হেফাজতকে নিষ্ক্রিয় করার এখনই সময়
গতকাল রোববার দিনের শেষার্ধে হেফাজতের বর্তমান নেতা বাবুনগরী হেফাজতের বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেন। ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে তিনি জানান, 'হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। আগামীতে দলটি পুনর্গঠিত হবে সেই লক্ষ্যে বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত করা হলো।' দেশের বেশ কিছু মানুষ আহ্লাদী হলো এই ঘোষণায়। তারা মনে করলো হেফাজতকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করা গেল। হেফাজতের যে রাজনৈতিক দর্শন পৃথিবীতে বহু বছরে কখনো পরাজিত হয়নি। পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানাভাবে ছড়িয়ে আছে তা এখনও। এই দর্শন এত সহজে পরাজিত হওয়ার নয়।
বিভিন্ন কায়দায় বিভিন্নভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণার দাবি থেকে যতক্ষণ সরে না যাচ্ছে কিংবা শরিয়া আইন বাস্তবায়নের দাবি যতক্ষণ না পরিত্যাগ করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত হেফাজতকে অরাজনৈতিক সংগঠন বলা যাবে না।
হেফাজতি ওয়াজ সিন্ডিকেটকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। কারা ওয়াজ করতে পারবে এবং পারবে না সরকারের তাদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা উচিত। কেউ কেউ হয়তো বিষয়টিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলবেন, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদের পক্ষে কথা বলা সর্বত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একাত্তরের পরে আমাদের এমনি একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ছিল। বিগত দিনের ওয়াজের ভিডিও দেখে হেফাজতি যে সমস্ত মাওলানা দেশের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষকে পরকালের কথা বলে, মাদ্রাসা শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করে দেশকে একটি মৌলবাদী চক্রান্তের শিকারে পরিণত করতে চাচ্ছিল, সেই সমস্ত শিক্ষকদেরকে নিষিদ্ধ করতে হবে সকল মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্র থেকে।
মাদ্রাসা শিক্ষা এবং কওমি মাদ্রাসায় এই মুহূর্তেই একটি সাধারণ শিক্ষা সিলেবাস চালু করতে হবে। কওমি মাদ্রাসা এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোনো পাঠক্রম অনুসরণ করে না। আপাতদৃষ্টিতে হেফাজত হয়তো কৌশলগত কারণে তাদের পরাজয় মেনে নিচ্ছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে তাদের এই পরাজয়কে স্থায়ী করা। সেই জন্য সবকটি কওমি মাদ্রাসা বোর্ডকে আমাদের প্রাইমারি শিক্ষার অধীনে নিয়ে আসতে হবে যাতে তারা বিতর্কিত কোন বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে না পারে। এরা সবাই নিজেরাই নানানভাবে বিতর্কিত, সর্বশেষ এই মাওলানা মামুনুল যে সমস্ত বিষয় উত্থাপন করেছেন তা রাষ্ট্র এবং এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ইসলামেও স্বীকৃতি নাই। পৃথিবীর এমন কোন মুসলিম দেশ নাই যে দেশে বিবাহ নিবন্ধন করতে হয়না। মাওলানা মামুনুল হক সেই ফতোয়াটি দিলেন যে বিবাহ নিবন্ধন করার দরকার নাই। এমনকি চুক্তিভিত্তিক বিবাহ ঘোষণা দিলেন। তার দুটি চুক্তিভিত্তিক বিবাহ বৈধ ঘোষণা করলেন। চুক্তিভিত্তিক বিবাহ যদি বৈধ হয় তাহলে পতিতাবৃত্তি কি করে অবৈধ হয়? পতিতাদের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে সান্নিধ্য লাভ করা হয়।
একাত্তরে এরাই পাকসেনাদেরকে ইন্ধন জুগিয়েছে ধর্ষণের পক্ষে। এরাই সেই সময়ে ধর্ষণকে ধর্ষণ বলতেন না। চুক্তিভিত্তিক বিবাহের মতন ফতোয়া জারি করতেন। আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যারা ধর্ষিত হয়েছিল তাদেরকে কখনোই তারা স্বীকার করে নাই। এখন রাষ্ট্রের হাতে একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছে ৭৫ উত্তর বাংলাদেশে যেভাবে এদেরকে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল, যারা রাষ্ট্রটিকে একটি মৌলিক ধর্মতত্ত্বের মধ্যে নিয়ে গেছিল এটাই সুযোগ তাদেরকে নিরস্ত্র করার। ৭৫ উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে, বিভিন্নভাবে প্রবেশ করেছে; এটাই উপযুক্ত সময় তাদেরকে সর্বত্র নিষ্ক্রিয় করার।
মাদ্রাসা শিক্ষা, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা পুরোপুরিভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। সরকার তাদেরকে ছাড় দিয়ে দেখেছে, তাদের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে দেখেছে যে কি ভয়ঙ্কর শত্রু এরা! এরা সমাজকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে ফেলে। সে কারণে এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আফগানিস্থান প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটি দেশ। এক হিসাবে জানা যায় দেশটিতে প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদ মজুদ আছে। কিন্তু দেশটি দারিদ্র্যের তালিকায় শীর্ষে আছে এবং সমাজ এমনভাবে বিভক্ত যে প্রতিদিনই সেখানে নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করছে।
১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন সেনা প্রত্যাহার হলে দেশটি নারীরা আবার আবদ্ধ হবেন তালেবানি যুগের মতন। আমাদের দেশের হেফাজতিরাও একই দর্শনে বিশ্বাসী।
একসময় পাকিস্তান রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমানে সমান টেক্কা দিয়ে চলছিল। কিন্তু যখন থেকে এই শরিয়া এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র কায়েম করল পাকিস্তান তখন থেকেই দেশটির অর্থনৈতিক পতন শুরু হল। দেশটি আজ প্রায় নিঃস্ব হয়ে অপরের দয়ায় বেঁচে আছে। এবং কোভিডকে কেন্দ্র করে এতদিন পরে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সত্যিকারের চেষ্টা করছে বলেই মনে হয়। কারণ পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে লড়াই করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। পাকিস্তানের কাছে কেউ আর এখন অস্ত্র বিক্রি করে না। অস্ত্র বিক্রি করে ভারতের কাছে এবং উঠতি অর্থনৈতিক দেশগুলোর কাছে।
মুক্তিযুদ্ধের সরকারের কাছে একটি আবেদন আপাতত হেফাজত এবং কওমি মাদ্রাসার ভিত্তিমূলকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বাংলাদেশে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়ন করার।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক