ভারতে কৃষকরা জিতলেও, ‘হার’ মানবেন না মোদি
হাজারও সমস্যা বা সংকটের মাঝেও যখন নরেন্দ্র মোদি জাতির উদ্দেশ্যে টেলিভিশনে ভাষণ দেন, তখন তার কণ্ঠ থাকে যথেষ্ট শান্ত; সাধারণ জনগণ হয়তো তাকে বিচলিত হতে খুব কমই দেখেছেন। ভারতের একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক রুকমিনি এসের মতে, এর আগে সংকট সামলাতে প্রধানমন্ত্রী মোদি যেই ভয়ানক পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হল, গতবছর মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে পুরো দেশে লকডাউন ঘোষণা, বিতর্কিত তিন কৃষি আইন ও ২০১৬ সালে রাতারাতি দেশের মুদ্রার ৮৫ শতাংশ প্রত্যাহার করে নেওয়া।
তবে এ সবকিছুর মধ্যে এখন সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল, বিতর্কিত সেই তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। বির্তকিত আইন তিনটির কারণে ভারতীয় কৃষক সমাজে দেখা দিয়েছিল চূড়ান্ত অসন্তোষ। লাখ লাখ কৃষক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পায়ে হেঁটে বা নিজের ট্রাক্টরে চড়ে অংশ নিয়ছিলেন 'দিল্লি চলো' আন্দোলনে। বছরব্যাপী সেই কৃষক আন্দোলনে দফায় দফায় রাষ্ট্রীয় সহিংসতায় মারা যায় শত শত কৃষক। আত্মহত্যাও করেছিলেন অনেকে।
আইনগুলো গতবছর এক বিশৃঙ্খল ভোটাভুটির মাধ্যমে পাশ হয়েছিল সংসদে। কৃষকদের শঙ্কা ছিল, সরকার গুটি কয়েক শিল্পপতি ও বড় বড় কর্পোরেশনগুলোর স্বার্থ রক্ষার্থেই ওই আইনগুলো পাশ করেছে। কারণ সেখানে ছিলনা ফসলের সরকার নির্ধারিত কোনো মূল্য ব্যবস্থা। কৃষিপণ্যের সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ব্যবস্থাকে (মান্দি ব্যাবস্থা) বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ওই আইনগুলোর মাধ্যমে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধান অর্থনীতিবিদ মোদি সরকারপন্থী গীতা গোপীনাথও সমর্থন করেছিলেন বিতর্কিত আইনগুলো। তবে, ভারতের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশিই আইনগুলোর বিরোধিতা করেছিল।
বছরব্যাপী ওই আন্দোলনের মুখে অবশেষে, আইন তিনটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। তবে মোদি সরকারের কাছ থেকে এমন নমনীয় আচরণ বিরল একটি ঘটনা বলে মনে করছেন ভারতীয় সাংবাদিক রুকমিনি এস সহ অনেক বিশ্লেষক। তাদের মতে, এখন কৃষকরা আন্দোলনে জয়ী হলেও, সামনের দিনগুলোতে এই বিজয় ধরে রাখা হতে পারে অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী।
হিন্দু জাতীয়তাবাদের ওপর ভর করে বিগত ৭ বছরে মোদি সরকার ভারতে ভিন্নমত দাবিয়ে রেখেছে অনেকটা কঠোরভাবেই। ভিন্নমত পোষণকারীরা জেল খেটেছেন, সাংবাদিকরা পুলিশি অ্যাকশনের সম্মুখীন হয়েছেন; সেইসঙ্গে, একজন মুসলিম কৌতুক অভিনেতাকেও হুমকির মুখে দাবিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী মোদি তার মেয়াদের প্রথম দিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বাকস্বাধীনতা রক্ষা করবেন তিনি; অথচ ভারতীয় মিডিয়াগুলো এখন মোদি সরকারের নিজস্ব প্রচারকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
আন্দোলনে পুরো ভারত থেকে যোগ দিয়েছিলেন লাখ লাখ কৃষক। হিন্দু, শিখ, জৈন কিংবা জাট সম্প্রদায়ভুক্ত লোক- বাদ ছিলেন না কেউই। প্রায় এক বছর ধরে দরিদ্র এই কৃষকরা আন্দোলন চালিয়েছেন নিজেদের টাকায়; খোলা আকাশের নিচে থেকেছেন তাঁবু টাঙিয়ে। নারী-পুরুষ এক হয়ে চালিয়েছিলেন এই আন্দোলন। যখন বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়, তখনও তারা জীবনভয়ে পিছ পা হননি। শেষ পর্যন্ত দাবি আদায় করেই ক্ষান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, এতোদিন ধরে চলা এই আন্দোলনে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের লাখ লাখ মানুষ অংশ নিলেও, তাদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো মতভেদ দেখা যায়নি।
এক সময় আন্দোলনকারীরা মোদিকে বুঝিয়ে দিলেন জনমত তাদের সমর্থনে রয়েছে এবং তার সরকার বিক্ষোভকারীদের দাবিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় শুধু শুধু সময় ও অর্থ অপচয় করে যাচ্ছে। ভারতের ২.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান অন্তত ১৫ শতাংশ। দেশের মোট জনশক্তির প্রায় ৬০ শতাংশ (১.৪ বিলিয়ন) অর্থাৎ, জনশক্তির অর্ধেকেরও বেশি সরাসরি জড়িত কৃষিখাতের সঙ্গে। তবে নতুন ওই আইনের ফলে সৃষ্ট অসন্তোষ কৃষিখাতকে যেমন হুমকির মুখে ফেলেছিল, তেমনি তৃণমূল পর্যায়ে মোদি ও তার দল বিজেপির জনপ্রিয়তাও মুখথুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন মোদি তখন; কারণ আসন্ন নির্বাচনের আগে তার জনপ্রিয়তা কমে আসছিল। হতে পারে এ কারণেই কট্টরবাদী হিন্দু জাতীয়তাবাদী মোদি অবশেষে কৃষকদের দাবি মেনে নিয়েছেন।
কিন্তু বিশ্লেষদের মতে, এর মানে এই নয় যে ভারতের প্রতিটি গণবিক্ষোভই এভাবে সফল হবে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিটিজেন আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট-সিএএ) প্রণয়ন করে মোদির সরকার। সেখানে বলা হয়, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা অবৈধ অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেবে ভারত; তবে এখানে শর্ত হল, নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের অবশ্যই অমুসলিম হতে হবে। সেইসঙ্গে, নাগরিকদের একটি জাতীয় নিবন্ধন (ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স-এনআরসি) নিয়েও কাজ শুরু করেছিল সরকার। সেই নিবন্ধন অনুযায়ী, ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে বসবাসকারীদের মধ্যে যারা নিজেদের ভারতীয় বংশধর প্রমাণে যথেষ্ট নথিপত্র দেখাতে ব্যর্থ হবেন, তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে; ভোটাধিকার হারাবেন তারা। মোদ্দাকথা, ভারতীয় মুসলিমদের রাষ্ট্রহীন হতে বাধ্য করছে মোদি সরকারের ওই দুই আইন। ফলে সিএএ ও এনআরসি নিয়েও ভারতীয় মুসলিমরা দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিলেন।
সিএএ ও এনআরসি বিরোধী বিক্ষোভের সঙ্গে কৃষক আন্দোলনের বেশ কিছু মিল রয়েছে। এই আন্দোলনকারীরাও দিল্লির একটি অংশ অবরোধ করেছিলেন খুবই সৃজনশীল উপায়ে; তারা যথেষ্ট উদ্যমী ছিলেন এবং তাদের এই আন্দোলন বেশ জোরালো হয়ে উঠছিল নাগরিক অধিকার বঞ্চিতদের মাঝে। তবে, এখানে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্যও ছিল; আন্দোলনটি ছিল 'মুসলমানদের সমস্যা' নিয়ে। হিন্দু পেশীবহুল ভারতে এই আন্দোলনের মিডিয়া কভারেজও হয়নি ঠিকভাবে; ধর্ম ও জাতিগত ব্যাপক বিদ্বেষের ছাপ দেখা গিয়েছিল সেখানে। অথচ হিসেব করতে গেল, এটিও ভারতের জাতীয় একটি সমস্যার পর্যায়েই পড়ে।
এরপর ২০২০ সালের মার্চে মহামারির কারণে পুরো দেশ চলে যায় লকডাউনে। এর সঙ্গে বিক্ষোভও থেমে যায়। যদি সরকার আবারও এনআরসি নিয়ে কাজ শুরু করে, তহলে কৃষকদের বিজয় মুসলিম বিক্ষোভকারীদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে নাকি তারা একটি ক্ষুব্ধ রাষ্ট্রযন্ত্রের জাঁতাকলে পিষ্ট হবেন, তা তো সময়ই বলে দেবে।
আপাতত, ভারতের কৃষকরা মেতে আছেন তাদের বিজয়উল্লাসে। আর ভারত তার 'সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের' ঢালেই খুঁজে পেয়েছে প্রতিরক্ষা। তবে, সম্ভবত কিছু একটা পরিবর্তন আসতে চলেছে শীঘ্রই; কী সেই পরিবর্তন, তা জানতে দিতে হবে সময়।
- লেখক: সাংবাদিক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড