যে প্রশ্নের উত্তর দেননি কলকাতার হাইকোর্ট
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির 'বাংলা বিজয়ের' ভেতর থেকে উপমহাদেশে বাংলা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের শাসন ব্যবস্থা বাংলাকে কেন্দ্র করে পরিচালিত করে। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে সারা ভারতকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।
এই ধারা ১৭৫৭ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। এই সময়কালে বাংলাকে কেন্দ্র করে বহু কিছুই বিবর্তিত হয়েছে। বাংলা ভারতবর্ষের হিন্দু ধর্মের সতীদাহ প্রথা রদ করার আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেছে এবং ১৮২৯ সনে সতীদাহ প্রথা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ব্যবস্থার আওতায় রদ করা হয়। বাংলা নেতৃত্ব দেয় বিধবা বিবাহের।
এইসব সংস্কার বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলে।
আবার, এই বাংলা স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার হয়েছে। এই বাংলা থেকেই ক্ষুদিরাম, তিতুমীর, সূর্যসেন... প্রায় সকলেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকেছেন। ১৯০৫ সালের আগেই ব্রিটিশরা উপলব্ধি করল, বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত না করলে বাংলা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির অবস্থানই ঘুরিয়ে দিবে। শুরু হলো ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র। বাংলার মানুষকে ধর্মভিত্তিক বিভাজনের রাস্তায় ফেলে দেওয়া হলো। বাংলাকে ভাগ করা হলো পশ্চিমে-পূর্বে। পশ্চিম হিন্দুদের আর পূর্ব মুসলিমদের। সেই বিভাজনের বিরুদ্ধে বাংলার অগ্রগণ্য মানুষেরা দাঁড়ালেন।
বঙ্গভঙ্গের ৬ বছর পর ১৯১১ সালে বাংলা বিভক্তি রোধ করা হলো; কিন্তু শাসনকেন্দ্র বাংলা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করল ইন্ডিয়া কোম্পানি। দিল্লিকে কেন্দ্র করে রাজনীতির যে বিবর্তন শুরু হলো, সেখানে আস্তে আস্তে গড়ে ওঠল উত্তর ভারতের জনপদের নেতৃত্ব। ভারতে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে এলো উত্তর ভারতের মানুষের কাছে। মহাত্মা গান্ধী-সহ তাদের প্রায় সকলেই গুজরাটের অধিবাসী। যে গুজরাট ভারতের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল, মোদী যখন তার মুখ্যমন্ত্রী, আর অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
গুজরাট দাঙ্গা নাকি ১৯৪৭-এর বাংলার দাঙ্গা- কোনটি বেশি ভয়াবহ ছিল, তা নিয়ে হয়তো বিতর্ক করা যেতে পারে; তবে গুজরাট দাঙ্গার ফলে ভারতকে আবার নতুন রাস্তার দিকে ঠেলে দিল মোদি-অমিত শাহ জুটি। তারা ভারতকে নতুনভাবে সাম্প্রদায়িক ভারতে রূপান্তরিত করতে চাইলেন। পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক- সবকিছুকেই ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেন।
মোদি-অমিত শাহ সেই ধারা পশ্চিমবাংলায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। গোটা এপ্রিল মাস ধরে চলতে থাকা নির্বাচনে সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হয়েছেন, বলা যাবে না। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলে ব্যর্থ হয়েছেন। আসনের সংখ্যার দিক থেকে তৃণমূল কংগ্রেস অতীতের সবচেয়ে বেশি আসন পেয়ে রাজ্যের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হলো ৯ মে। রাজ্যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। এরপরেই সামনে চলে এলো একটি ঘটনা। অর্থ বিতরণের কাহিনি নিয়ে একটি স্টিং অপারেশনের ভিডিওচিত্র ফাঁস হলো ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে, যা 'নারোদ কাণ্ড' হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে।
পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনের এদের মধ্যে দুজন অত্যন্ত প্রভাবশালী- যারা দল পরিবর্তন করে বিজেপিতে যোগদান করেছেন। একজন মুকুল রায়, অন্যজন শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দু অধিকারী ও মুকুল রায়- বর্তমানে দুজনেই বিধানসভার সদস্য। এর মধ্যে শুভেন্দু অধিকারী পশ্চিম বাংলা রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। সেই স্টিং অপারেশনের প্রধান ব্যক্তি দক্ষিণ ভারতের একজন সংবাদকর্মী সামিউল।
ভিডিওচিত্রটি ফাঁস হওয়ার সময় যে ১৩ জন রাজনীতিবিদের সংশ্লিষ্টতা, তারা সকলেই সেই সময়ের তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা। ১৩ জনের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি তখন মন্ত্রী ছিলেন। শোভন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতার মেয়র।
'নারদ কাণ্ড' পাঁচ বছর আগে জনসম্মুখে প্রকাশ হয়; কিন্তু তারপরে নানা ঘটনা ঘটেছে। কলকাতা হাইকোর্ট এক সময় সিবিআই তদন্তের ওপরে স্থগিত আদেশ প্রদান করেন। আবার সেই কলকাতা হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে সিবিআইকে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন।
সিবিআই গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ ভারতের শেষ সময়। প্রতিষ্ঠানটি ভারতীয় জনগণের কাছে একটি আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিগত সময়গুলোতে রাজ্যগুলোতে বিভিন্ন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ- সব সময় সিবিআই তদন্তের দাবি উঠে এসেছে বিরোধী রাজনৈতিক দল কর্মীদের কাছ থেকে। কিন্তু গত কিছুদিন যাবত ক্রমান্বয়ে সিবিআই বিতর্কিত অবস্থানে পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সিবিআই'র মনোনয়ন পুরোটাই সরকারের হাতে। যার ফলে এই প্রতিষ্ঠান তার নিরপেক্ষতা হারাচ্ছে বলে সারা দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে একটি বদ্ধ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের সিংহভাগ সময় ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসের অভিযোগ, সিবিআই দ্বারা দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
পশ্চিম বাংলার ঘটনা ঠিক তেমনি একটি ঘটনা বলে ধারণা করা যেতে পারে। কারণ নির্বাচনের পরে সরকার গঠন সম্পন্ন হওয়ার পরে একদিকে কেন্দ্রীয় সরকার মনোনীত রাজ্যপাল মন্ত্রীদের শপথ করাচ্ছেন আর অন্যদিকে তিনি সিবিআইকে এদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনামায় স্বাক্ষর করছেন। প্রশ্ন উঠেছে কলকাতাজুড়ে, আইনজীবীদের মধ্যে, সংবিধান বোদ্ধাদের মধ্যে যে, এই ধরনের আদেশপত্রে রাজ্যপাল স্বাক্ষর করতে পারেন কি না। কারণ, রাজ্যের বিধানসভার সদস্যদের নির্বাচিত বিধানসভার সদস্যদেরকে গ্রেপ্তার করতে হলে স্পিকারের অনুমোদন প্রয়োজন হয়।
আরসিবি ব্যাখ্যা করছে, ঘটনার সময় যেহেতু এরা মন্ত্রী ছিলেন এবং মন্ত্রিত্ব প্রদান করেন কিংবা মন্ত্রিত্বে শপথ পাঠ করান রাজ্যপাল, সেহেতু রাজ্যপাল এদের অথরিটি।
গতকালের (সোমবার) ঘটনাটা চমকপ্রদ। সকাল দশটার মধ্যে সকলকে গ্রেপ্তার করে সিবিআইয়ের পশ্চিম বাংলার অফিস নিজাম প্যালেসে নিয়ে যাওয়া হয়; এরপর সেখানে পৌঁছে যান পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
মমতা ব্যানার্জি প্রায় ৬ ঘণ্টা নিজাম প্যালেস অবস্থান করে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দাবি করেন। কিন্তু এই ঘটনার মধ্য দিয়ে উনি কী অর্জন করলেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। দলীয় কর্মীদের একটি অংশ নিজাম প্যালেসের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদেরকে কাছে ভিড়তে দেওয়া হয়নি। দিনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে সিবিআই আদালতে অভিযুক্তদেরকে উপস্থাপন করে জেলহাজত চাইলেন ১৪ দিনের জন্য।
সিবিআই কর্মকর্তাদের আবেদনের বিপক্ষে গ্রেপ্তারকৃতদের আইনজীবীরা বলেন, যেখানে সিবিআই চার্জশিট প্রদান করেছেন, সেখানে নতুন করে বিনা নোটিশে গ্রেপ্তার করার কোনো প্রয়োজন নাই। এই শুনানি শেষে প্রায় দু'ঘণ্টা পরে সিবিআই আদালতের বিশেষ বিচারক অভিযুক্তদের জামিন প্রদান করেন; কিন্তু জামিন প্রদান করা হলেও অভিযুক্তদের কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখে সিবিআই কর্মকর্তারা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন, এবং রাতের এক শুনানি শেষে পশ্চিম বাংলা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি রাজেশ বিন্দাল ও বিচারপতি অরিজিৎ বন্দোপাধ্যায় বেঞ্চ নিম্ন আদালতের জামিন আদেশ স্থগিত ঘোষণা করেন বুধবার পর্যন্ত। তাছাড়া, অভিযুক্তদের জেলহাজতে রাখার অনুমতি প্রদান করেন এবং পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করেন বুধবার।
স্বাভাবিক দৃষ্টিতে পশ্চিমবঙ্গের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং তার বেঞ্চের এই আদেশ নিয়ে প্রশ্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, বিচারিক আদালত আসামিকে জামিন দিবেন কি না, এটি তার আওতাভুক্ত।
আসামিপক্ষের যুক্তি ছিল খুব জোরাল, যে তদন্ত পরিসমাপ্তি করে অভিযোগ উপস্থাপন করা হলো, তারপরে এই ব্যক্তিদের জামিন মঞ্জুর করা খুবই বিধিবদ্ধ। আরও মজার বিষয় হলো, সিবিআই কর্তৃপক্ষ আসামিদের নামের তালিকায় মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারীকে 'পাওয়া গেল না', সেই দুজন এখন বিজেপির নেতা।
ভারতীয় জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠা সিবিআই এখন সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের খাড়ায় ধ্বংসপ্রায়। এই চিত্র উপমহাদেশের সর্বত্রই। আমাদের উপমহাদেশের দেশগুলোতে নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থাকে বিনষ্ট করার চেষ্টা সব সময় হয়ে থাকে। জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধ সেটা রুখে দেয়।
পশ্চিম বাংলার সরকারের বিরুদ্ধে যেভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের আক্রমণ সংঘটিত হচ্ছে, তাতে প্রায় সর্বস্তরের ভারতীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই আশঙ্কা সুস্পষ্ট যে, হয়তো পশ্চিম বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হবে। বিশেষ করে পশ্চিম ননবাংলার রাজ্য রাজনীতিতে পশ্চিমবাংলার রাজ্যপালের ভূমিকা অনেক বেশি বির্তর্কিত অবস্থানে পৌঁছেছে বলেই বিরোধী দল অভিযোগ করছে।
পরিশেষে কথা বলা যায়, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কেন্দ্র করে যে ধর্মীয় বিভাজন ব্রিটিশরা সৃষ্টি করেছিল, সেই ধারায় ফিরে যাচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশ।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক