মেরকেলের বিদায় ও জার্মানিতে সহনশীল রাজনীতির ভবিষ্যৎ
আর কয়েক মাস পর এই শতাব্দীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারী ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবেন, নাম তার অ্যাঙ্গেলা মেরকেল।
জার্মান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের এ নেতা গত ১৬ বছর একটানা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। ২০০২ সালে প্রথম জার্মান পার্লামেন্টে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। তারপর, ২০০৫ থেকে প্রথম জার্মান নারী চ্যান্সেলর হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালে নির্বাচনে তার দলের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ আগের থেকে হ্রাস পায়।
অ্যাঙ্গেলা মেরকেল জার্মান রাজনীতির ইতিহাসের এমন নেতা যিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেই শুধু ক্ষমতা নয় বরং রাজনীতি ত্যাগের ঘোষণা দেন। তার বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে তিনি আগামীতে আর কোনো নির্বাচন করবেন না বলেও ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার পর জার্মান জনগণের কাছে মেরকেলের জনপ্রিয়তা ইতিহাসের শীর্ষে পৌঁছে যায়। পার্লামেন্টে এ ঘোষণার দিন শতভাগ আইনপ্রণেতা উপস্থিতি হয়ে করতালির মাধ্যমে এই লৌহমানবীকে অভিনন্দন জানান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের আগপর্যন্ত জার্মানির ক্ষমতায় ছিলেন সামরিক শাসকরা। ১৯১৯ সালে সংবিধান অনুসারে জার্মানিতে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করা হয়। সেই সংবিধান অনুসারে এক অদ্ভুত নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে জার্মানিতে। পৃথিবীর আর কোথাও নেই সে নির্বাচনী ব্যবস্থা।
জার্মান নাগরিকরা প্রতি চার বছর অন্তর নির্বাচনে দুটি করে ভোট দেন। একটি ভোট দেওয়া হয় সরাসরি প্রার্থীকে আর দ্বিতীয় ভোট পায় তার পছন্দের রাজনৈতিক দল। ৫৯৮টি আসনের মধ্যে ২৯৯টি আসনে সরাসরি প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করতে হয়। বাদবাকি ২৯৯টি আসনে দলগুলো সদস্য মনোনয়ন দেয়; অর্থাৎ জার্মান সংবিধান অনুসারে যে কোন দল ভোটে অংশ নিতে পারে, কিন্তু ন্যূনতম প্রদত্ত ভোটের ৫% না পেলে তারা পার্লামেন্টের সদস্য পদ পাবে না।
তাই যে দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয় তাদের প্রার্থীদের নাম পূর্বঘোষিত থাকে। দল যদি ন্যূনতম প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ ভোট পায় তাহলে সেই দল প্রদত্ত ভোটের শতাংশ হারে ওই ২৯৯টি আসন থেকে আসন লাভ করে। কিন্তু, ৫ শতাংশ ভোটের কম যদি কোন দল ভোট পায়- তাহলে সেই দল কোন আসন পাবে না। আর সরাসরি নির্বাচনের ২৯৯ আসনে প্রার্থীকেই ভোট দিতে হয়।
দলকে ভোট দেওয়ার প্রধান যৌক্তিকতা হচ্ছে দলটি যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেয় তা পালনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা। ব্যক্তি নির্বাচিত হওয়ার পরেও দলের ঘোষিত নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দায়ভার পুরোপুরি দায়বদ্ধ করা যায় না। দলের সামগ্রিক ভূমিকার উপর স্বীকৃতির বিষয় থাকলে তখন মেনিফেস্টোর বাস্তবায়নের ঘটে। সেই অর্থে দলটি অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করলো কিনা তা জনগণ দেখতে পায়। সেকারণে, ১৬টি প্রদেশে জনসংখ্যার ভিত্তিতে একদিকে যেমন আসন সংখ্যা ভাগ করা আছে, তেমনি এই ২৯৯ আসনে দলকে ওইভাবে আনুপাতিক হারে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়।
বিগত নির্বাচনে অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের দল প্রথম স্থান অধিকার করে, আর দ্বিতীয় স্থানের দলটি এখন মেরকেলের দলের সঙ্গে যৌথভাবে ক্ষমতায়। তৃতীয় স্থানের অধিকারী দলটি এখন প্রধান বিরোধী দল।
এই প্রধান বিরোধীদলের ইতিহাসটা খুবই চমৎকার। দলটির জন্ম হয় ২০১৩ সালে, নাম অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি), ডানপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনটিকে দলটিকে মূলত হিটলারের ধ্যান-ধারণার অনুসারী বলা যায়। ২০১৩ সালের নির্বাচনের ইউরোপে শরণার্থী সংকট সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য তথা; সিরিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্তান থেকে শরণার্থীর ঢল নামে। ইউরোপ অভিমুখে নৌপথে ইতালির উপকূলে হাজার হাজার শরণার্থী পৌঁছে যায়। চ্যান্সেলর মেরকেল সেই শরণার্থী সংকটের সময় জার্মানি ১০ লাখ শরণার্থীকে গ্রহণ করবে ঘোষণা দেন। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো এই উদারতা দেখায়নি।
মধ্যপ্রাচ্যের নানান দেশ থেকে শরণার্থী গ্রহণ করার বিরোধিতা করেই দক্ষিণপন্থী দলটি গড়ে ওঠে। তাদের ব্যাপক প্রচার ও বিরোধিতার ফলে মেরকেলের নিজ দলের ভোটারদের একটি বড় অংশ ২০১৭ সালের নির্বাচনে মুখ ফিরিয়ে নেয়। শরণার্থী গ্রহণ করার সময় যে সমস্ত শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল সে সমস্ত শর্ত পালনে ব্যর্থ হওয়ায় পরবর্তী সময়ে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শরণার্থী জার্মানি ত্যাগ করেছে। এদের সিংহভাগ আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক ইত্যাদি দেশ থেকে আগত, কারণ তাদেরকে যে অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তারা জার্মানিতে থেকে যাওয়াটা আর যুক্তিযুক্ত মনে করেনি।
তবে সিরিয়া এবং লিবিয়া থেকে আগতরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার এখনো দেশটিতে টিকে আছে। আজকের পার্লামেন্টে জার্মান প্রধান বিরোধী সেই দক্ষিণপন্থী দলটি বিগত নির্বাচনের শরণার্থী ইস্যুর সাথে নতুন আরেকটি ইস্যুকে সামনে এনেছে। বিষয়টি হলো; ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কনজারভেটিভ পার্টির মতো এএফডি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগ করতে চায়। ব্রেক্সিট এর মাধ্যমে ব্রিটেন যেমন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগ করেছে সেই রাস্তাকে তারা সেরা মনে করে।
এএফডি যে সমস্ত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে চায় ঠিক এইরকম কর্মসূচি নিয়েই হিটলারের আবির্ভাব হয়েছিল গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর হিটলারও জার্মানিকে নতুন যুদ্ধে উৎসাহিত করতে পেরেছিল তার এই অতি দক্ষিণপন্থী বর্ণবাদী আদর্শ ছড়িয়ে।
বিগত নির্বাচনে এএফডি'র প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৬ শতাংশ, এবার আগামী কয়েক মাস পরে নির্বাচন- তার আগে যে সমীক্ষাগুলো হচ্ছে; তাতে দেখা যাচ্ছে দলটি তাদের ভোটের মাত্রা হারাচ্ছে। প্রাকনির্বাচনী সমীক্ষায় দলটি ১১ .৫ শতাংশ ভোট পাবে বলেই জানা যাচ্ছে। তাছাড়া, দলটির অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি এবং দলবাজি, নেতৃত্বে নানান সংকট একদিকে কিছুটা জনসমর্থন হারানোয় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু, এর পাশাপাশি নতুন নতুন দক্ষিণপন্থী ধারণা তাদেরকে আবার নতুন সমর্থক জুটিয়ে দিচ্ছে।
জার্মানির এবারের নির্বাচনে নতুন ভোটার প্রায় ৩০ লাখ। মোট ভোটার ৬ কোটি ২৮ লাখ। এখন দেখা যাক অক্টোবরের নির্বাচনে আজকের এই বিরোধীদল জার্মানিকে কোন দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের বিদায়ের পর তার দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) কিভাবে জনগণের কাছে আবেদন তৈরি করবে- সেটাও দেখার বিষয়। দলের নতুন নেতা নির্বাচিত হয়েছেন আরমিন ল্যাসচেট। তার প্রতি জার্মান নাগরিকদের আস্থা কতখানি এবার বোঝা যাবে।
যদিও ধারণা করা হচ্ছে, শরণার্থী ইস্যুতে যেমন মেরকেলের দল তাদের ভোটার হারিয়েছিল; আপাতত যেহেতু তেমন ইস্যু সামনে নেই- সেকারণে হয়তো তাদের পুরনো ভোটাররা সিডিইউকে ভোট দেবেন। জার্মান অর্থনীতির প্রয়োজনেই শরণার্থী গ্রহণের কথা প্রকাশ্যে অ্যাঙ্গেলা মেরকেল স্বীকার না করলেও; এটি একটি কঠিন সত্যকথা।
জনসংখ্যার দিক থেকে বয়োবৃদ্ধদের রাষ্ট্র জার্মানি। সেদেশে সন্তানধারণের হার নারী প্রতি ১.৪৫। জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাসে সহায়তা করছে কম সন্তান ধারণ। সাধারণভাবে ২.১১ সন্তান ধারণ করা হলে জনসংখ্যা সমান থাকে। দীর্ঘদিন যাবত জার্মান নারীরা সন্তানধারণ থেকে বিরত থাকছে, ফলে পৃথিবীর বয়স্কদের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। যেখানে গড় আয়ুর মধ্যকমান ৪৯.৫। তাই যে রাজনৈতিক নেতৃত্বই জার্মানির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসুক তাদেরকে অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে নতুন জনসংখ্যা গ্রহণ করতে হবে। এই মুহূর্তে, জার্মানির শিক্ষা ব্যয় ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে স্বল্প মূল্যের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষিত ও সুদক্ষ কর্মীর সৃষ্টি করার জন্য জার্মানরা দীর্ঘদিন বিখ্যাত। শিক্ষিত জার্মান ভাষা জানা তরুণ-তরুণীদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। এমনি অবস্থায় আগামী নির্বাচনে জার্মানিতে কি সমীকরণ তৈরি হবে- তা জানার আগ্রহটাই বাড়ছে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক