধারণা ও পশ্চিমা অর্থনীতির প্রদর্শিত পথকেই একমাত্র পথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদের অনেকেই জীবনের নানা অংশে পশ্চিমা অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
জীবনের নানা সময় এদের কেউ কেউ আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মসূচিতে কাজ করেছেন। ওই সব সংস্থায় কাজ করার কারণে এই অর্থনীতিবিদদের অনেকেই, দেশের অর্থনীতি বিষয়ক যে সব মতামত রাখেন তার বেশিরভাগই হয় ওইসব সংস্থা প্রভাবিত তত্ত্ব ও তথ্য।
বিশ্বে পশ্চিমা অর্থনীতির বিকল্প অর্থনীতি সৃষ্টি করেছে চীন। চীনের সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই চীনকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে গেছে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন ও মুদ্রা ব্যবস্থার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সমকক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমরা কখনো কি এই অচেনা চৈনিক অর্থনীতির ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে আমাদের দেশের কোন অর্থনীতিবিদকে বিস্তারিত আলোচনা করতে দেখেছি? দেখিনি।
এবারও যখন সামনে সংকটের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এই আইএমএফকে দেখছি তার পুরনো ভূমিকায়। তারা ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় মূল্য বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সুপারিশ করছে। বেসরকারি খাতের ঋণের পুনঃবিন্যাসের ক্ষেত্রেও নানান ধরনের উপদেশ দিচ্ছে। অথচ আইএমএফ দেশের উৎপাদন ও আমদানির সমন্বয় করার কথা বলেনি। তারা বাংলাদেশের রিজার্ভ হিসাব সমন্বয় নিয়েও বিভিন্ন শর্ত আরোপ করছে।
আমরা আশা করব দেশের প্রচলিত অর্থনৈতিক অবস্থার বাইরে যেয়ে যদি কোন নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাহলে অবশ্যই চীনের অর্থনৈতিক কৌশলকে গভীরভাবে উপলব্ধিতে আনতে হবে। গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে শুরু করে বর্তমান শতাব্দীর এই দুই দশক চীন অর্থনীতিতে যে সফল্য অর্জন করেছে তা যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাতে তার অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বিশদ-বিশ্লেষণ কিংবা তার অর্জিত সাফল্যের রাস্তা থেকে কোনো দিক-নির্দেশনা আমরা দেখতে পাই কিনা।
আই এম এফ কর্তৃক প্রদর্শিত রাস্তা আর আমাদের অর্থনীতির বিশিষ্ট জন ও ব্যাংকিং খাতের বিশিষ্টজনরা সেই একই ভাষায় কথা বলছেন। আশির দশকের গোড়ার দিকে চীন যখন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ফিরে এলা, তখন চীনকেও নানা শর্ত, পরামর্শ তাদেরকেও দেওয়া হয়েছে। চীনকেও বলা হয়েছে তাদের মুদ্রাকে বাজারভিত্তিক করতে। আরো নানা শর্ত, পরামর্শও দেওয়া হয়েছে নানাভাবে, কিন্তু চীন কখনোই আইএমএফর পরামর্শ গ্রহণ করেনি। সেই আশির দশক থেকে আজ অবধি চীনের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার প্রায় একই রয়েছে।
আর বছরের পর বছর বাংলাদেশের মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে অর্থনীতির শিক্ষিত ব্যক্তি ও ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ মতামত দিয়েছেন। কিন্তু তারা কখনোই পশ্চিমা অর্থনীতির ধ্যান ধারণার বাইরে, নতুন কোন পথের সন্ধান দিতে পারেননি।
বর্তমান ক্ষেত্রে সরকারের কাঙ্ক্ষিত ঋণের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ পেয়েছে গণমাধ্যমে। বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অর্থ সচিব থাকাকালীন সময়েই, এই ঋণ নিয়ে আলোচনা চলছিল আইএমএফ এর সাথে। বাজেট সমন্বয় করার জন্য সরকার আই এম এফ লোনের দিকে ঝুঁকছে কিনা সংবাদমাধ্যম কিংবা রাতের টকশোতে বিশিষ্ট, পরিচিত জনরা সে আঙ্গিকে তেমন কোন মতামত প্রকাশ করছেন না। বরং আইএমএফের শর্ত অনুসারে তাদের অনেকেই দেখেছি ডলারের বাজারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাবকেই সমর্থন করতে। তারা বিভিন্ন ঋণের পুনঃবিন্যাসের বিরোধিতা করছেন কিন্তু পশ্চিমে প্রায় প্রতিটি দেশেই এই ধরনের ঋণবিন্যাসের সুযোগ আছে।
এখানে যে ঋণগুলো একেবারেই উৎপাদন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, কিংবা তাদের কোন ধরনেই চলন ক্ষমতা নাই - তাদেরকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখা যুক্তিযুক্ত হবে না, ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের মতন দুর্বল অর্থনীতির দেশে বহু শিল্প কারখানাই নানা কারণেই দুর্বল হয়ে পড়ে, অর্থনৈতিকভাবে। কিন্তু এসব রুগ্ন হয়ে পরা কল-কারখানার অসুবিধাগুলো ভালো করে কখনই চিহ্নিত করা হয় না, এটা বিবেচনায় নিতে হবে। ঐ সব কারখানা দেশের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কাজেই বন্ধ না করে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে কারখানাগুলোকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা সরকারকে নিতে হবে।
দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকিং ব্যবস্থা, তাদের মুনাফা কেন্দ্রিকতা দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে, তাদের প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং সেবাকে ঢাকা চট্টগ্রামের মধ্যে সীমিত করে ফেলেছে। এই দুই শহরের বাইরে শাখা পর্যায়ের কোথাও ব্যাংকগুলোর বড় কিংবা মাঝারি আকারের ঋণ প্রদান ও আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রমের কোন সক্ষমতা নেই বললেই চলে।
দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি ব্যাংকিং খাত। যা ঢাকাতেই প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম অবশিষ্ট বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এই ব্যাংকগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কার্যক্রম সমস্ত কিছু ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজশাহী, খুলনার মতন বড় বড় শহরগুলোতে ব্যাংকগুলো আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য খুব সামান্যই করে থাকে। যা ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না বললে চলে। বাইরের জেলা শহরগুলোয় কোন বাণিজ্যিক কার্যক্রম অর্থাৎ মাঝারি ও বড় আকারের ঋণ প্রদান কিংবা আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যাংগুলোর ব্রাঞ্চ পর্যায়ে তেমন কোন ভূমিকাই নাই।
ব্যাংকগুলোর ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে ওই শহরের ব্রাঞ্চগুলোর অর্থনীতির কার্যক্রমে তেমন অংশ গ্রহণ নেই। তাদের কাজ মূলত অর্থ সংগ্রহ করা। তারা দৈনন্দিন লেনদেনের বাইরে কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রমই পরিচালনা করে না। ফলে আমদানি-রপ্তানি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান খুবই দুর্বল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়গুলোকে কখনোই অনুধাবন করে না। অথচ এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।
ঢাকাকেন্দ্রিক অর্থনীতির ফলে এখানে জনসংখ্যার চাপও বেশি। ঢাকা কেন্দ্রিক। ফলে ঢাকা একটি বসবাস অযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে। কোভিড অর্থনৈতিক-সংকট শুরু হলে ঢাকা থেকে বিশাল জনগোষ্ঠী মফস্বল শহরগুলোয় ফিরে গিয়েছিল। এদের অনেকেই স্থানীয় পর্যায়ের ছোট ছোট অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও দায়িত্ব ছোট ছোট শহরগুলোর ব্যাংকগুলোর বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে প্রসারিত করতে উদ্বুদ্ধ করা। কাগজে কলমে সরকারি-বেসরকারি সকল ব্যাংকেরই এ ধরনের কর্মসূচির সন্ধান পাওয়া গেলেও বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নাই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ব্যাংক খাতের অনিয়ম নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় যে, প্রায় প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গেই রাজনীতিবিদদের একটি গভীর সম্পর্ক আছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের প্রভাবেই বেসরকারি ব্যাংক গড়ে উঠেছে। দেশের অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানার সঙ্গেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক আছে। তাদের প্রভাবেই এই ব্যাংকগুলো ব্যাপক ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে । বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের চূড়ান্ত অনিয়মের পিছনে ওই সব রাজনৈতিক নেতৃত্বেই দায়ী।
বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমেও তা উঠে এসেছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকবৃন্দও এখন পর্যন্ত কোন উদাহরণ সৃষ্টি করার মত সিদ্ধান্ত বা কোনো কিছু করে দেখাতে পারেনি। বরং বেশ কয়েকজন উচ্চ পর্যায়ের বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানান তথ্য প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। পি কে হালদারের ঘটনার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার কথাও প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই ব্যাংক খাতের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সাম্প্রতিককালে ভারতের কেন্দ্রীয় ইনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্টের মতন সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করতে হবে। আমরা আশা করব সেদিকেই হাঁটবে দেশ।