শীত, কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ ও আসন্ন বইমেলা
অতিমারীর শোকগাঁথা
একে একে হারাচ্ছি সবাইকে। ২০২০-এর এই অভূতপূর্ব-অদৃষ্টপূর্ব-অশ্রুতপূর্ব অতিমারী শুধু যে দেশে মহাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে বা উন্নত থেকে স্বল্পোন্নত সব রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকাকেও অচল করে দিচ্ছে, তা' নয়। এই অতিমারীর ছোবলে মৃত্যু তরান্বিত হচ্ছে দেশ বিদেশের বহু প্রতিভাবাণ গুণীজনের। ফুটবলের চির বিদ্রোহী, অদম্য শিশু দিয়েগো ম্যারোদোনা আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যেতে না যেতেই বাংলাদেশের নাট্য ভুবনের অন্যতম প্রাণপুরুষ আলী জাকের প্রয়াত হয়ে গত সপ্তাহে আর এক দফা কাঁদালেন দেশবাসীকে।
আর অল্প কিছুদিন আগে চলে গেছেন ওপার বাংলার নামী অভিনেতা, আবৃত্তিকার ও কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়- অপু, ফেলুদা, উদয়ন পন্ডিত সহ কত চরিত্রেই না তিনি অভিনয় করেছেন!
বুয়েন্স আয়ার্সের বস্তি থেকে উঠে আসা ছোট-খাট, হাসি-খুশি খেলোয়াড় ম্যারাদোনা তার দেশ আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬-এর বিশ্বকাপে এনে দিয়েছিলেন সোনার কাপ। বাতাসের বেগে প্রতিপক্ষের অসংখ্য খেলোয়াড়কে পাশ কাটিয়ে জালে বল ঢোকানোর সেই যাদুকরী দক্ষতা আজো আমাদের চোখে ভাসে। 'সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ!'- লাতিন আমেরিকার যে অপুষ্ট শিশুরা বড় হয়েও উচ্চতা বা স্বাস্থ্যে কখনোই ইউরোপের ছ'ফুটাকৃতি খেলোয়াড়দের সাথে শারীরিক স্ট্যামিনায় তূল্য হবার নয়, দৈহিক শক্তির সেই ঘাটতি মিটাতে ইউরোপের 'টোট্যাল ফুটবলে'র বদলে লাতিন ফুটবল শৈলী ও কৌশল নির্ভর হয়ে উঠেছে যার অনন্য যাদুকর ছিলেন ম্যারাদোনা। কখনো মাদক সেবনের দায়ে নিন্দিত আবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো সহ লাতিন আমেরিকার সব বামপন্থী রাষ্ট্রনায়কের প্রিয় বন্ধু দিয়েগো মারাদোনার জন্য কান্না না ফুরোতেই আমার একটা সকালের শুরু এদেশীয় থিয়েটারের অন্যতম পুরোধা অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক আলী যাকেরের দু:খজনক প্রয়াণ সংবাদ দিয়ে।
'জাগো বাহে কুনঠে সবায়!' ডাকে তার মেঘ মন্দ্রিত কণ্ঠস্বর আর মঞ্চে সেই দীর্ঘদেহী, সবল উপস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে বৃটিশ আমলে রংপুরের কৃষক বিদ্রোহের সেই অবিসংবাদিত নায়ক নূরলদীনকে। সৈয়দ শামসুল হকের এই কাব্যনাটক ১৯৮৩ সালে যখন মঞ্চস্থ হচ্ছে, তারই আগে ১৯৮২ সালে আমি 'শিশু' পত্রিকায় রংপুরের কৃষক বিদ্রোহের নায়ক নূরলদীনের উপর একটি ছোট লেখা পড়ছি। সেখানে হাশেম খানের স্কেচে নূরলদীন অবশ্য এক শীর্ণকায় কৃষক। কিন্তু মঞ্চে সেই এস,এম, সুলতানের সূত্র মেনে ('বাংলার কৃষক যত শীর্ণকায় হোক, তার সংগ্রামই প্রমাণ করে যে আসলে সে কতটা পেশীবহুল') আলী যাকেরকেই নূরলদীন হিসেবে আনাই সেরা নান্দনিক ও আত্মিক বিবেচনা ছিল নিশ্চিত। কখনো 'গ্যালিলিও' আবার কখনো টিভিতে ধারাবাহিক 'বহুব্রীহি' নাটকের প্রবল জনপ্রিয় 'মামা' আলী যাকের আমাদের সবাইকে গতকাল কাঁদিয়ে চলে গেলেন। প্রশ্ন উঠছে তাঁর 'এশিয়া এনার্জি' বা ফুলবাড়ি কয়লাখনির আন্দোলনের সময় জনবিরোধী অবস্থান নিয়ে। ব্যক্তিগত ভাবে সেই সময়টা আমরা অনেকেই সক্রিয়ভাবে কোন রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত না থাকলেও একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগেই ফুলবাড়িতে ঘুরেছি, দেশের কোন শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে হয়তো ফুলবাড়ির সাঁওতাল মুক্তিযোদ্ধা থেকে এশিয়া এনার্জির কর্মকর্তা সবার সাথে আলাপচারিতা তুলে ধরে সাধারণ মানুষের পক্ষেই অবস্থান নিচ্ছি, তবে এটাও ভেবে দেখতে হবে যে হয়তো এশিয়া এনার্জির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলেই আলী যাকেরকে অন্তত: ওপার বাংলার রাজনৈতিক বিশ্বাসে সিপিএমের সমর্থক অভিনেতা ও কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মত 'হনুমান চালিশা'-র বিজ্ঞাপনে অভিনয় করার মত কাজ করতে হয়নি। যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুই বাংলার প্রিয় অপু, উদয়ন পন্ডিত থেকে ফেলুদা, বাংলার একমাত্র যে অভিনেতার ছবি গোটা পৃথিবীর সব বড় আর্ট ফিল্ম ডিরেক্টররা দেখেছেন, দু:খজনকভাবে বিশাল ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি ছোট প্রদেশের অভিনেতা বলেই নিজ রাজনৈতিক বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে গিয়ে সৌমিত্রকে 'হনুমান চালিশা'র বিজ্ঞাপনে অভিনয় করতে হয়েছে। পাশাপাশি ছোট হলেও স্বাধীন রাষ্ট্র বলেই ঢাকায় বিনিয়োগ করতে 'এশিয়া এনার্জি'র মত বহুজাতিক সংস্থারা আসে। আমরা স্বাধীন না হলে 'এশিয়া এনার্জি'রা আসত হয়তো দিল্লি বা লাহোরে।
কোভিড প্রতিদিনই কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য মানুষের প্রাণ। আসছে শীত। বাংলাদেশে প্রবল সূর্যালোকের কারণেই গত মার্চ থেকে লকডাউনে কিছু মৃত্যু হলেও ইতালীর মত মহা দূর্যোগের শিকার এখনো হইনি আমরা। কিন্তু শীত আসছে এবং প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এবং এরই ভেতর ফেব্রুয়ারিতে 'অমর একুশে বইমেলা'-র আয়োজনও শুরু করে দিয়েছেন লেখক ও প্রকাশকেরা। ফেব্রুয়ারি আসতে আসতে তখনো শীত পুরো যাবে না, সেই সাথে মেলায় অসংখ্য মানুষের সমাগমের সম্ভাবনা এবং কোভিডে যে কারণে ঘরে ঘরে আমরা সংবাদপত্র রাখা বন্ধ করে দিয়েছি, ব্যঙ্ক থেকে টাকা তুললে তিনবার স্যানিটাইজারে হাত মুছি, সেই কাগজেরই বিষয় গোটা বইমেলা। তত: কিম? তাহলে উপায়?
বইমেলার আবেগ এবং...
একজন লেখক হিসেবে ত' বটেই, বাংলাদেশের সাধারণ এক বাংলাভাষী পাঠক হিসেবেও বইমেলা আমার প্রাণের মেলা। প্রতিবছর এই সময়টার জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করি। না হোক বই বেশি বিক্রি, তবু ত' কত স্বপ্ন থাকে বই মেলা নিয়ে। এবছর মাথায় একাধিক উপন্যাসের ভাবনা বীজ থাকলেও পেশাগত চাপে হোক বা যে কোন কারণেই হোক, উপন্যাস বা গল্পের বই হয়তো এবার হবে না। কিন্তু অতিমারী বিষয়ক বেশ কিছু বিদেশী নিবন্ধের অনুবাদ নিয়ে একটি প্রবন্ধ সঙ্কলণ, কোন চিত্রশিল্পীর আত্মজীবনীর অনুবাদেও পুনর্মুদ্রণ সহ জমে থাকা বেশ কিছু কবিতার একটি বই ত' হতেই পারে। তবু এই যত আবেগ-উদ্দীপনার ভেতরেই কিছুটা বিচলিত কিন্তু বোধ করছি ধেয়ে আসা শীতের সাথে ধেয়ে আসা কোভিড ১৯-এর দ্বিতীয় তরঙ্গ নিয়ে। ২০২০-এর ২রা নভেম্বর অবধি ৪৬,৪০৩,৬৫২ জন সণাক্তকৃত কোভিড রোগীর ভেতরে ১,১৯৮,৫৬৯ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে জাতিসঙ্ঘের 'ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গ্যানাইজেশন (হু)।'
ইউরোপের দেশগুলোয় করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে এসেছিল, কিন্তু আবারও নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। কিছু দেশ যেমন- আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র ও মেসিডোনিয়ায় অন্যান্য মাসের তুলনায় আগস্টে সংক্রমণ বেশি দেখা গেছে। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড ও স্পেনে দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে, যেহেতু নতুন করে আবার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ লক্ষণীয়। যদিও কারণটা নিশ্চিত নয়, তবে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জীবনের প্রয়োজনে মানুষের অবাধ বিচরণ এবং করোনা সতর্কতা মেনে না চলার কারণেও সংক্রমণের মাত্রা ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। তবে দেশগুলো ইতোমধ্যে এর সম্ভাব্য মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ বলতে করোনা সংক্রমণ নিম্নমুখী হওয়া থেকে হঠাৎ আবার ঊর্ধ্বমুখী হওয়াকে বোঝায়। সাধারণত সংক্রমণের হার যখন ৫ শতাংশ অথবা ১০ শতাংশ নিচে আসে, তখন সেটিকে নিম্নমুখী বলা যায়। কিন্তু আমরা এ হারটা এখনো ১০ শতাংশের নিচে দেখতে পাচ্ছি না (শীতকাল এবং করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ: ড: আনোয়ার খসরু পারভেজ, দৈনিক 'আমাদের সময়', ১লা অক্টোবর- ২০২০)। শীতকালের আবহাওয়ায় সর্দি-কাশি সংক্রমণের হার বাড়ে বলে এসময় কোভিডে সংক্রমণের হারও বেড়ে যায়। সম্প্রতি 'দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড' পত্রিকায় প্রকাশিত কোভিড বিষয়ক একাধিক সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারছি যে কিভাবে ২০২০-এর শীতে কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের সময়ে এই ভাইরাস তার চরিত্র বদলে আরো সংহারী রূপ ধারণ করছে। এতদিন কোভিডে অন্তত: রোগীর রক্তে প্ল্যাটিলেট কমতো না। দ্বিতীয় তরঙ্গে কোভিডে কিন্তু রক্তে প্ল্যাটিলেটের পরিমাণও আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে।
আর প্রশ্ন ওখানেই। জনস্বাস্থ্য ও জনসচেতনতার প্রশ্ন। খোদ সৌদি আরব এবার কাবা শরিফের চত্বরে ঈদের নামাজ হতে দেয়নি, ভারত বন্ধ রেখেছে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা। পশ্চিম বাংলায় দুর্গা পূজা সেভাবে হয়নি। ইরানে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ৩,৫৭৪ জন অতিমারীতে সংক্রমিত হয়েছেন বলে জুন মাসে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন খোদ সেদেশের রাষ্ট্রপতি রুহানি (৬ই জুন, ২০২০: সারা বাংলা)। ইরানে জুন পর্যন্তই সংক্রমিত হয়েছেন ১ লাখ ৭ হাজার এবং মারা গেছেন ৮ হাজার মানুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই শীতে ২ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে আক্রান্ত। সোজা কথায় বছর ঘুরে এলেও অতিমারীর দংশন বাড়ছে বই কমছে না। বাংলাদেশেও শীতে নতুন করে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার দু'টোই বাড়ছে। তাহলে কি করণীয়?
হ্যাঁ, বইবিমুখ এই জাতির যে অতি দূর্বল পাঠাভ্যাস নিয়ে খোদ সৈয়দ মুজতবা আলীর মত বহুভাষী, পন্ডিত লেখক 'বই কেনা' নামে আস্ত একটি নিবন্ধই লিখেছিলেন, সেই পাঠবিমুখ বিশেষত: এপার বাংলার সর্বশেষ বা ২০২০-এর বইমেলাতেও কিন্তু মোট ৮২ কোটি টাকার ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে। এর ভেতর মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি একাই বিক্রি করেছে ২.৩৩ কোটি টাকার পরিমাণ বই। বাংলা একাডেমি তথ্যকেন্দ্রর হিসাব মতে, মেলায় প্রকাশিত ৪,৯১৯টি অন্যান্য বইয়ের ভেতর ১,৫৮৫টি বইই ছিল কবিতার।
লক্ষ্য করুন ১,৫৮৫টি বইই ছিল কবিতার। বুঝুন, সাধে সুকুমার রায় অমন আপাত:নিষ্ঠুর রম্য গল্প লেখেননি যে, ঐ যে শ্যামলাল নামে একটি নতুন ছেলে স্কুলে আসার পর তার কবিতা লেখার বাতিক গোটা স্কুলে ছড়িয়ে গেলে স্কুল ইন্সপেক্টর আসার পর সব ছাত্র একসাথে তাঁকে কবিতা শোনাতে গেলে প্রবল শব্দে ইন্সপেক্টর মহোদয়ের অজ্ঞান হয়ে পড়া এবং স্কুলের পন্ডিত মশায় এই 'কবিতা রোগ' তাড়াতে পরে প্রতিদিন যে ভয়ানক কঠিন শাস্তি ছাত্রদের দেন যেটা শেষমেশ 'কবিতা রোগ' তাড়াতে সক্ষম হয়! দু:খিত- আমি কবিদের নিয়ে আদৌ পরিহাস করছি না। আমি নিজেও ভাল বা মন্দ যেমন হোক কবিতা লিখি বা লেখার চেষ্টা করি। প্রশ্ন অন্যত্র। মেলায় এত বইয়ের ভিড়ে ভাল বইয়ের সংখ্যা কত বা কেমন? 'রকমারি'-র হিসাব মতে, গত বছর আরিফ আজাদ ছিলেন মেলার বেস্ট সেলার লেখক। ফ্রি-ল্যান্স নাসিম দ্বিতীয় বেস্ট সেলার ও তৃতীয় বেস্ট সেলার ছিলেন সাদাত হোসেইন। এছাড়াও ডক্টর মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ফরিদ আহমেদ, আয়মান সাদিক, সাদমান সাদিক, সাকিব বিন রশিদ, কবি মারজুক রাসেল ও ইউটিউবার সালমান মুক্তাদির বেস্ট সেলার লেখক তালিকায় ছিলেন। এই তালিকায় নান্দনিক বিবেচনায় দেশের উচ্চারিত প্রবীণ-নবীন কথাশিল্পীবর্গ যেমন সেলিনা হোসেন থেকে শাহাদুজ্জামান বা নির্মলেন্দু গুণ থেকে মাসুদ খান- এঁদের কারো নামই দেখা যাচ্ছে না।
ইউটিউবাররা বেস্ট সেলার!
আর কিছু বিষয় ঘুরেফিরে আসে প্রকাশকদের সম্পর্কে লেখকদের কথা; রয়্যালটি না দেয়া, চুক্তিপত্র না করার—এসব অভিযোগ। তবে এর থেকেও বড় অভিযোগ হচ্ছে হাতে গোণা একটি কি দু'টো প্রকাশনা সংস্থা ছাড়া অধিকাংশ প্রকাশনীই ফেব্রুয়ারির পর বইগুলো গোডাউনে ফেলে রাখে। সুষ্ঠু বিপণনটা ঢাকার প্রকাশকরা এখনো কেন শিখলেন না? এতদিনেও কেন শিখলেন না? এটাই কোটি টাকার প্রশ্ন। এগারো মাস বই গোডাউনে ফেলে রেখে এক মাসে বছরের বাকি কয় মাসের উপার্জন করার এই চূড়ান্ত অপেশাদার মনোভাব যতদিন থাকবে, ততদিন শুধু কোভিড কেন, ঘূর্ণিঝড়-ভূমিকম্প-দাবানল-রাষ্ট্রবিপ্লবের ভেতরে বইমেলা করলেও এদেশের 'রুগ্ন প্রকাশনা শিল্প' রুগ্নই থেকে যাবে।
তাই বলে কি বইমেলা হবে না? আমরা সবাই চাই যে বইমেলা হোক। কিন্তু কিভাবে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা সেটা সম্ভব করে তুলব সেটা নিয়েই ভাবতে হবে। তাতে এবছর শুধু অমর একুশের বইমেলা নয়, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই আগামী মার্চ মাস জুড়ে আর একটি বইমেলা উদযাপিত হবে হয়তো।
আমাদের দেশের প্রকাশকদেরও ঘর-সংসার আছে। আমরা চাই না তাঁরা এবছর আয়-উপার্জনহীন হয়ে পড়ুন। কিন্তু সব মিলিয়ে চারশোর মত প্রকাশক যদি বইমেলায় অংশ নেন, শিশু পুত্র-কন্যার হাত ধরে বইমেলায় আসা তরুণ দম্পতি সহ মেলায় আসা কিশোর-কিশোরী, নর-নারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ লোক সমাগম প্রতিবছর হয় প্রায় চার কোটি। কোভিডে জন সমাগম কমে যদি চার লক্ষ মানুষও আসে, এদের সংক্রমণের ঝুঁকি কিভাবে এড়ানো যাবে? আর প্রাণ ভয়ে খুব অল্প মানুষই যদি আসেন মেলায়, তবে বইয়ের খরচ উঠবে কি করে?
কাজেই বঙ্কিমের কাছ থেকে পংক্তি ধার করে বলতে হয়: ধীরে রজনী ধীরে! গণ সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করার পাশাপাশি বইমেলা আয়োজনের দূরূহ সমুদ্র যাত্রা কিভাবে সম্ভব সেটা নিয়ে এখনি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রকাশক, বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ, লেখক ও পাঠক সহ সবার ভেতর গুরুত্বপূর্ণ মত বিনিময় হোক। অমর একুশের বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা, আমাদের জাতিসত্ত্বা ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের পরিচায়ক। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। বরং এই বইমেলায় অসংখ্য চিন্তা ও মননে দীণ, ভাবনায় গতানুগতিক, ভুল বানান ও ভুল বাক্যের এবং দায়সারা প্রচ্ছদের হাজার বইয়ের ঝকমারি একপাশে সরিয়ে রেখে লেখক-প্রকাশক সহ আমরা সবাই ব্রতী হই নতুন আত্ম-জিজ্ঞাসায়। প্রকাশকরা ভাবতে শুরু করুন কিভাবে এক মাসের মেলায় আটকে না রেখে এদেশের প্রকাশনা শিল্পকে সত্যিই সজীব, জ্ঞান ও তথ্যসমৃদ্ধ, সৃজনশীল ও অর্থকরী করে তোলা যায়! লেখকেরা ভাবুন যে প্রতিবছর বই মেলায় রুটিন হাজিরা না দিয়ে সময় নিয়ে একটি ভাল উপন্যাস লেখার প্রস্তুতি বা ভাল কোন মননশীল কাজের জন্য কঠোর শ্রম দেবার কথা। দরকারে পারষ্পরিক সংলাপও হতে পারে। তবে, সবার আগে ভেবে-চিন্তে কাজ করতে হবে। করে না ভাবাই ভাল!
লেখক: কথাসাহিত্যিক