২০৭১
আমরা প্রায়ই বলি 'বাংলাদেশ চিরজীবী হোক' বা ইংরেজীতে 'লং লিভ বাংলাদেশ'। আমরা দেখতে চাই আমাদের রাষ্ট্র উন্নত হচ্ছে, ধনী হচ্ছে, বিশ্বের আঙ্গিনায় গুরুত্ব পাচ্ছে এবং তার নাগরিকদের সুখে ও আর্থিক সচ্ছলতায় রাখতে পারছে। এটি আমাদের মনোবাসনা।
পঞ্চাশ বছর পর, আমাদের সার্থকতার অনেক গল্পই বলার আছে। আমরা বলছিও। একই সাথে, বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে অনেক উন্নত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও আমাদের প্রশংসাবাণী পাঠিয়েছেন। এখনও পাঠাচ্ছেন। মার্কিনদেশের প্রাক্তন আমলা হেনরী কিসিঞ্জারের বিশেষণ আজ আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। পাঁচ দশকের পথচলা তাকে ভুল প্রমাণিত করেছে।
বিভিন্ন সূচকে আমরা প্রতিবেশী – বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তান – দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে আছি। বেশকিছু উন্নত দেশের চাইতেও সূচকে এগিয়েছি। তবে মনে করিয়ে দিই, আমার এ লেখার উদ্দেশ্য কারও সাথে তুলনা করা নয়। বরং নিজের সাথেই কথা বলা এবং আত্মমূল্যায়ন ও নিজেকে পরিমাপ করা।
আমরা আর কতদূর যেতে চাই তা নিয়ে দেশের নেতাদের সাথে কথা বলা, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আমরা যদি আরও অনেক দূর যেতে চাই, তাহলে আর কোন দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।
আমি এ লেখায় 'সূচক' শব্দটি উচ্চারণ করতে চাইনি, তবে না করেও উপায় ছিল না। বিশ্ব এখন 'সূচক'-এর আবর্তেই বন্দী। বিশ্ববাসী আমাদেরকে সূচকের মাপকাঠিতেই মূল্যায়ন করে। সব কিছুতেই। এটিই এখন প্রথা।
অনেক বিশ্লেষকদের বলতে শুনেছি যে আমাদের জনসংখ্যা আমাদের উন্নয়নের অন্যতম বাঁধা। অনেক বেশি মানুষের অন্ন জোগাড় করতে হয়। তবে আমরা এই জনসংখ্যা নিয়ে বসে থাকিনি। চেষ্টা করেছি এই মানুষগুলোকে কেমন করে সম্পদে পরিণত করা যায়। সহজ কাজ নয়।
তবে মনে রাখা অতীব প্রয়োজন যে খুব বেশিদিন আমরা আমাদের এই আয়েশি চিন্তায় তৃপ্ত নাও থাকতে পারি। আমার সন্তান যখন আমার বয়সী হবে, ধরুন ২০৫০-এ, তখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত হবে? অনেকে বলেন তেইশ কোটি; অনেকের মতে পঁচিশ। তাহলে ২০৭১-এ সেই সংখ্যা কত হবে? পঁয়ত্রিশ? অতিশয় ক্ষুদ্র একটি ভৌগলিক সীমারেখায় অতি বৃহৎ এক জনগোষ্ঠী। ঠিক ঐ সময়ে – বাংলাদেশের একশ বছরে -- আমাদের চিরজীবী হওয়ার আকাঙ্ক্ষার পরিণতি কী হতে পারে?
এমন জনসংখ্যা নিয়ে বিপদে পড়লে কী হতে পারে তা আমরা বুঝেছি করোনাভাইরাস অতিমারির মধ্যে। সতেরো কোটি মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চাহিদা পূরণ করতে পারে তেমন অবকাঠামো এবং দক্ষতাও আমাদের নেই। এক সাথে অতোগুলো হাসপাতাল আমরা নির্মাণ করতে পারিনি। আমরা যখন পঁচিশ কোটি হবো, তখন কী আমরা তা পারবো? সেই পরিকল্পনা কী আছে? থাকলে তা কেমন করে বাস্তবায়ন হচ্ছে?
লাখ-লাখ মানুষ অতিমারির সময় কাজ বা চাকরি হারিয়েছেন। আমাদের ব্যবসাখাত এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য কতটা পরিণত তা আমরা বুঝেছি। আমাদের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা পরিচালনের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন তারা নিজেরা। তাদের আদর্শ হচ্ছে, নিজেদের জীবনমানের উন্নতি সাধন। তারা যাদের কাজে নিয়োগ দেন, তাদের নয়। নিজেদের বিনিয়োগকারী বলে আখ্যায়িত করেন, তবে সেই বিনিয়োগ নিজেদের জন্য – দেশের জন্য নয় অথবা সমাজের জন্য নয়। তাদের কর্মীদের জীবনমান উন্নত হোক তা তাদের চিন্তাতেও আসে না। মুনাফা আগে এবং তারপর অন্য মানুষের জীবনমান।
এমন করে ব্যবসা টিকবে না। একটি দেশ তখনই তার উন্নয়নের সার্থকতায় উচ্ছ্বসিত হবে যখন সেই দেশের সব মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে।
এবার আসুন আমরা আমাদের দেশের ভেতরের প্রকৃতি ও পরিবেশের দিকে নজর দিই। গেল পঞ্চাশ বছরে আমরা বাংলাদেশের প্রকৃতি নিয়ে কতটা চিন্তা করেছি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে কী করেছি তা ভাবতে গেলে বলতে হয় যে আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে রূঢ় অত্যাচারীর মত ব্যবহার করেছি। আমরা জানি যে ভূতাত্ত্বিকভাবে আমাদের ভৌগলিক অবস্থান নিম্নাঞ্চলে। তারপর সমুদ্র। আমরা এও জানি যে উচ্চাঞ্চলের দেশের মানুষের জীবনযাপনের প্রভাব আমাদের পুকুর, খাল ও নদীগুলোতে পড়বে। এবং সেটি কোন ইতিবাচক প্রভাব নয়।
সেই ভাবনা আমাদের মস্তিস্কে বিন্দুমাত্র দোলা দিলেও আমাদের নিজেদের অবশ্যই সাবধান হওয়ার কথা ছিল। নিজেদের পুকুর, খাল ও নদীগুলোকে বাঁচানোর কথা ছিল। তা না করে আমরা পুকুরগুলো ভরাট করে ইমারত তৈরী করছি; হাজার-হাজার খাল মরে গেছে; নদীর দু'পাড় দখলের উন্মাদনায় মেতে আছি। আমাদের খাল-নদীর জলে কল-কারখানার বর্জ্য উগরে দিয়ে দূষিত করছি। কয়েকটি নদীর তলদেশে এতো বেশি প্লাস্টিক জমেছে যে তা খুঁড়েও বের করা যাচ্ছে না।
ধরে নিচ্ছি আগামী পঞ্চাশ বছরও আমরা এই ধারা বজায় রাখবো। আমাদের নদীগুলো আমরাই দখল করে নিয়ে সমতল ভূমি বানিয়ে সেখানে পঞ্চাশতলা ভবন নির্মাণ করবো।
এবার আমাদের মাটির কথা ভাবি। আমি যখন শিশু ছিলাম, তখন দেখেছি আমাদের জমিতে একই সাথে ধান চাষ হয় এবং সেখানে মাছও পাওয়া যায়। ধানে নাকি পোকা ধরে তাই পোকা ধ্বংস করতে বিদেশ থেকে কীটনাশক এলো। কীটনাশক ব্যবহার করায় ধানের পোকার সাথে সাথে মাছও মরে গেল। তারপর এলো রাসায়নিক সার। সারা দেশের মাটিতে মিশে গেল। সেখান থেকে সেই রাসায়নিক আমাদের খাদ্যে ঢুকে গেল।
কাগজে খবর ছাপা হয় যে দেশের বিভিন্ন স্থানে খাবার জলের সংকট। আমাদের দেশে জলের অভাব নেই। মাঝে-মাঝে জলে দেশ ভেসে যায়, গেল পঞ্চাশ বছরে আমাদের খাবার জল সবার জন্য সরবরাহ করার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। দু'হাজার একাত্তর সালে দেশবাসী কেমন জল পান করবেন? তখন আদৌ জল থাকবে? আমাদের ভাবনা কী?
চিন্তার কারণ নেই। জলের অভাব বাংলাদেশে হবে না। যে ভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠ যেমন করে উঁচু হচ্ছে, আমরা দেখবো সাগরের জল ধীরে ধীরে আমাদের ভূমিতে প্রবেশ করে আমাদের জলমগ্ন করছে। আমাদের কাজ হবে সেই জলকে লবণ-মুক্ত করা এবং নাগরিকদের কাছে সরবরাহ করা।
হ্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমাদের মানুষ ও ভূমির জন্য অত্যন্ত রূপে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। প্রায় সব গবেষণাই ভবিষ্যদ্বাণী করছে যে ২১০০ সাল নাগাদ পুরো দেশ সাগরের জলে ডুবে যাবে। তখন কোন দেশ থাকবে না।
আমাদের রংপুর-দিনাজপুর সে সময়ে সমুদ্র সৈকতে রূপান্তরিত হওয়ার ভয় রয়েছে। দেশ নেই, ভূমি নেই। তাহলে মানুষ কোথায় বসবাস করবে? বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায় জলের ভেতরেই ভিত গেঁড়ে ভবন এবং সেতু তৈরী হচ্ছে। আমরাও তেমন চিন্তা এখন থেকেই শুরু করবো কিনা তা ভাবা প্রয়োজন।
আমার কথা এখন হয়তো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মনে হতে পারে। সাগরের জল বন্যার মত ধেয়ে আসছে না বলে আমরা তেমন আমলে নিচ্ছি না। পা টিপে টিপে আসছে। ভাবুনতো দেখি – একুশ'শ সাল নাগাদ পঁয়ত্রিশ কোটি মানুষ জলের মধ্যে বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছেন!
আমরা যদি জলের মধ্যে বাস করতে পারি, তাহলে এক কথা, আর যদি না পারি, তাহলে আরেক কথা। ডুবে যাওয়ার ব্যাপারটি যদি ঘটেই, তাহলে মানুষগুলো কোথায় পুনর্বাসিত হবে? কোথায় যাবে? ধরে নিই আমরা আশেপাশের এবং দূরের কোন দেশে ছড়িয়ে পড়বো। আমাদের গ্রহণ করতে বা আশ্রয় দিতে সেই রাষ্ট্রগুলো কী রাজি হবে? তারা কী এখনই তা ভাবছে? আমরা সেখানে গিয়ে কী কাজ করবো? কী দক্ষতা আমাদের থাকবে যে তাদের অর্থনীতিতে তাদের আশানুরূপ অবদান রাখতে পারবো?
এমনটি রাতারাতি ঘটবে না। গবেষকরা বলেন, অনেক বছর ধরে ঘটবে যার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
তাহলে? দেশ নেই! জাতি নেই! ভাষা নেই! সংস্কৃতি নেই। আমরা অন্য জাতি-ভাষা-সংস্কৃতিতে মিশে যাবো?
বর্তমানে আমরা দেশব্যাপী নগরায়নের ইচ্ছেপূরণে ব্যস্ত। উন্নয়নে নেশাগ্রস্ত। নগরায়নের চাকচিক্যের পানে পতঙ্গের মত ছুটে চলেছি। চিন্তা করছি না যে অতি-নগরায়নের ফলাফল হচ্ছে ফসলের জমি হারানো। নিজের ভূমিতে ফসল ফলবে না; আমদানি করে জীবনযাপন করতে হবে।
হয়তো তখন আমরা ১৫জি ইন্টারনেট ব্যবহার করবো, চালকবিহীন উড়ন্ত গাড়িতে চড়বো, সেই গাড়িতে চড়ে এক ভবন থেকে আরেক ভবনে যাবো, আমাদের শরীরের ভেতর অনেক যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন করে হয়তো 'হোমো ডিজিটালিস'-এ রূপান্তরিত হবো – তবে শেষ কথা হচ্ছে আমাদের দেশটা বিলীন হবে সাগরের জলে।
বিষয়গুলো নিয়ে আমরা একেবারেই কিছু ভাবছি না, তা কিন্তু নয়। 'ডেল্টা ২১০০' নামে আমাদের একটি প্রকল্প আছে। প্রকল্পটি তৈরীই হয়েছে এসব মাথায় রেখে। কিছু কাজ হয়েছে। কিছু বেইসলাইন সমীক্ষা হয়েছে। কিন্তু এখনও সবচেয়ে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যের পদমর্যাদা পায়নি। কোন প্রচারণা নেই। গণমাধ্যমে এ বিষয়ে কোন প্রতিবেদন নেই। মনে হয় 'ডেল্টা ২১০০'-এর কথা সবাই ভুলেই বসেছেন। আমার বিশ্বাস, যতদিন পর্যন্ত 'ডেল্টা ২১০০' একটি জাতীয় আন্দোলনে রূপ না নেবে, এই বিষয়গুলোর গুরুত্ব কেউ বুঝতে পারবে না।
কোনক্রমেই বলছি না যে উন্নত হবো না বা উন্নয়নের প্রয়োজন নেই। অবশ্যই আছে। আমার অনুরোধ এই যে, আসুন ভবিষ্যতকে পর্যবেক্ষণ করি, এখন থেকে পঞ্চাশ বছর পর আমরা কোথায় থাকবো, বিশ্ব কোথায় থাকবে তা নিয়ে একটু হিসেব করি। দেশেই অনেক লেখাপড়া জানা মানুষ আছেন তারাই আমাদের পথ দেখাতে পারেন। কোথায় চলেছি এ চিন্তা না করলে, আমাদের 'চিরজীবী' হওয়ার চিন্তা স্বপ্নই রয়ে যাবে।
- লেখক: গল্পকার এবং যোগাযোগ পেশায় নিয়োজিত