মহামারির সংকটকালেও কেন বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতি?
একসময় বাংলাদেশে নিজের সেলাই মেশিন বিক্রির জন্যে ক্রেতা খুঁজে পেতেও সমস্যা হতো থমাস হফম্যানের। যেই সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন বাংলাদেশে শ্রম এতটাই সস্তা ছিল যে তা মেশিনারি জিনিসপত্র কেনার সামর্থ্যও ছিলনা। এমনটাই জানালেন বাংলাদেশে ঢাকায় অবস্থিত বাডেল-ওয়ার্টেমবার্গ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির শাখা পরিচালক থমাস হফম্যান।
কিন্তু বাংলাদেশে ব্যবসায়িক পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। দুবছর আগে এই কোম্পানিটির ইউনিট বিক্রির সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় বাজার হয়ে উঠেছে। হফম্যানের কোম্পানি সারা বিশ্বে ৭০ টিরও বেশি দেশে মেশিনারি জিনিসপত্র সরবরাহ করে থাকে। হফম্যান আশাবাদী, আসছে বছরগুলোতে বাংলাদেশের বাজার আরো বিস্তৃত হতে থাকবে।
পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সম্পর্কে যে চিত্র মানুষের মনে রয়েছে- চরম দারিদ্র, অতি স্বল্প মজুরি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত। কিন্তু হফম্যান এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখেছেন এখানে।
এশিয়ার দরিদ্র দেশের তকমা এখন আর বাংলাদেশের গায়ে লেগে নেই, বরং সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি উদীয়মান সম্ভাবনার দেশ। এমনকি করোনা সংকটকালেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাত্রা এ অঞ্চলের অন্য সকল দেশের চাইতে বেশি। জার্মানির সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটি কারণ। এখন বাংলাদেশ সরকার জার্মান বিনিয়োগকারীদের টার্গেট করছে।
ভারতের চাইতেও বেশি মাথাপিছু আয়
শুধুমাত্র সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, ১৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটি আন্তর্জাতিক আসরে নিজেদেরকে সেরা উদ্যোক্তা দেশ হিসেবেও হাজির করতে পেরেছে। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) ধারণা করছে, নানা সমস্যা জর্জরিত ২০২০ সালেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার থাকবে ৩.৮ শতাংশ, যা সমগ্র এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর ৬ শতাংশেরও বেশি হারে বেড়েছে এবং ২০১৯ এ এটি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ফলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে সরিয়ে দেয়ার সুপারিশ করবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ভারতীয় উপমহাদেশে এক নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আইএমএফ এর ডেটা অনুযায়ী বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ২০২০ সালে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংক এর সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেন, "একটি উদীয়মান দেশ যদি আপন গতিতে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে তা অবশ্যই একটি ভালো সংবাদ। কিন্তু এটি খুবই আশ্চর্যজনক যে ভারত যেখানে পাঁচ বছর আগেও ২৫% এগিয়ে ছিল তারা এখন পেছনে পড়ে গেছে।"
বাংলাদেশের সফলতার পেছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ, বিদেশে কাজ করছে এমন এক কোটি মানুষের কাছ থেকে উপকৃত হচ্ছে দেশটি। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, সম্প্রতি তারা প্রায় ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮১১ কোটি ২৮ লাখ টাকা দেশে পাঠিয়েছে যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির প্রায় ৭ শতাংশ।
এছাড়াও সামাজিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ করাও অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম শর্ত ধরা হয়ে থাকে। নানা সময়ে নানা বিষয়ে সমালোচনার মুখে পড়লেও বাংলাদেশের অর্থনীতির বিনির্মাণে দেশটির পোশাকশিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
চীনের পরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোশাক উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ। এই শিল্পে তাদের রয়েছে ৪০ লাখ কর্মী যাদের অধিকাংশই নারী। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশ জুড়েই আছে এই খাতটি। যুক্তরাষ্ট্রের পরেই ১৩ শতাংশ শেয়ার নিয়ে তাদের দ্বিতীয় প্রধান ক্রেতা জার্মানি।
কিক, আলডি, লিডল ও শিবোর মত কোম্পানিগুলোর কাছে বাংলাদেশ থেকে পণ্যের চালানগুলো যায়। এই কোম্পানিগুলো তাদের সাপ্লাইয়ারদের দুর্বল কর্মকাঠামোর জন্য বছরের পর বছর ধরে সমালোচিত হয়ে আসছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে ১১০০ এর বেশি পোশাকশ্রমিকের মৃত্যু যাতে আরও বড় একটি দাগ টেনে দিয়েছে।
বাংলাদেশে পোশাক শিল্প: অধিক নিরাপত্তা
ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলো থেকে আসা চাপের কারণেই বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মালিকরা নতুন ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) এর 'বেটার ওয়ার্ক প্রোগ্রাম' এর প্রধান ড্যান রীস বলেন, "২০১৩'র পর থেকে তাদের অসাধারণ পরিবর্তন এসেছে।"
কিন্তু এখানে আরো উন্নতির সুযোগ রয়েছে। ড্যান আরো বললেন, "দেশটির ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এখন আগের চাইতে অনেক নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে।" করোনা পরিস্থিতির কারণে এই শিল্পে হাজারো লোকের চাকরি হারানোর ঘটনা ঘটেছে, উৎপাদনকারীরা ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে ক্রেতা পাননি লকডাউনের সময়টাতে।
এপ্রিলের দিকে দেশের টেক্সটাইল রপ্তানি ৮০ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল এবং মে মাসে ৬০ শতাংশেরও বেশি নিচে নেমে যায় তা। ইউরোপে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা এবং এরফলে দেওয়া লকডাউনের কারণে বাংলাদেশে আবারও শ্রমিকদের চাকরি হারানোর সংকট তৈরি করতে পারে।
স্টল ম্যানেজার থমাস হফম্যানের মনেও একই চিন্তা, "আমরা এপ্রিল থেকে খুব কমই মেশিন বিক্রি করতে পেরেছি।" কিন্তু হফম্যান ২০২১ এর ব্যাপারে আশাবাদী, একটি লম্বা বিরতি ও সংকটের পর ক্রেতারা আবার নতুন মেশিনারি জিনিসে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।
হফম্যান বললেন, "যদি অর্ধেক চুক্তিগুলোও বাস্তবায়িত হয় তবুও আমি এখন খুশি থাকব।"করোনার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতির উর্ধ্বগতি চোখে পড়ার মত। হফম্যান আরো যোগ করলেন, "ঢাকার এমন কোনো প্রান্ত নেই যেখানে কোনো না কোন কাজ চলছে না। প্রতি বছরই এই শহরের রাস্তাগুলো উচ্চমধ্যবিত্তদের নতুন নতুন গাড়িতে পূর্ণ হতে থাকে।"
যানবাহনের একটি বড় অংশই আমদানি করতে হয়। নিজের দেশে বাণিজ্যিক বৈচিত্র্য আনতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন বিদেশি অটোমোবাইল কোম্পানিগুলোকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন। তিনি জার্মান কোম্পানিগুলোর সাথেও কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদশের প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গত ডিসেম্বরের দিকে বলেন, তারা ভক্সওয়াগন এর সাথে কথা বলেছেন বাংলাদেশে একটি ইলেক্ট্রিক গাড়ির ফ্যাক্টরি স্থাপনের জন্য। এরকম একটি সম্মানজনক প্রজেক্ট জেতার জন্য অবশ্যই সরকার কিছু ছাড় দেবে। ভক্সওয়াগন এই ফ্যাক্টরির জন্য বিনা টাকায় জমি পাবে বলে জানিয়েছেন ওই উপদেষ্টা।
- মূল সাক্ষাতকারটি জার্মান অর্থনীতি বিষয়ক ম্যাগাজিন 'হান্ডেলসব্লাট' এ প্রকাশিত
- মূল লেখা: Why Bangladesh is experiencing an economic miracle despite the corona crisis
- অনুবাদ: খুশনূর বাশার জয়া