ইউক্রেন নিয়ে মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের মিথ্যাচার ও ইরাক যুদ্ধের শিক্ষা

টেলিভিশনে মার্কিন অবসরপ্রাপ্ত বিভিন্ন জেনারেল ও সেনা কর্মকর্তাদের বক্তব্য ও সাক্ষাৎকার শুনে যে কেউ মনে করতে পারেন রাশিয়াকে কোনঠাসা করে জয়ের পথে ইউক্রেন। কিন্তু ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা দেখলে বোঝা যাবে সেনা কর্মকর্তারা রঙ চড়িয়ে যেসব কথা বলে থাকেন, প্রায়ই তা পুরোপুরি ভুল হয়ে থাকে। গত কয়েক দশক ধরে অন্তত এমনটাই চলছে।
গণমাধ্যম, জনপ্রতিনিধি কিংবা জনসাধারণের কাছে তারা যা বলছেন তা আরেকটু খতিয়ে দেখা দরকার। যেমন, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল বেন হজেস গত সপ্তাহে বলেন, চার মাসের লড়াই শেষে 'রাশিয়ানরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে' এবং 'পশ্চিমারা যদি এই বছর মিলিতভাবে লড়াই করে যেতে পারে তাহলে ২০২৩ সালের শুরুতেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে'।
এর আগে চলতি মাসের শুরুতে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মার্ক হার্টলিং সিএনএনের দর্শকশ্রোতার উদ্দেশ্যে বলেন, ইউক্রেন পশ্চিমাদের থেকে আরও বেশি বেশি সমরাস্ত্র পেয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে যুদ্ধের মোড় বদলে যাচ্ছে বলে তিনি উপসংহার টানেন।
১০ জুলাই মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক ভাইস চিফ অব স্টাফ জেনারেল জ্যাক কিন জেনারেল হজেস ও জেনারেল হার্টলিং-এর কথার পুনরাবৃত্তি করে ফক্স নিউজে উপস্থিত হয়ে বলেন, ডনবাসে রাশিয়া ভালো করলেও ইউক্রেনীয়দের এখনও অঞ্চলটি পুনরুদ্ধারের সুযোগ আছে। ইউক্রেনকে অবমূল্যায়ন করা উচিত না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
প্রতিটি বক্তব্যের ক্ষেত্রে এটাই বলা চলে যে এখন পর্যন্ত এগুলোর স্বপক্ষে যুক্তিসংগত কোনো প্রমাণ নেই।
রাশিয়া বনাম ইউক্রেন: বর্তমান পরিস্থিতি আসলে কী
রাশিয়ান সেনারা নিঃসন্দেহে রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধের মুখোমুখি, তবে এমন কোনো প্রমাণাদি নেই যার সূত্র ধরে বলা যায় যে তারা 'ক্লান্ত'।
পশ্চিমারা যেসব আর্টিলারি সরবরাহের প্রস্তুতি দিয়েছিল সেগুলো ইতোমধ্যে ইউক্রেনে চলে আসলেও ডনবাসে রাশিয়াকে থামানো দূরে থাকুক, রুশ আগ্রাসনে লাগাম টানাও সম্ভব হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া হাই মোবিলিটি আর্টিলাটি রকেট সিস্টেমস (হিমার্স) রুশদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে ইউক্রেন তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হলেও ইউক্রেনীয় সেনাদের লক্ষ্য করে কামান নিক্ষেপ কমেনি।
এর বাইরে ইউক্রেনে হতাহতের সংখ্যাও কমানো সম্ভব হয়নি। রাশিয়ার আর্টিলারি, রকেট ও ট্যাঙ্ক ফায়ারের নিক্ষেপে প্রতিদিন অন্তত এক হাজারের ওপর মানুষের নিহত হওয়ার সংবাদ মিলে। এমনকি আকাশপথেও রাশিয়ার আধিপত্য ঠেকানো যায়নি। রুশরা যেখানে ৩০০টির মতো বিমান হামলা চালায় সেখানে ইউক্রেনীয়দের হামলার সংখ্যা ২০টির কাছাকাছি।
এদিকে ইউক্রেন হাউইটজার কামানের গোলাবারুদ নিয়েও সংকটের মুখে। অন্যদিকে রাশিয়ার নিজেদের জন্য গোলাবারুদ উৎপাদন নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই।
বারবার ভুল পূর্বাভাস দিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা
২০০৩ সালের মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে। যুদ্ধের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ইরাকি সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তাদের মাত্র এক মাসের বেশি কিছু সময় লেগেছিল। কিন্তু এরপরেই নতুন মোড় নেয় যুদ্ধ।
মার্কিন কর্তৃপক্ষ সুন্নি অধ্যুষিত ইরাকি সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে সুন্নিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু হয়।
পরবর্তী তিন বছরে বিদ্রোহ আরও তীব্র রূপ ধারণ করে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি ইরাকি বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধেও সহিংসতা বাড়তে থাকে।
পরবর্তী তিন বছরে, বিদ্রোহ বাড়তে থাকে এবং ইরাকি বেসামরিক এবং মার্কিন সামরিক কর্মীদের উভয়ের বিরুদ্ধে সহিংসতা বিস্ফোরিত হয়। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ সহিংসতা দমনে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধির নির্দেশ দেন।
বুশের নির্দেশে জেনারেল ডেভিড প্যাট্রিউস নতুন কৌশলে আগাতে শুরু করেন। সুন্নি মিলিশিয়াদের ওপর আল কায়েদার নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন নিয়ে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করে তা।
পরবর্তীতে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে বুশ মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। মার্কিন সামরিক সদস্যদের ছাড়াই ইরাকি সিকিউরিটি ফোর্সেস (আইএসএফ) যেন তাদের দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে সেজন্য তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানে নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রথম সাঁজোয়া ডিভিশন ও মাল্টি-ন্যাশনাল ডিভিশন নর্থের তৎকালীন কমান্ডার মেজর জেনারেল মার্ক হার্টলিং ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বলেন, 'ইরাকি সরকার আরও উপযুক্ত হয়ে উঠছে'। তিনি আরও বলেন, 'ইরাকি সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারাটা সম্মানের'।
সেবছর জুনে হার্টলিং বলেন, 'ইরাকের উত্তর অংশে আমাদের যেসব শহর রয়েছে, সেগুলো এখন নিরাপদ বলে আমি মনে করি'।
হার্টলিং সাফল্যের ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তিনি বলেছিলেন মার্কিন বাহিনী শহরগুলোতে আল কায়েদাকে পরাজিত করেছে এবং এখন গ্রাম ও মফস্বলে তাদের অনুসরণ করছে।
মসুলের যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে হার্টলিং বলেন যুদ্ধের নেতৃত্বে এখন ইরাক এবং আইএসএফ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ২০১৪ সাল নাগাদ সরকারবিরোধী সুন্নি অধ্যুষিত ইসলামিক স্টেটকে মসুল থেকে পুরোপুরি উৎখাত করা যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জেনারেল হার্টলিং ইরাক ত্যাগ করার এক বছর পর, ইরাকে মার্কিন বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল রেমন্ড টি. ওডিয়ার্নো গর্ব করেছিলেন যে আইএসএফ ইরাকের সর্বত্র দায়িত্ব পালন করছে। তিনি আরও বলেন, ২০০৮ সাল থেকে আইএসএফ আরও উন্নতি করেছে এবং এর ফলেই ইরাককে আরও স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।
এর প্রায় এক বছর পরে মিশন সমাপ্ত হওয়ার পর ইরাকে মার্কিন বাহিনীর তৎকালীন কমান্ডার জেনারেল লয়েড জে. অস্টিন বলেন, 'ইরাকে গণতন্ত্রের নতুন মঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে এবং এটি ক্রমশ একটি বহুমুখী অঞ্চল হয়ে উঠবে'। কিন্তু পরবর্তীতে আসলেই কি তা-ই ঘটেছে?
সেনা কর্মকর্তা হিসেবে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা
২০০৯ সালের দিকে আমি ইরান-ইরাক সীমান্তে ইরাকি ব্যাটেলিয়নকে প্রশিক্ষণদানকারী একটি দলের অংশ হিসেবে কাজ করি। সেখানে কয়েক মাস কাজ করে আমি লক্ষ্য করি যে ইরাকি সেনারা প্রশিক্ষণ গ্রহণে আগ্রহী না এবং তারা সেই চেষ্টাও করে না। আমরা চলে যাওয়ার পরেও তাদের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।
শেষ মার্কিন সেনাদল ইরাক ত্যাগ করার তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে, বিশ্ববাসী আবিষ্কার করে আইএসএফ প্রকৃতপক্ষে কতটা দুর্বল একটি বাহিনী। ২০১৪ সালের জুনে আইএসের তুলনামূলক ছোট একটি দল মসুল আক্রমণ করলে ইরাকি বাহিনী পালিয়ে যায়।
পরবর্তী এক বিশ্লেষণে দেখা যায় ইরাকি বাহিনীর এই 'আশ্চর্যজনক দুর্বল পারফরম্যান্সে'র মূল কারণ আইএসের দক্ষতা নয়, বরং ১০ জুন চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়ার পূর্বে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে আসছিল।
অথচ বছরের পর বছর ধরে মার্কিন কর্মকর্তারা আমেরিকানদের এই বুঝিয়ে আসছিল যে আইএসএফ দিনদিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ইরাকে তারা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে সক্ষম। অথচ বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। অভ্যন্তরীণভাবে প্রথম আক্রমণের মুখেই আইএসএফ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।
একথা সত্যি যে ইরাকের পতনের দোষ পুরোপুরি মার্কিন সৈন্যদের না। বরং ইরাকের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের ওপরেই এই ব্যররথতার দায় বর্তায়। কিন্তু জ্যেষ্ঠ মার্কিন সেনা কর্মকর্তারা জনসাধারণকে ভুল বার্তা দিয়ে আসছিলেন। এমনকি মার্কিনদেরও তারা ভুল বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এ ধরনের ভিত্তিহীন আশাবাদী বক্তব্য ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও প্রচারিত হচ্ছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী হঠাৎ করেই আগ্রাসী হয়ে উঠবে এবং বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়াকে বিতাড়িত করবে- জেনারেল হজেসের এমন দাবির কোনো ভিত্তি নেই।
এ ধরনের মিথ্যা বিবৃতির বিপত্তি হলো তারা ইউক্রেনের জনগণকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। একইসঙ্গে মার্কিন জনগণকেও তারা একটি ভুল ধারণা দিচ্ছে যাতে কংগ্রেস কৌশলে অর্থায়ন চালিয়ে যেতে উৎসাহিত হয়। তবে এই অর্থায়ন ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সবকিছু বিবেচনায় অন্তত এখন মার্কিন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের উচিত আরও যুক্তিসংগতভাবে সবকিছু বিশ্লেষণ করা এবং যেকোনো আশা দেখানোর আগে সেগুলো স্কেপটিক বা সন্দেহবাদী দৃষ্টিতে যাচাই করে নেওয়া।
- ডেনিয়েল এল ডেভিস একজন সামরিক বিশেষজ্ঞ এবং মার্কিন সংস্থা ডিফেন্স প্রায়োরিটিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো। মার্কিন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে তিনি চারবার যুদ্ধক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেন।
- সূত্র: ১৯ফোরটিফাইভ ডটকম