সমাজের সব সংকটের শেষ কথা বিচার বিভাগ হতে পারে না

আমরা ক্রমান্বয়ে জটিল এক সমাজ বাস্তবতার দিকে ধাবিত হচ্ছি। সে কারণে প্রায়শই সামাজিক অনেক বেসামাল অবস্থার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত সিস্টেম কাজ করছে না। মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে।
মানুষের এরকম অসহায়ত্বের কথা সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে, আমরা প্রতিদিন দেখি। সাম্প্রতিক উচ্চ আদালতের এক রুল নিষ্পত্তিতে সমাজের এক অবিশ্বাস্য চিত্র ফুটে উঠেছে ।
ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র রাজারবাগ পুলিশ লাইন এর সামনে এক 'পীর' আস্তানা গড়ে তুলেছেন। বেশ বড়সড় দলবল (মুরিদ) নিয়ে পীরের চলাফেরা। সংবাদপত্রের মাধমে জানা ঘটনার বিবরণ এ রকম, কথিত পীরের আস্তানা লাগুয়া তিন শতক নিজস্ব জমির উপর তিনতলা বাড়িতে এক ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। ভদ্রলোকের মৃত্যুর পর ঐ বাড়ি ও জমির উপর নজর পড়ে ঐ পীরের। কৌশলে ঐ ভদ্রলোকের স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে মুরিদ বানিয়ে তাদের অংশের জমি ও বাড়ি পীরের নামে লিখে নেয়। সমস্যা তৈরি হয় অন্য দুই ছেলে, যারা পীরের মুরিদও হয় না এবং তাদের অংশের জমি ও বাড়ি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। শুরু হয় নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ। এই পীরের অভিনবত্ব হলো, পীর তার মুরিদদের দিয়ে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় মোট ৪৯ টি মামলা দায়ের করে।
মামলাগুলোর বিবরণে জানা যায়, মামলাগুলো ধর্ষণ, মারধর, চুরি ও মানবপাচারের মতো অপরাধের বিভিন্ন ধারায়। আদালতের শরণাপন্ন হওয়া মানুষটি ইতোমধ্যে ১৩ টি জেলায় ২০ টি মামলায় ১ হাজার ৪৬৫ দিন অর্থাৎ ৪ বছর কারাভোগ করেছে। আমরা আশা করতে পারি, সীমাহীন অন্যায়ের শিকার মানুষটি ন্যায় বিচার পাবেন।
ঘটনাটির বিবরণ দিলাম একারণে, এর মধ্য দিয়ে পীরতন্ত্রের ক্ষমতা, দাপট ও দৌরাত্ম্য বোঝা যায়। প্রশাসনকে কুক্ষিগত করে এরা দিনের পর দিন মানুষের সাথে প্রতারণা, জুলুম ও দখলদারিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে।
গতকাল রবিবার উচ্চ আদালতের একই বেঞ্চ রাজারবাগ পীর দিল্লুর রহমানের সম্পদ ও দায় দেনা তদন্ত করার জন্য দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সাথে কোন জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগকেও নিদের্শ দেওয়া হয়েছে।
উচ্চ আদালত সূত্রে জানা গেল, এখন বাদীদের পুলিশ খুঁজে পাচ্ছে না। তার মানে, পুলিশ মামলা গ্রহণের সময় বাদীর পরিচয় যথাযথভাবে নেয়নি। মামলার নথিতে বাদীর জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সংযুক্ত রাখার নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, দেওয়ানি মামলা ফৌজদারি মামলায় রূপান্তরিত করা এবং আসামী গ্রেপ্তার করে কোর্ট ও জেলে প্রেরণ করার উদাহরণ অনেক।
প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন যথাযথভাবে কাজ করলে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের নানা প্রান্তে ৪৯ টি ফৌজদারি মামলা হবার কথা নয়। প্রশাসনের জবাবদিহিতা দৃশ্যমান নয়। একজন নিরাপরাধ ব্যক্তি ৪৯টি মামলা কাঁধে নিয়ে ৪ বছর জেলে ঘানি টানে, অন্যদিকে নষ্ট, ভ্রষ্ট তথাকথিত পীর অন্যের সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করে। এরা সারা দেশে তাদের কথিত মুরিদ দ্বারা এক ধরনের জাল বিস্তার করে।
এরা ঠিক শিকারীর মত মানুষের যেকোন বিপর্যয় বা খারাপ সময়ে অপেক্ষায় থাকে। ঐ বিপর্যস্ত মানুষকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কথিত পীরের আস্তানায় নিয়ে হাজির করে। 'মুরিদের' কাজ এখানে শেষ এরপরের কাজ 'পীরের'।
আমাদের দেশের এই পীরতন্ত্র কেবল ঐ 'তিন শতক' জমি দখলের মধ্যে ভাবলে ভুল হবে। কোন কোন পীর তার আস্তানায় বসে নাকি ঠিক করে দিতেন মন্ত্রীসভা, সামরিক- বেসামরিক আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগের শীর্ষ পদে কে আসবেন, কে যাবেন।
মানুষের এই ধারণা পোক্ত হতে থাকে আশির দশকে এরশাদের সময় ফরিদপুরের আটরশি পীরের আস্তানা ঘিরে। কে নমিনেশন পাবেন, কে মন্ত্রী হবেন অথবা বড় কোন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ কোন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান পাবে সবই ঠিক হতো পীরের মাধ্যমে। রাষ্ট্রপতি এরশাদ প্রতি মাসে একাধিকবার আটরশি আসতেন এবং পীরের সাথে একান্তে সময় কাটাতেন। ঐ সময়ে এদেশের এমন কোন সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রধান পাওয়া যাবে না যিনি আটরশি পীরের আর্শীবাদ না নিয়েছেন।
সারাদেশে পীরের নাম ছড়িয়ে পড়লো। সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ পীরের মুরিদ হতে লাগলো। জেলা উপজেলায় সমন্বয়কারি তৈরি হলো। শত শত বাসের 'কাফেলা' নিয়ে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়লো। এমনও মানুষ আছেন যিনি তার শেষ সম্বলটুকু পীরের কাছে তুলে দিয়েছেন তার সন্তুষ্টির আশায়। পীরের বংশধরদের বিলাসপূর্ণ জীবন দেখেই মানুষ বুঝতে শুরু করে যে, সে প্রতারিত হয়েছে। মানুষের সংকট আরো গভীর হয়।
কৌশলের বদল ঘটছে। এখন অনেক নারী পীর দেখা যায়। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরেও অনেক নারী পীর রয়েছেন। আগে তেমন ছিল না। তবে পীর সর্বত্র। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা এমন কি গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পীর বা পীরের মাজার রয়েছে। ঢাকা শহরে এর ব্যাপকতা মারাত্মক। সায়েদাবাদের পীর, আরামবাগের পীর, রাজারবাগের পীর, মোহাম্মাদপুরের পীর। এরা সব রাজসিক কায়দায় বসেন।
সমস্যা ক্লিস্ট মানুষ তার সমস্যা থেকে নিষ্কৃতির আশায় সমাধান পেতে আসে। পীর দোয়া করার পাশাপাশি ঝাড়, ফুক বা তাবিজসহ নানাবিধ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এসকল পীরদের অন্যতম আর একটি কাজ হলো ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের তদবির জাতীয় কাজ করা। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে অর্থে বিনিময়ে এই তদবিরের কাজ ক্ষেত্র বিশেষে করে থাকেন।
অসহায়ত্ব মানুষকে অদৃষ্টবাদী করে তোলে। দরিদ্র ও অসহায় মানুষ তার অবস্থার পরিবর্তন চায়। চায় একটু স্বচ্ছলতা একটু প্রশান্তি। আর সমাজের বিত্তবানদের চাওয়া দীর্ঘ জীবন, পরকালের সুখ ও শান্তি। সমাজের এই দুই অংশের চাওয়া কোনো না কোনো পীর বা মাজারে একত্রিত হয়।
কিশোরগঞ্জের পাগলা পীরের মসজিদের দান বাক্সে প্রতি তিন মাসে গড়ে দেড় কোটি অর্থাৎ বছরে ৬ কোটি টাকা ও স্বর্ণালংকার জমা হয়। দানবাক্সগুলো খোলার সময় সেখানে স্থানীয় প্রশাসন নিরাপত্তা বিবেচনায় তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ পুলিশ মোতায়ন করে এবং তাদের উপস্থিতিতে দিনভর লেগে যায় টাকা গণনার কাজ শেষ করতে। যদিও এই তহবিলের দেখভাল করেন জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি টিম।
এরকম দানবাক্স সকল পীরের আস্তানা বা মাজারগুলোতে রয়েছে। যেখানকার আহরিত অর্থ পীর ও তার বংশধর ভোগ করে। এই অর্থের হিসাব তাদের কোথাও দিতে হয় না। এমনকি আয়কর বিভাগেও না। সারা দেশে পীর ও মাজারগুলোতে যে হাজার কেটি টাকার সম্পদ বা সম্পত্তি রয়েছে তা কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। জানা নেই আয় ব্যয়ের হিসাব।
মানুষের দুর্দশার সুযোগ যেন কেউ নিতে না পারে তার জন্য প্রশাসনকে শক্তভাবে এগিয়ে আসতে হবে। পীরের অর্থ ও সম্পদের উৎস জানাতে হবে। যথাযথ কর ধার্য্য করে তা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থাকলেও মানুষ প্রথমে ছুটে যায় পুলিশের কাছেই। পুলিশ উদ্যোগী ভূমিকা নিলে মানুষের দুর্দশা লাঘব হতে পারে।
তবে এটাও সত্য, কেবল পুলিশি ব্যবস্থায় এ সমস্যার সমাধান হবে না। অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাতপদ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত এই এলাকার মানূষ আদিকাল হতে দারিদ্র ও শোষনের মধ্যে আবর্তিত। প্রকৃত শিক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা সেভাবে হয়নি। মানুষ আশ্রয় খুজেছে ধর্মের কাছে। আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার কাছে সমর্পিত হতে চেয়েছে। এর মধ্যেই তার মুক্তি।
আধ্যাত্মিকতার চর্চার বিস্তার সমাজের গভীরে। পীরতন্ত্রের আবির্ভাব ও বিকাশের সূত্রটি এখানে। এটা মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত। চাইলেই এটা উপড়ে ফেলা যাবে না। আজ যে সকল ভণ্ড পীর সেজে প্রকাশ্যে মানুষকে ঠকাচ্ছে তারাও জানে ধর্মতত্ত্ব তাদেরকে রক্ষা করবে।
সাম্প্রতিক আমাদের উচ্চ আদালত ধর্মতত্ত্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তথাকথিত পীরদের নিয়ে সাহসী প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এটা আশার কথা। রাষ্ট্রের অপরাপর অংশকেও মানুষের পরিপূর্ণ আস্থায় আনতে পারাটাই প্রকৃত বিকল্প। তা নাহলে মানুষ আশ্রয় খুঁজবে কোন না কোন আস্তানায় এবং একই ভাবে সে প্রতারিত হবে। এই চক্র থেকে মুক্তি মিলবে না।
সেকারণে বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবেই দেখতে হবে। মানুষের আধ্যাত্মিক মনো চেতনাকে উস্কে দিয়ে নির্বাচনী বৈতরনী পার হওয়ার চেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে। এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেন, রাজনৈতিক কোন দল মানুষের ধর্মীয় আবেগ ও অনুভুতি রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে। যে প্রবণতা উপমহাদেশের বাকি দুটি দেশেও প্রবলভাবে বিদ্যমান।