সস্তার দিন শেষ
ভাড়া বাড়াতে কয়েকশ পরিবহন মালিক সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে যাওয়ায় জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত দাম সরাসরি যাত্রীদের ওপর চেপেছে। ফলে সরকার ভর্তুকি থেকে মুক্তি পেলেও সড়ক এবং নৌচলাচল খাতে কর্মরত প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিকের জন্য এই চুক্তি কোনো সুফল আনেনি। অন্যদিকে মালিকপক্ষের চাপানো ধর্মঘটে তিনদিনের আয় হারালেও তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে না।
হুট করে ধর্মঘট দেওয়ায় ভর্তি এবং নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি কয়েকশ কিংবা কয়েক হাজার ভর্তিচ্ছু ও চাকরিপ্রার্থী। তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার মতোও কেউ নেই।
পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটায় সবজি ও মাছের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই বাড়তি দাম থেকে কৃষক এবং জেলেদের কোনো লাভ হবে না।
মহামারির ধাক্কা সামলে উঠে শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ কেটে যাওয়ায় চাকরি ও উপার্জন ফিরে পাওয়া নিয়ে আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছিল সাধারণ মানুষ। ঠিক সেই সময় হানা দিলো এক নতুন আঘাত।
ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভার্নেন্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক জরিপে নিম্ন আয়ের মানুষের কঠিনতর জীবনধারার চিত্র উঠে এসেছে। মহামারির পর এই মানুষগুলোর উপার্জন ২৩ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির আগে দরিদ্র নয় কিন্তু ঝুঁকিতে থাকা মানুষের গড় আয় ছিল ১১৪ টাকা। চলতি বছরের আগস্টে তা ৮৮ টাকায় নেমে এসেছে।
জরিপের তথ্যানুসারে, ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে খাবারের পেছনে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত খরচ কমাতে হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে আগস্টে দিনে একবেলা খাবার বাদ দেওয়া মানুষের সংখ্যা চারগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
অংশগ্রহণকারীদের ১০ শতাংশ মহামারিতে চাকরি হারানোর পর এখন পর্যন্ত কর্মহীন। অন্যদিকে, ৬৯ শতাংশই নতুন কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নন।
প্রতি কিলোমিটার ৪৫ পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির হিসাব নগণ্য বলে মনে হতে পারে। দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ায় আগে থেকেই নাভিশ্বাস ফেলছিল সাধারণ মানুষ। এবার ভাড়া বাড়ার প্রভাব বহুগুণে বেড়ে মানুষের ওপর আরেকটি নতুন বোঝা চাপিয়েছে।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জুনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে মহামারি চলাকালে সরবরাহে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় দেশে জীবিকা নির্বাহের হার ৬.৮৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। একইসঙ্গে কমে সাধারণ মানুষের আয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য অস্থিতিশীল থাকায় পণ্যের দাম বাড়তে থাকে।
এর ওপর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অভ্যন্তরীণ প্রভাবক হিসেবে জীবিকা নির্বাহের ব্যয় আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
মসুর ডাল, চিনি থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল ও প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। সরকার রান্নার সিলিন্ডার গ্যাসের দামও বাড়িয়েছে। সর্বশেষ ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম বাড়ায় বাসভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কৃষিকাজে সেচের খরচও বাড়বে। প্রাতিষ্ঠানিক হিসাবে বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে থাকা দেশের প্রায় এক শতাংশ জনগোষ্ঠীকে বাতি জ্বালাতে প্রতি লিটার কেরোসিনে বাড়তি ১৫ টাকা গুনতে হবে।
মধ্যবিত্তদের জন্য জীবিকা নির্বাহ সহজ নয়। মহামারির সময় স্কুল বন্ধ থাকায় কিছু খরচ এড়ানো গেলেও স্কুল চালু হওয়ায় পরিবারগুলোকে বাড়তি খরচ টানতে হবে। খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বাস ও লঞ্চ ভাড়া বাড়ায় খাদ্যপণ্য ভিন্ন অন্যান্য দ্রব্যের দামও বৃদ্ধি পাবে।
ভাড়া বাড়ায় ট্রাক মালিকরা পৃথক আন্দোলন শুরু করে। সব ধরনের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে তা সরাসরি ভূমিকা রাখবে। বৈশ্বিক সরবররাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটায় আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ইতোমধ্যে আকাশচুম্বী। ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিকরা স্থানীয় পর্যায়েও একই ধরনের জটিলতার সৃষ্টি করে। ট্রাক ধর্মঘট কেবল স্থানীয় বাজার সরবরাহেই ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে যখন উৎসবের মৌসুম, তখন সময়মতো পণ্য রপ্তানিতেও হিমশিম খাচ্ছে দেশের রপ্তানিকারকরা। ফলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যও এখন বাধাগ্রস্ত।
জ্বালানি তেলের রাষ্ট্রায়ত্ত মনোপলি প্রতিষ্ঠান বিপিসি শর্টকাট পথ নিয়েছে। অন্যদিকে, সড়ক ও নৌ চলাচল নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ এবং বিআইডব্লিউটিএ যাত্রীদের বাস ও লঞ্চ ভাড়া বাড়িয়ে পরিবহন মালিকদের সহায়তার মাধ্যমে পুরো বিষয়টি বাস্তবায়ন করেছে। ট্রাক মালিকরা ধর্মঘট স্থগিত করলেও তারা নিজেরাই এখন ভাড়া বৃদ্ধি করবে। কেননা, তাদের পণ্য পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে এই বাড়তি ভাড়া গিয়ে পড়বে দেশের সাধারণ ক্রেতাদের ওপর।
বাংলাদেশের ৬.০৩ ট্রিলিয়নের বাজেটে জনগণকে বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির হার থেকে কিংবা অন্তত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি থেকে রক্ষার কোনো ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল। সেচের জন্য ডিজেল ব্যবহারে কৃষকদের জন্য সরাসরি নগদ ভর্তুকি দেওয়া উচিত। এছাড়া উড়িরচর দ্বীপ ইউনিয়নে যেখানে বিদ্যুৎ নেই এবং কেরোসিনের বাতি জ্বালাতে হয় সেখানেও এই ভর্তুকি দেওয়া উচিত। পরিবহন মালিকদের জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি সামলে উঠতে করপোরেট কর কিংবা ব্যাংক সুদের ভর্তুকির মাধ্যমে কিছু ছাড় দেওয়া যেতে পারে।
তবে, সমাধানের সবচেয়ে সহজ পথটি হলো সরকারের ট্যাক্স ও শুল্ক কমানো। জ্বালানি তেলের দামের ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৮০ টাকা লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের ২৪ টাকাই এই ট্যাক্স ও শুল্ক। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) যেদিন ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়ায়, সেদিন বাড়তি ভ্যাট ও শুল্ক কমিয়ে তেলের দাম প্রতি লিটারে ১৭ থেকে ২৪ টাকা কমিয়ে জনগণকে কিছুটা হলেও ভারমুক্ত করে ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার।