(হেফাজতের) আইনের শাসন
১৯ এপ্রিলের পর থেকে গত দু'সপ্তাহে হেফাজতে ইসলামের নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়ে তার সঙ্গে দুই বার বৈঠক করেছেন। এ দুই বৈঠকেই তারা সাম্প্রতিক ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া হেফাজত নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি করেছেন। গত মার্চের শেষ দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সময় জনগণের সম্পত্তি নষ্ট করা ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালানোর অভিযোগে এই নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে এই দু'পক্ষের মধ্যকার তিন ঘণ্টার বৈঠকের পর সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী এবং একজন হেফাজত নেতা গণমাধ্যমের সামনে এসে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিবেচনায় নেওয়া হলে, বৈঠকের অন্তর্নিহিত ফলাফল বেশ তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, "হেফাজত নেতারা স্বীকার করেছেন তাদের কিছু কার্যক্রমে ভুল ছিল। তারা বলেছে, অনুপ্রবেশকারীরা এসব জ্বালাও, পোড়াও, ভাঙচুর চালিয়েছে। এরপর তারা তাদের নেতাকর্মীদের মুক্তির জন্য অনুরোধ করেছে।"
অন্যদিকে হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির মহাসচিব ও বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী বলেছেন, "গ্রেপ্তার হওয়া নেতাকর্মীদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।"
সপ্তাহ দুয়েক আগে হেফাজতের শীর্ষ নেতারা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বৈঠকেও সাম্প্রতিক সরকারবিরোধী কার্যক্রমের জন্য 'দায় স্বীকার' করেছিলেন হেফাজত নেতারা। এমনকি পুনরায় তারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতায়ও যেতে চেয়েছেন।
কোনও অন্যায় কাজ স্বীকার করলে বা নিজেদের দোষী হিসেবে মেনে নিলে শাস্তির মাত্রা হ্রাস পেতে পারে, তবে তার অর্থ এই নয় যে এর মাধ্যমে একজন ফৌজদারি আসামী তার অপরাধের দায় থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন। কিন্তু হেফাজত নেতারা ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া তাদের নেতাকর্মীদের মুক্তি-ই চাচ্ছেন।
কে অপরাধী এবং কে অপরাধী না যেহেতু সেটি নির্ধারণ করবে বিচার বিভাগ, তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও এসবি'র কর্মকর্তাদের সঙ্গে হেফাজতের নেতাদের এই 'নেগোসিয়েশন'কে দেশের আইন সমর্থন করে না। পুলিশের দায়িত্ব হল, হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তারা যে মামলাগুলো দায়ের করেছে সেগুলোর তদন্ত করা এবং আদালতে চার্জশিট দাখিল করা। গ্রেপ্তার হওয়া নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যে 'প্রতিশ্রুতি' দেওয়ার কথা হেফাজত নেতারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন; আইনীভাবে সেটিও তিনি দিতে পারেনা না।
এটা স্পষ্ট যে, হেফাজতকর্মীদের চালানো সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো যথাযথ আইনী পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করতে চান না হেফাজত নেতারাই। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া হেফাজতের আইন কী এটাই? দেশের সংবিধানে যেখানে বলা আছে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আইনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন, সেখানে হেফাজতের এমন রাজনৈতিক রীতিনীতি ও চর্চা দেশের সংবিধানেরই বিরোধী।
এমন পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে হেফাজত নেতাদেরকে দেখা করতে দেওয়ার অনুমতি ইঙ্গিত দেয়, হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা শতাধিক মামলা এবং সংগঠনটির পাঁচশো'রও বেশি নেতাকর্মীকে দেশজুড়ে নানা অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তারের পরও ধর্মীয় এই সংগঠনটির প্রতি একটি 'সফট কর্নার' রয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।
মঙ্গলবার রাতের বৈঠকে, ২০১৩ সালের শাপলা চত্ত্বরে ধ্বংসযজ্ঞের পর তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছেন হেফাজত নেতারা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা, পুলিশ ফাঁড়িতে, যানবাহন, অফিস ও দোকানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তখন ৫০টিরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। একাধিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ওই সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছিল ৩৯ জনের।
গত সাত বছর ধরেই মামলাগুলো স্থগিত ছিল কারণ এরমধ্যে সরকারের সঙ্গে 'সুসম্পর্ক' গড়ে তুলেছিল হেফাজত। এ সময়ে তারা সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেনি।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের বিরোধিতা করে হেফাজতের সহিংসতার পর পুরনো ওই মামলাগুলোর তদন্ত নতুন করে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কারণ এবার হেফাজতের সহিংসতা প্রশাসনকে বিরক্ত করেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যখন হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর তদন্ত করছে, তখন হেফাজত নেতাদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক সংস্থাগুলোকে যথাযথ তদন্তের বিষয়ে ইতিবাচক কোনো ইঙ্গিত দেয় না।
২০১৩ সালের সহিংসতার পরে হেফাজতকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো যেভাবে থেমে থেমে পরিচালনা করা হয়েছে তা আইনের শাসনের ভিতকে দুর্বল করে দিয়েছে। সরকার ও হেফাজতের মধ্যকার কথিত সমঝোতা এই মামলাগুলোর তদন্ত আটকে দিয়েছে।
সুতরাং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির উদ্দেশ্য নিয়ে এখনও অনেকের মধ্যে সংশয় রয়েছে- তারা কী হেফাজতকে পোষ মানানোর চেষ্টা করছে নাকি তাদেরকে অপরাধের জন্য শাস্তির আওতায় আনছে, সেটিই এখন প্রশ্ন হয়ে ঘুরছে।
- লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন: The rule of (Hefazat) law
- বাংলায় অনুবাদ: তারেক হাসান নির্ঝর