‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’
তিনি বিস্তৃত ইতিহাসের অত বড় কেউ হয়তো নন, কিন্তু তিনি ছিলেন খণ্ডিত ইতিহাসের মহানায়ক। সারা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহাকাব্যে ছোট চরিত্র হলেও, জামালপুর বা বৃহত্তর ময়মনসিংহের ইতিহাসের বীর সিংহপুরুষ। তিনি ১১ নং সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার আবু হাসানাত মুক্তা। মুক্তা কমান্ডার বা মুক্তা কোম্পানি নামেই তিনি বেশি পরিচিত।
জনাব আবু হাসনাত মুক্তার যুদ্ধকালীন বীরত্বের কথাগুলো রূপকথার মত ছড়িয়ে আছে অত্র এলাকার লোকমুখে, ছোটবেলা থেকেই হাজারো মানুষের মুখে শুনেছি তার অসীম সাহসী বীরত্বগাথা। তিনি ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের নিমিত্তে ভারতের মহেশপুরে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর কোনো ধরনের সামরিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান শুধুমাত্র তার অসীম সাহসিকতা, তেজ ও সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য।
মুক্তা কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধে একা যাননি, সাথে করে নিয়ে গেছেন আপন দুই ভাই, এবং আমার বাবাসহ আরো তিন কাজিনকে। পাশাপাশি স্কুল কলেজের সহপাঠী, বন্ধু ও এলাকার সমবয়সী শত শত যুবককে সঙ্গে যুদ্ধে নিয়ে যান ও তার কোম্পানিতে যুক্ত করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তা কমান্ডারের অমর কীর্তি হলো ভুয়াপুর টাংগাইলে পাকিস্তানি সেনাভর্তি জাহাজ আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেন। সেই আক্রমণে শত শত পাক সেনা নিহত হয়।
এছাড়া ধনবাড়ি, ধানুয়া কামালপুর, বাহাদুরাবাদ, সরিষাবাড়ি এলাকায় অনেকগুলো সম্মুখসমরে নিক কোম্পানিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন মুক্তা কমান্ডার। অত্র এলাকায় তার বেপরোয়া আক্রমণ পাক বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়। মুক্তা কমান্ডার হয়ে ওঠেন শত্রু সেনার এক আতঙ্কের নাম।
জনশ্রুতি আছে, কোনো এক সম্মুখ সমরে মুক্তা কমান্ডারের পরিবারের ছয় মুক্তিযোদ্ধার একজন আক্রমণে যেতে ভয় পেলে তিনি তার বুকে মেশিনগান ঠেকিয়ে বলেন, তুই আক্রমনে যেতে ভয় পেলে পাকিস্তানি বাহিনীর আগে আমি তোকে খতম করে ফেলব। এমনই ছিল তার সাহস, তেজ ও নিবেদন।
যুদ্ধজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বিচ্ছিন্নভাবে রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, সফল হতে পারেননি। হয়তো বিধাতা চাননি কোনো রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক পরিচয় তার মুক্তা কোম্পানি, ওরফে মুক্তা কমান্ডার নামের অকুতোভয় বীরযোদ্ধার ইমেজকে ছাড়িয়ে যাক। তবে তিনি একাধিকবার জেলা কমান্ড ও উপজেলা কমান্ডের দায়িত্ব পালন করেছেন।
মুক্তা কমান্ডার ছিলেন আমাদের পুরো পরিবারের বটবৃক্ষ, তার পরিবারের বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা, আমাদের অফুরান প্রেরণার উৎস। ছাত্রজীবনে ও চাকুরিজীবনে কতজনকে দেখেছি চেতনার দানবাক্স হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে চেতনা সংগ্রহ করে, সেই চেতনার মুনাফা নিজের পকেটে ভরতে, বক্তৃতা ও গলাবাজি করতে। এসব দেখলে আমার সবসময় হাসি পেত, এখনো পায়।
বীরযোদ্ধা পরিবার আমার চেতনার অফুরান উৎস। দেশে এক পরিবারে ছয় বীর মুক্তিযোদ্ধা দুর্লভ না হলেও বিরল। মুখ ফুটে গর্ব করে কাউকে না বললেও এটা সব সময় প্রেরণা হিসেবে কাজ করে, সা্হস দেয়, ছোটখাটো সমস্যাগুলোকে সমস্যাই মনে হয় না। ডর-ভয় জিনিসটা আমি আমার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকেই হয়তো পাইনি।
সময়ের পরিক্রমায় একে একে চলে গেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলু চাচা, এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্রাট চাচা, সিরাজ চাচা, আজাদ চাচা ও আমার বাবা। আজ অসীম শূন্য কবরের মাঝে রেখে এলাম আমাদের শেষ গর্বের ধন বীরযোদ্ধা মুক্তা চাচাকে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তা কমান্ডারের শেষকৃত্যে এসেছিলেন সারা দেশের জনমানুষের প্রিয় নেতা জামালপুর-৩ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব মির্জা আজম। এসেছিলেন জেলা ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ, মুক্তা কমান্ডারের বীর সহযোদ্ধাগণ ও উপজেলা প্রশাসন।
দোষে-গুণে মানুষ, সে হিসেবেও মরহুমের কিছু ভুলত্রুটি, সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে। সকলের প্রতি অনুরোধ রইল তার ত্রুটিগুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনার জন্য।
আজ জাতি হারাল তার এক সূর্য সন্তানকে, জামালপুর এলাকা হারাল এক রূপকথার নায়ককে আর আমাদের পরিবার হারাল তাদের শেষ অহংকারকে। ইতিহাস সৃষ্টিকারী কিংবদন্তি বীরযোদ্ধা আবু হাসনাত মুক্তা আজ থেকে নিজেই ইতিহাস হয়ে গেলেন।
বিদায় কিংবদন্তি।