‘কোভিড থেকে কোনও দেশকে রক্ষা করে না জিডিপি’
শিল্প- প্রযুক্তিগত বিকাশ এবং সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেই নির্ভাবনায় থাকা যাবে- দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত সেই বিশ্বাসের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে গেল বছর থেকে কোভিড-১৯ এর পৃথিবীব্যাপী বিস্তার।
মহামারি মোকাবিলায় কোন দেশগুলো বেশি প্রস্তুত এমন আভাসগুলোর দিকে তাকালে তেমন ভ্রান্ত দম্ভের বাড়াবাড়ি সহজেই নজরে আসে: জনস হপকিন্স সেন্টার ফর হেলথ সিক্যিউরিটি ও নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভ যৌথভাবে ২০১৯ সালের যে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সারণী তৈরি করে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রথম স্থান দেওয়া হয়। তারপরেই ছিল যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস এবং কয়েক সারি নিচে সুইডেন। সেই তুলনায় নিউজিল্যান্ডকে রাখা হয় ৩৫তম স্থানে। অন্যদিকে পুরো আফ্রিকা মহাদেশকে লাল কালিতে চিহ্নিত করা হয়।
সারণীটি প্রকাশকালে এর উপর করা এক প্রতিবেদনে স্বল্প ও মধ্য আয়ের কিছু দেশকে কয়েকটি ধনী দেশের তুলনায় বেশি স্কোর দেওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিল প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন টাইমস। অর্থাৎ, দৈনিকটি ধনী দেশগুলোর অবস্থান সবসময় স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অগ্রগামী থাকবে বলেই প্রত্যাশা করেছিল।
ওই সকল বিশ্লেষণের সঙ্গে বর্তমানের বাস্তবতা মেলালে দেখা যায় তারা সকলেই প্রচণ্ড ভুল করেছিল। কোভিড প্রস্তুতির মানচিত্রের সঙ্গে প্রতি লাখে মৃত্যু হারের মানচিত্র মেলালে দেখা যায়; সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সমগ্র ইউরোপ মৃত্যুর কালো ছায়ায় ঢেকে গেছে। যার বিপরীতে, আফ্রিকার অধিকাংশ স্থান এবং এশিয়া প্রত্যক্ষ করেছে সেই তুলনায় অনেক কম প্রাণহানি।
নিউজিল্যান্ডের মতো কিছু ধনী দেশ অবশ্য মহামারি প্রতিরোধে বিস্ময়কর সাফল্যও পেয়েছে। কিন্তু, সেই একই রকম সফলতা দাবি করতে পারে মুম্বাইয়ের ধারাবি বস্তির মতো বিশ্বের অনেক ঘনবসতিপূর্ণ ও দারিদ্র্যপীরিত এলাকা। আবার আফ্রিকায় যখন সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে তখন ধনী দেশগুলো তাদের মজুদ থেকে টিকা সরবরাহে গড়িমসি করছে। ধনী দেশগুলো টিকা উৎপাদনের প্রযুক্তি দিতেও নারাজ। তারপরও বলতে হয়, মহাদেশটির সার্বিক সংক্রমণ চিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চাইতে অনেক ভালো অবস্থায় আছে।
নেতৃত্ব গুণ, নাগরিক সমাজ, মহামারি মোকাবিলার অভিজ্ঞতা, জনমিতি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ যুক্তরাষ্ট্রের রোগ প্রতিরোধ কেন্দ্র- সিডিসি'র প্রদত্ত স্বাস্থ্য বিধিমালা সফলভাবে কাজে লাগানোসহ বিভিন্ন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় দরিদ্র্য দেশের অর্জনকে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু, তারা অর্থের বিনিময়ে সফল হয়েছে এমন কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
বাস্তবতা হলো; জাতীয় সম্পদ ও শক্তিসহ ঔপনিবেশিক মানসিকতার গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি প্রভাবিত দর্শন অপেক্ষাকৃত শিল্পোয়নে পিছিয়ে থাকা জনপদকে বরাবরাই পশ্চাদপদ হিসেবে তুলে ধরে। সেই মানসিকতার বলেই তারা স্বল্পোন্নত দেশ এবং সেখানকার সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আগাম নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। কিন্তু, উন্নাসিকতার এই গুণটি উন্নত দেশের জনতাকে কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা করতে পারেনি। স্মরণে রাখা উচিৎ, সম্পদশালী দেশে বাসকারীরা তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক দুর্যোগের প্রভাব থেকেও মুক্ত নন।
জিডিপি পরিমাপ একটি উপযুক্ত উপায় মাত্র, একমাত্র উপায় নয়। তাই বৈশ্বিক লক্ষ্য বাস্তবায়নের চাইতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেন শুধু একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেই প্রধান মাপকাঠি করে তা বোধগম্য নয়, অনেকক্ষেত্রে তারা প্রাকৃতিক পরিবেশের বিনাশ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকেও সেক্ষেত্রে ছাড় দিচ্ছে।
তাই পুরোনো ভাবধারা আগল ভেঙ্গে পৃথিবীর দরকার উন্নয়নের নতুন দর্শন।
কোন দেশ উন্নতি করছে কিনা তা বিবেচনায় কোভিড-১৯ প্রতিরোধের সফলতাকেই একমাত্র মাপকাঠি করার পক্ষে আমি নই। যেমন; বলা যেতে পারে চীনের কথাই। দেশটি মহামারির প্রাথমিক বিস্তার রোধ করায় বিস্ময়কর সফলতা দেখালেও- যেভাবে সংখ্যালঘু উইঘুরদের অপর নির্যাতন চালাচ্ছে তাতে দেশটিতে একটি আদর্শ শাসন ব্যবস্থা আছে বলে দাবি করা যায় না।
তারপরও, মহামারি প্রতিরোধে নানা ক্ষেত্রের ব্যর্থতা অর্থনীতিবিদেরা দীর্ঘকাল ধরে যে কথা বলে আসছেন সেদিকেই আলোকপাত করে। তারা একটি সফল দেশ বিচারের ক্ষেত্রে জিডিপি ভিত্তিক বর্তমান ধ্যান-ধারণা ঝেড়ে ফেলার আহবান জানিয়ে আসছিলেন। তাদের মতে, উচ্চ জিডিপি বা অর্থনৈতিক বিকাশ সুশাসনের ও জনগনের উন্নত জীবনমান নিশ্চিতের বিকল্প হতে পারে না কোনোমতেই। আর দিনশেষে এটাই হলো কঠিন বাস্তবতা। কালেভদ্রে মানবাধিকার ও জনগণকে বঞ্চিত করে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও, সেটা হয়ে যায় টেকসই উন্নতির বিপরীত ও জনকল্যাণের শত্রু।
স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বর্তমান উন্নয়নের প্রচেষ্টাগুলো সবদিক দিয়েই শুধু উন্নত দেশগুলোর স্থান অর্জনের লক্ষ্য দিয়ে সাজানো। কিন্তু, তাতে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিই শুধু বাড়ছে, দিনে দিনে তীব্রতর হচ্ছে আর্থ- সামাজিক বৈষম্য। এ যেন সম্পদ আর বিলাসী জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখানো হলিউডি চলচ্চিত্রের মরীচিকা। দিনশেষে তাতে অভাবী মানুষের জাতীয় সম্পদ উন্নত দেশে পাচারের যোগসূত্র তৈরি হয়। জন্ম নেয় উন্নয়নের ফাঁকা বুলি দিয়ে মানবতা বিরোধী অপরাধ করা শাসক গোষ্ঠী।
- লেখক: প্যারিস ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সায়েন্স পো'র সমাজবিজ্ঞান বিভাগের রিসার্চ ফেলো। তিনি কল্প-বৈজ্ঞানিক রাজনৈতিক থ্রিলার ত্রয়ী উপন্যাস: 'ইনফোমোক্রেসি'র লেখক। কবিতা ও কল্প সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও রয়েছে তার অনবদ্য অবদান।
- সূত্র: ফরেন পলিসি থেকে অনূদিত