সবক্ষেত্রেই উড়ে এসে জুড়ে বসাদের চটক
আজ যে হিরো, কাল সে জিরো হতেই পারে। কোন একটা ঘটনা হয়তো সেই হিরোকে জিরো বানিয়ে ছাড়ে। এই যদি বলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা থেকে পথশিশু জিনিয়াকে অপহরণ করতে গিয়ে জিরো হয়ে গেল প্রবল ক্ষমতাধর লোপা তালুকদার। আমার এখন একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে যে ভাগ্যিস ফুল বিক্রেতা শিশুটিকে উধাও করে দিতে চেয়েছিল লোপা, তা না হলে এইরকম একজন "প্রথিতযশা নারীকে" কি আমরা চিনতে পারতাম? কী আশ্চর্য ব্যাপার নিজের নামের পাশে শতশত বিশেষণ যোগ করে, সে নেমেছে মানুষ চুরির কাজে। শুধু মানুষ চুরিই বা বলি কেন, পুলিশের তথ্য মতে, তার খারাপ কাজের সংখ্যাও হাতে গুণে শেষ করা যাবে না।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে একটি ছবিতে দেখলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে এই লোপা পুরস্কার গ্রহণ করছে। অনেক মন্ত্রীদের সাথেও তার ছবি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে ভিআইপিদের সাথে দেখা যাচ্ছে। অথচ এই মানুষটিই একখানা মুজিব কোট গায়ে চাপিয়ে, বুকে নৌকার কোটপিন লাগিয়ে বিরাট আওয়ামীলীগার সেজে শিশু চুরির কাজে নেমেছে। শোনা গেল এই শিশুটিকে দিয়ে অনৈতিক কাজ করানোর ইচ্ছা ছিল তার। কী ভয়ংকর অবমাননা মুজিব কোটের এবং দলের। তদন্তের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এতদিন ধরে এই লোপা নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে, চাকরি দেয়ার নাম করে প্রচুর টাকা হাতিয়েছে। তারা বলেছে লোপার অতীত ভালো নয়। নিজের বাড়ি পটুয়াখালিতে সে অন্তঃসত্ত্বা নারী হত্যারও আসামি ছিল।
এরকম একটা আপাদমস্তক অভিযুক্ত নারীর কিভাবে রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায়ের মানুষের সাথে পরিচয় থাকে? তার ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে যে পরিচয়ের বহর দেখা গেছে, তাতে অবশ্য এই প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ থাকে না। মামলা কাঁধে নিয়ে যে নারী অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারে, সে যে কতবড় ধুরন্ধর, তা সহজেই অনুমেয়। শুধুমাত্র একটা মুজিব কোট পরে কেউ যদি আওয়ামীলীগার সেজে মানুষকে ধোঁকা দিতে পারে, তাহলে তা দল এবং দেশের জন্য খুব ভয়ংকর। অনেকগুলো মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরেও সে অবাধে সব জায়গায় বিচরণ করেছে। এরকম লোপা আছে সারা দেশজুড়ে। এদের থামাতে না পারলে আমাদের জাতীয় জীবনে পচন ধরেছে তা ভবিষ্যতে কোনও কিছু দিয়ে থামানো যাবে না। তাই শুদ্ধি অভিযানটা এখনই শুরু করা দরকার।
কথা হচ্ছে একজন টাউট টাইপ মানুষ টাউটারি করে বেড়াতে পারে অনায়াসে। কিন্তু তাই বলে হাই প্রোফাইল মানুষের কাছে সে বা তারা পৌঁছায় কেমন করে? একজন ব্যক্তি যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নিবে, তখন তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হয়না কেন? এটা দেখার কি কোন অফিসিয়াল সিস্টেম নাই? একজন উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষ কীভাবে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পাশে দাঁড়ানোর সাহস পায়? গেট কিপিং কোথায়? অথচ অনেকেই আছেন, যারা সত্যিকার অর্থে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের ক্ষমতাও হয় না রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি পৌঁছানোর।
এইতো মাত্র কয়েকদিন আগেই দেখলাম আরেক টাউট রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে নিয়ে তোলপাড় হলো। এরকম একটি মিথ্যাবাদী, তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ কীভাবে সারা মিডিয়া জগতে একজন "বুদ্ধিজীবি" হিসেবে আবির্ভূত হলো? একটা অনুমোদনহীন হাসপাতাল দিয়ে জমজমাট ব্যবসা ফেঁদে বসলো। করোনা না এলে এবং করোনাকে নিয়ে মিথ্যা ব্যবসা না করলে, আমরা হয়তো কখনো জানতামই না, মিডিয়া জগতের এই তথাকথিত "বরেণ্য অশিক্ষিত" লোকটি সম্পর্কে। আমাদের জানা মতে গণমাধ্যমের মানুষরা বিভিন্ন মানুষের হাঁড়ির খবর জানেন, এই তারাই সাহেদের মতো একটা দুই নম্বর লোককে কেন অতিথি বানিয়ে আনতো? তারা কি অতিথি বা বিশেষজ্ঞ হিসেবে যাদের আনেন, তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর না নিয়েই আনেন? দেশের এমন কোন ভিআইপি নেই, যার সাথে এই সাহেদের ছবি নাই। সাহেদ ধরা পড়ার পর সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো। সাহেদ, লোপারা কোথা থেকে, কাদের আস্কারায় উড়ে এসে, জুড়ে বসল এবং রাজ্য জয় করলো -- এটা জানতে পারলে ভাল হতো।
এরকম একটা তেলেসমাতি টাইপ বোদ্ধা লোককে বুধবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে অবৈধ অস্ত্রসহ কাদা মাখামাখি অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হলো, কী কান্ড। এরপর একে একে বেরিয়ে এলো তার নানাধরণের কুকীর্তির কথা -- করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট প্রদান, অর্থ আত্মসাত সহ বহু প্রতারণার মামলায় আসামি। বহুমুখী প্রতারণায় অভিযুক্ত ম্যাট্রিক একজন লোক দিব্যি টেলিভিশন টকশোতে নিজেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে জাহির করতো। সে নিজেকে আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সদস্য হিসেবে সব জায়গায় পরিচয় দিতো। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে আওয়ামীলীগের পরিচয় ভাঙিয়ে কত নিম্মমানের লোক ফায়দা হাসিল করে যাচ্ছে। আমাদের বক্তব্য একটাই, কেন এই লোকগুলোকে আমরা তোয়াজ করি? কেন ঘটনা ঘটার আগে এদের চেহারা উম্মোচন করিনা? শুধু রাজনৈতিক পরিচয়ই এদের শক্তির উৎস বলে মনে হয় না। এদের অর্থের শক্তিও কম না। এই অর্থ দিয়েই এরা সবাইকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসে।
এই অখ্যাত সাহেদের সাথে আমরা পেলাম একজন হৃদরোগের নারী ডাক্তারকে। সেই ডাক্তারকে নিয়েও উত্তেজনার শেষ ছিল না। আটককৃত নারী ডাক্তারের দোষ বা অন্যায় যতোটা না বিবেচ্য ছিল, এর চেয়েও অনেক বেশি আলোচনার বিষয় ছিল সেই ডাক্তারের সৌন্দর্য, পোশাক, ব্যক্তিগত জীবন, ফেইসবুকে দেয়া ছবি। কেন এরকমটা ঘটলো? কারণ এই নারী চিকিৎসক খুব সুন্দরী। তাই এখানে তার অন্যায়ের চেয়ে সৌন্দর্য বেশি আলোচিত হয়েছে।
এরকমই একদিন উদিত হলো যুব মহিলা লীগের বিতর্কিত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। নগরীর পাঁচতারকা হোটেলে রাজকীয় কায়দায় জীবনযাপণ করা এই পাপিয়ার কথা কি আমরা এই প্রথম জানতে পারলাম? কেন তার এই বিলাসী জীবনের কথা মানুষ এতদিন জানে নাই? এতো ভিআইপি তার কাছে আনন্দ নেয়ার জন্য এলেও, সেই কথা জানতে আমাদের দেরি হলো? কেন শুধু ব্যক্তি ধরার পড়ার পরই প্রকাশিত হয় অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। যে মানুষের অবৈধ ও অনৈতিক কোটি কোটি টাকার নেটওয়ার্ক নরসিংদী থেকে থাইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত, তার কথা এত হঠাৎ উম্মোচিত হওয়াতে আমরা কিন্তু বেশ অবাকই হলাম।
পাপিয়া ও তার স্বামী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন ওরফে মতি সুমন যে কতটা ভয়ংকর ছিল, সেকথা অনেকেই জানতো, তাহলে কীভাবে এই স্বামী-স্ত্রী এমন একটা কাতারে উঠে এল, যেখানে সব হাইলেভেলের লোকজনের যাতায়াত। দীর্ঘদিন ধরে এত ধরণের অভিযোগ থাকার পরও ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে তৌহিদা সরকার রুনা সভাপতি ও শামীমা নূর পাপিয়া সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল। এভাবেই রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে অবৈধ অর্থ শক্তির মিশেল হয়ে এইসব প্রবল প্রতাপশালী মাফিয়ারা গড়ে ওঠে। কিন্তু কী এমন ঘটে যে, এদের হঠাৎ করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়? এই বিষয়গুলো সবসময় পর্দার অন্তরালেই থেকে যায়। কদাচিৎ পর্দা উঠলেও, আবার টাকা পয়সা ও পেশী শক্তির জোরে এরা বেরিয়ে আসে। এবং এরা নির্বিবাদে একসময় আবার মূলস্রোতে মিশে যায়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে এরকম উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকের অভাব নেই। এরমধ্যে সবাই হয়তো অসৎ নয়, কিন্তু অনেকেই যোগ্যতাহীন এবং খুবই নিম্মমানের। এইসব গজিয়ে ওঠা লোকদের কেউ গান গায়, কেউ অভিনেতা, কেউবা ব্যবসায়ী, কেউ সাংবাদিক, কেউ ছবি আঁকে, ডাক্তার, বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত, কবি, লেখক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি কর্মকর্তা সব শ্রেণীই আছে। এ্ররা কিভাবে বা কোন চ্যানেলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে, বোঝাও যায়না। সবাই যে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা টাকা পয়সার জোরে উঠে আসছে, তাও নয়। এইসব আচানক উত্থান দেখে দেখে অনেকেই হয়রান এবং বিরক্ত। অদ্ভুত এক তেলেসমাতি চলছে চারিদিকে। আজকে হয়তো গায়ক হিসেবে একজনের নাম শুনলেন, কালকেই দেখবেন সে জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কার লাভ করছে। আজকে লিখতে শুরু করে, কালকেই ৩০ টি বই বাজারে চলে এলো। কিংবা আজকে রাজনীতি করতে শুরু করে, কালকেই এমপি বা মন্ত্রী হয়ে গেল। এরকম অসংখ্য নজীর আছে। দেশের সব সেক্টরে অসৎ ও অযোগ্যদের ছড়াছড়ি আর সৎ, যোগ্য লোকের অভাব চারিদিকে। এর পরিণাম হচ্ছে ভয়াবহ।
প্রতিটা ক্ষেত্রে যে সিড়িঁর ধাপ পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়, সেই তরিকাটা বাংলাদেশে আর নাই বললেই চলে। কে কার পাশে দাঁড়াতে পারে, কে কার সাথে সেলফি তোলার যোগ্যতা রাখে বা কে কী যোগ্যতা নিয়ে কোন পদে অধিষ্ঠিত হতে পারে এর কোন গ্রামার মানা হয় না। আর সেই কারণেই আমরা প্রতিদিন শতরকমের অব্যবস্থা ও দুর্নীতির খবর পাই। যেখানে অযোগ্য লোক, যোগ্য লোককে পেছনে ফেলে উঠে আসবে, সেখানেই সাহেদ, লোপা বা পাপিয়ারা মাথাচাড়া দেবেই। শুধু সেক্টরগুলো হবে ভিন্ন।
প্রসঙ্গত মনে পড়লো কলিম শরাফীর কথা। সংগীতে অনন্য অবদানের জন্য কলিম শরাফী একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুব উল্লাহ স্বর্ণপদক, বাংলা একাডেমীর রবীন্দ্র পদকসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন। এই মহান মানুষটির সঙ্গীত জীবন দীর্ঘ হলেও, তাঁর প্রকাশিত অ্যালবামের সংখ্যা মাত্র ১৮টি; ১৫টি ক্যাসেট, ৩টি সিডি। অথচ এখনকার শিল্পীদের দিকে তাকালে অবাক হতে হয়। নিভৃতচারী বলে কোন শব্দ আর অভিধানে থাকছে না। যোগ্যতা-অযোগ্যতার কোন ব্যাপার নেই। সবাই উচ্চকন্ঠ। আর তাই বোধকরি আমাদের সমাজ, সংস্কৃতির এই অবস্থা ।
আমরা ভুলে গেছি সেই কথা, "দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য, সর্পের মস্তিকে মণি থাকিলেও কি সে ভয়ংকর নহে?" শিক্ষিত দুর্জন লোকেরাও এখন আর অশিক্ষিত দুর্জন লোকের দাপটে টিকতে পারছে না। আর সেখানে সজ্জন লোকের পক্ষে মাথা তুলে দাঁড়ানো যে কতটা কঠিন হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন